ডাকাত প্রতিরোধ অভিযানে গিয়ে সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট তানজিম ছারোয়ার নির্জন খুন হওয়ার পর নতুন করে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে চকরিয়ার ডুলাহাজারার সেই ‘রিজার্ভ পাড়া’। উঁচু–নিচু–টিলা শ্রেণির পাহাড় এবং গগণচুম্বি গর্জন গাছে আচ্ছাদিত এই সংরক্ষিত বনভূমির ভেতরই কয়েক বছরে গড়ে তোলা হয়েছে শত শত অবৈধ বসতি। যা রিজার্ভ পাড়া হিসেবেও পরিচিত। অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ একেবারে নির্জন পরিবেশে হওয়ায় সংরক্ষিত বনভূমির এই স্থানটি একেবারে নিরাপদ আস্তানা হয়ে ওঠে সশস্ত্র বনদস্যু–ডাকাত–সন্ত্রাসীদের কাছে। গত দুই বছর ধরে এই রিজার্ভ পাড়াটিই হয়ে ওঠে দুর্ধর্ষ শতাধিক অপরাধীর নিরাপদ আস্তানা।
বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার দায়িত্বশীলরা বলছেন, মূলত এই রিজার্ভ পাড়াটিই হচ্ছে অপরাধীদের অভয়ারণ্য। এখান থেকেই পরিচালিত হয়ে আসছে বনের গাছ কাটা, গরু–মহিষসহ গবাদি পশু চুরি, মানুষের বাড়িঘর ও চিংড়ি জোনে ডাকাতির মতো অহরহ ঘটনা। একেবারে নির্জন ও নিরাপদ আস্তানা হওয়ায় আইন–শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোও সহজে সেখানে অভিযান পরিচালনা করতে সাহস করে না। তাই দিন দিন আরও বেপরোয়া হয়েই শতাধিক সশস্ত্র বনদস্যু–ডাকাত–সন্ত্রাসী প্রতিনিয়ত অপরাধকর্ম সেরে এখানে নিরাপদ আবাস গড়ে তুলেছিল।
অবশ্য সেনা কর্মকর্তা তানজিম ছারোয়ার নির্জন হত্যাকাণ্ডের পর গত কয়েকদিন ধরে রিজার্ভ পাড়া, ডুমখালী, কাটাখালীসহ আশপাশের গ্রামগুলোতে চিরুনি অভিযান চালাচ্ছে যৌথবাহিনী। এতে একের পর এক সশস্ত্র সন্ত্রাসী–ডাকাত ধরাও পড়ছে। বর্তমানে এসব গ্রামের অবৈধ বসতিগুলোর সদস্যদের দিন কাটছে আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তা। গ্রেপ্তার এড়াতে অপরাধীরা গা ঢাকা দিয়ে রয়েছে। এই অবস্থায় ইতোপূর্বে জবর–দখল হওয়া সংরক্ষিত বনভূমি বনবিভাগের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার উপযুক্ত সময় হিসেবেও মনে করছেন অনেকে।
বনবিভাগ ও স্থানীয় পরিবেশ সচেতন লোকজন জানিয়েছেন, কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের ফাঁসিয়াখালী রেঞ্জের ডুলাহাজারা বনবিটের অধীন পূর্ব ডুমখালীর সংরক্ষিত বনাঞ্চলের প্রায় ৫০ একর বনভূমিতে কয়েক বছরে গড়ে উঠেছে অন্তত পাঁচ শতাধিক অবৈধ বসতি। শুধু তাই নয়, পূর্ব ডুমখালীর এই এলাকাটি বর্তমানে রিজার্ভ পাড়া হিসেবেও পরিচিত। উঁচু নিচু ও টিলা শ্রেণির পাহাড়বেষ্টিত সেই রিজার্ভ পাড়াটি বলতে গেলে সবার কাছেই এখন আতঙ্কের জনপদ। এখানে মোড়ে মোড়ে আস্তানা গেঁড়েছিল দুর্ধর্ষ ডাকাত ও বনদস্যুর দল। খোদ বনবিভাগও ডুলাহাজারা ইউনিয়নের পুরো রিজার্ভ পাড়াটি তাদের কাছে মাথা ব্যথার কারণ হয়েই ছিল সেনা কর্মকর্তার হত্যাকাণ্ডের আগ পর্যন্ত।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় এক মাদরাসা শিক্ষক বলেন, রিজার্ভ পাড়াটি কয়েকবছর ধরে পুরোপুরি বনদস্যু–সন্ত্রাসীদেরই নিয়ন্ত্রণে ছিল। বলতে গেলে এখানে আইন–শৃক্সখলা বাহিনীর কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণও ছিল না। এতে অপরাধীরা নির্দ্বিধায় প্রতিনিয়ত গাছ চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, ধর্ষণসহ নানা অপকর্ম চালিয়েছে। কিন্তু তারা বরাবরই পার পেয়ে গেছে।
রিজার্ভ পাড়ার কয়েকজন নিরীহ লোকজন দৈনিক আজাদীকে বলেন, প্রতিনিয়তই বনদস্যু–সন্ত্রাসীদের ভয়–আতঙ্কে তটস্থ থাকতে হয়েছিল তাদের। সূর্যাস্তের পর অন্ধকার নেমে আসার পর পরই রিজার্ভ পাড়ার নিরীহ লোকজন ঘরের বাইরেও বের হতেন না। জরুরি প্রয়োজনে যারা বের হতেন তাদেরকে কৈফিয়ত দিতে হত অপরাধীদের কাছে। কার্যত এই রিজার্ভ পাড়া ছিল অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণে।
ডুলাহাজারা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান হাসানুল ইসলাম আদর বলেন, শান্ত ডুলাহাজারাবাসীর কাছে এক মূর্তিমান আতঙ্কের জনপদ হয়ে উঠেছিল পূর্ব ডুমখালী রিজার্ভ পাড়া। সংরক্ষিত বনভূমি হলেও ওই এলাকাটি পুরোপুরি সন্ত্রাসী ও বনদস্যুদের অভয়ারণ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এ নিয়ে ইতোপূর্বে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন এবং পুলিশের কাছে বারবার বলা হলেও কোনো কাজ হয়নি। তিনি বলেন, সেনা কর্মকর্তা তানজিম ছারোয়ার নির্জন হত্যাকাণ্ডের পর সুযোগ এসেছে বনবিভাগ তাদের সংরক্ষিত বনভূমি থেকে অপরাধীদের আস্তানা গুঁড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার। এটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে প্রায় ৫০ একর বনভূমি পুনরুদ্ধারসহ সেখানে বৃক্ষরাজি সৃজনও করতে পারবে। এখন বনবিভাগ কী উদ্যোগ নেয় সেটি দেখার অপেক্ষায় রয়েছেন ডুলাহাজারাবাসী।
ডুলাহাজারা বনবিট কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, গত এক বছরে বনদস্যু–সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ৩০টির মতো মামলা রুজু করা হয়েছে। এসব মামলায় ১৫ জনকে গ্রেপ্তার করা গেলেও শতাধিক বনদস্যু–সন্ত্রাসী পলাতক অবস্থায় রয়েছে।
এ ব্যাপারে ফাঁসিয়াখালী রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. মেহরাজ উদ্দিন দৈনিক আজাদীকে বলেন, সংরক্ষিত বনভূমি দখল করে যেসব অবৈধ স্থাপনা বা অপরাধীদের নিরাপদ আস্তানা হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছিল তা একে একে গুঁড়িয়ে দেওয়ার কার্যক্রম হাতে নেওয়ার প্রস্তুতি চলমান রয়েছে।
কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের বিভাগীয় বনকর্মকর্তা (ডিএফও) মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, উত্তর বনবিভাগের পাঁচটি বিটের মধ্যে একমাত্র ডুলাহাজারা বনবিটের পূর্ব ডুমখালীর রিজার্ভ পাড়াটি নিয়েই যত মাথাব্যথা আমাদের। বনভূমি দখল বা গাছ কাটার খবর পেয়ে অকুস্থলে যাওয়ার চেষ্টা করলেই হামলে পড়ে বনদস্যু–সন্ত্রাসীর দল। এরপরও বনবিভাগের কর্মীরা আপ্রাণ চেষ্টা করেছে বনভূমি ও গাছপালা রক্ষায়। তিনি বলেন, এখন সুযোগ এসেছে, জবর–দখল হওয়া সেই সংরক্ষিত বনভূমি পুনরুদ্ধার করে সেখানে বৃক্ষরাজি সৃজন করার। এজন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
যৌথবাহিনীর অভিযানের নেতৃত্বে থাকা আইন–শৃক্সখলা বাহিনীর একজন কর্মকতা দৈনিক আজাদীকে বলেন, বনবিভাগ যদি উদ্যোগ নেয়, তাহলে অবৈধ বসতি উচ্ছেদসহ সংরক্ষিত বনভূমি পুনরুদ্ধারে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়া হবে।