ঘোড়াউত্রা তীরের গেরস্তি

বাবর আলী | সোমবার , ১৩ জুন, ২০২২ at ৮:৫৪ পূর্বাহ্ণ

পর্ব-২
ঘড়ির কাঁটায় বিকাল প্রায় চারটা গড়িয়ে যাওয়াতে কাকা তাড়া দিলেন ‘মাদানী’ সেরে নিতে। দুপুরের খাবারকে এ অঞ্চলের কথ্য ভাষায় বলা হয় ‘মাদানী’। কাকার বাড়ি থেকে টিফিন ক্যারিয়ারে বয়ে আনা নুডলস দিয়ে সারলাম দুপুরের খাবার। ওই বাড়িতে ভাত রান্নার তোড়জোড় শুরু হলেও ট্রলার ধরার তাড়ায় সে ঝামেলায় না গিয়ে নুডলস নিয়েই এসে পড়েছি আমরা। সাথে অবশ্য রাতের খাবারের জন্য কাকি সাথে দিয়েছেন একটা আস্ত দেশী মোরগও। সানি রাকিবের কাছে আরেক কাকা কী পরিমাণ চাষ করেছে জিজ্ঞেস করায় রাকিব উত্তর দিল, ‘হ্যারা শুধু খোরাহী ভোজের বাদামের খেত করেছে।’ ‘খোরাহী ভোজে’র ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিল সানি। শুধুমাত্র নিজেদের বাৎসরিক চাহিদার পরিমাণমতো কিছু চাষ করাকে বলা হয় ্তুখোরাহী ভোজ্থ। ওইটুকু ফসল নিজেদের চাহিদাই মেটায়। ‘বিক্রয়ের জন্য নহে’ ট্যাগ থাকে এর গায়ে!
বিকালে বেরোলাম নদীর তীর ধরে খানিকটা বেড়াতে। সঙ্গী হলো ওবায়দুল্লাহ। নানান খেত দেখতে দেখতেই হাঁটছি। আমার চেয়ে ওবায়দুল্লাহ আর সানির ফসল বিষয়ক জ্ঞান অনেক বেশি। নানান ফসলাদির খেত বেশ আগ্রহ নিয়েই চেনাচ্ছিল দুজনে। ওবায়দুল্লাহর চোখ খুঁজে বেড়াচ্ছে খিরা খেত। কিন্তু ওই জিনিস চোখেই পড়ছে না। আগে নাকি এই অঞ্চলে প্রচুর খিরা চাষ হতো। মুনিদের অত্যাচারে সেটা বন্ধ হবার যোগাড়। এই অঞ্চলের ভাষায় কামলার অপর নাম মুনি। এই ‘মুনি’রা যোগী নয়, অনেকাংশে ভোগী! পথচলতি অন্যের খেতের খিরা তুলে নেয় প্রায়শই। সেই জ্বালাতেই খিরার চাষ কমে গেছে অনেকটাই। বছরের শেষ সূর্যটাকে বিদায় জানালাম ঘোড়াউত্রার তীরে বসেই। খানিক বাদেই বাতাসের সাথে কটু গন্ধ আসাতে আশেপাশে এর উৎস খোঁজাতে ব্যস্ত হয়ে গেল চোখ দুটো। অল্প দূরেই দেখতে পেলাম একটা মরু গরুর কঙ্কাল। স্রোতের টানেই ভেসে এসেছে সম্ভবত। হাড়গুলোই অবশিষ্ট আছে শুধু। অনুমান করা যায়, চিল-শকুনদের দারুণ ভোজ হয়ে গিয়েছে এই কদিনে।
ফিরে এসে ঘরে ঢুকে দেখলাম গরুর পালকে ততক্ষণে ঘরে ঢুকিয়ে ফেলেছে কাকা আর রাকিব। কুপির আলোয় রাতের খাবার রান্নার দায়িত্ব নিল সানি। কাকি টিফিন ক্যারিয়ারে আগেই মাছ ভেজে দিয়েছিলেন। ঝোলসমেত মাছটাকে খাবার উপযোগী করা আর মোরগটা রান্নার কাজ সারতে হবে কুপির আলোতেই। রান্নাবাড়ার ফাঁকেই রাকিব বলছিল ওর আর গেরস্তির শখ নেই। এই কাজে অসম্ভব পরিশ্রম। আর বাড়ি থেকে এতদিন দূরে থাকতেও ভালো লাগে না। পরের বছর থেকে এসব আর করবে না। এই বছরের লাভের টাকায় মোটরসাইকেল কিনে ঘুরাঘুরি করবে।
হাত দুয়েক দূরে থাকা গরুগুলো সমানে জাবর কাটছিল। আমরাও কম কীসে! হালচাষে বাতিল বলদের মতো আমরাও নিজেদের নানান গল্পে মশগুল হয়ে পুরনো স্মৃতি জাবর কাটছি। কাকা জানালেন এই অঞ্চলে একসময় ডাকাতের বেশ উপদ্রব ছিল। ট্রলারে করে এসে গেরস্থিদের জিম্মি করে গরু নিয়ে যেত। এই ডাকাতের দলকে ভয় নয়তো তোষণ করেই জীবন কাটত গেরস্থিদের। কিন্তু জগতের কোন খেলাই একপেশে হয় না। প্রতিপক্ষেরও চাল দেয়ার সময় আসে। মোবাইল ফোনের বহুল ব্যবহার শুরু হওয়ার পরে ডাকাতের দলকে ভালোমতো জব্দ করা গেছে। এই অঞ্চল থেকে বেরোনোর একমাত্র উপায় যেহেতু নদীপথ, সেহেতু বের হবার গ্রামগুলোয় ফোন করে দিলে ওরা ডাকাত দলকে আটকে ফেলত। বারকয়েক ধরা খেয়েও ডাকাত দল না থামায় একবার ডাকাত দলের বেশ কয়েকজনকে কেটে ভাসিয়ে দেয়া হয় গাঙে! অস্তিত্বের প্রয়োজনে কঠোর হতে হয়েছে হাওড়ের লোকজনকে। ওই ঘটনার পর অবশ্য আর কখনোই ডাকাতের দল এ তল্লাটে হানা দেয়নি।রাতের খাবারের পর আবার খানিকটা হেঁটে বাইরের গরু বাঁধার খুঁটিতে বসলাম খানিকক্ষণ। আকাশে অনন্ত নক্ষত্ররাজির পসরা। মনে হচ্ছিল কোন শিল্পী যেন বিশাল ক্যানভাসজুড়ে অসংখ্য বিন্দু এঁকে রেখেছে। ধূলি-ধূসরিত সামনের পথটাকে এই আবছা আলোয় বহতা নদী বলে ভ্রম হচ্ছে। এই আধো অন্ধকারটা স্পর্শযোগ্য। মনে হচ্ছে এর সাথে সহজেই কথা বলা যায়। খোলা এই প্রান্তরে কনকনে বাতাস উপেক্ষা করেও আকাশপানে চেয়ে বেশ সময় কাটছিল। তিষ্ঠোতে দিল না কাকার ডাক। দুই অধমের ঠান্ডা লেগে যাবার ভয়ে আমাদের চেয়েও কাতর উনি। আড্ডাটাকে কার্পেটের মতো মুড়িয়ে নিজেরা আশ্রয় নিলাম কম্বলের ওমে। ঘরের ভেতরে ঢোকার পরে কাকা বললেন, ‘কাল ফেরার সময় আর ট্রলারে ফিরে কাম নেই। তোমরা দুজনে গাঙের পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে চলা যাবা। ৬-৭ কিলোমিটার হাঁটলেই খেয়া পেয়ে যাবা। নতুন জায়গা দেখতে দেখতে যাবা।’এই কথাটা আমাদের দুজনের জন্য বজ্রাঘাতের মতোই। যে কাকা দিনের শুরুতে আমাদের ছোটখাটো অসুবিধার দিকে নজর রাখছিলেন, তার মুখে এমন কথা শুনে আমরা দুজনেই থ। কাকা ইতোমধ্যে বুঝে গিয়েছেন আমাদের কোনো কিছুতেই সমস্যা নেই। থাকা-খাওয়ার তথাকথিত নাগরিক অসুবিধার ব্যাপার-স্যাপার আমাদের ধর্তব্যের মধ্যেই নেই। খাটে স্থান হলো সানি আর আমার। আর খাট লাগোয়া টেবিলে কাকা। অনেকবার বলেও তাকে খাটে আনা গেল না। খাট থেকে হাত দুয়েক দুরত্বেই শুয়ে আছে আটখানা গরু।
২০২২ সালটা ২২ কিলোমিটার দৌড় দিয়েই শুরুর পরিকল্পনা করে রেখেছিলাম। ছয়টায় উঠেও কনকনে বাতাসের জন্য আবার ঘরের ভেতরে সেঁধিয়ে পড়লাম। খানিক বাদে বের হওয়ার আগে রাকিব হাতে ধরিয়ে দিল সদ্যই দোয়ানো গরুর দুধ। মুখে দিয়েই বুঝলাম এই দুধটা বেশ মিষ্টি আর ঘন। কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা গেল এই দুধটুকু ‘ছাড়াইন্না গাই এর দুধ’। গাভি শেষদিকে দুধ দেয় কম কিন্তু ঘনত্বে আর মিষ্টত্বে হয় অনন্য। সেই রেশটুকু মুখে নিয়েই দৌড় শুরু। অসংখ্য ফসলের খেত পেরোচ্ছি। দেখা মিলছে দূরের গ্রাম থেকে খেতে কাজ করতে আসা মানুষের। তাদের মুখে একটাই প্রশ্ন, ‘দৌড়াও ক্যারে?’

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাশেদ রউফ-এর অন্ত্যমিল
পরবর্তী নিবন্ধচলেন দোল খাই