‘ঘুষ চাইলি মাইরজ্জুম’। নগরের সিরাজদ্দৌলা রোডের চন্দনপুরা ফায়ার স্টেশনের বিপরীতে রয়েছে এ দেয়াল লিখন। এ পথে যারাই যান থমকে দাঁড়ান কিছু সময়ের জন্য। তাকান মুগ্ধচিত্তে।
এদের একজন ব্যবসায়ী হোসাইন আহমেদ। আজাদীকে তিনি জানান, কারা এ গ্রাফিতি করেছে জানি না। তবে ‘ঘুষ চাইলি মাইরজ্জুম’, সময়ের সাহসী উচ্চারণ। সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে সেবা নিতে আসা লোকজন ঘুষ না দিলে সেবা পায় না। ঘুষ নেয়াটা যেন অনেকটা স্বাভাবিক বিষয় অনেকগুলো দপ্তরের কর্মকর্তা–কর্মচারিদের জন্য। বিষয়টি নিয়ে চাপা ক্ষোভ আছে সাধারণ মানুষের। যদিও নানা প্রতিকূলতার কারণে সেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটানো সম্ভব হয় না। দেয়ালে যেন সেই ক্ষোভের প্রকাশ ঘটেছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র–আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট পতন হয়েছে আওয়ামী সরকারের। দীর্ঘ একমাসের আন্দোলনে দেয়া বহু রক্তের বিনিময়ে সাফল্য পেয়েছে ছাত্র–জনতা। তাদের সেই ত্যাগ এবং আন্দোলনের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে নগরের প্রধান সড়ক থেকে অলিগলির দেয়ালগুলো। রঙিন হয়ে উঠেছে এসব দেয়াল। নানা গ্রাফিতি এবং দেয়াল লিখনে রঙিন হয়ে উঠেছে দেয়ালগুলো। আন্দোলন চলাকালে জনপ্রিয় হয়ে উঠা নানা স্লোগান স্থান পেয়েছে সেখানে। আছে গুলিবিদ্ধ শিক্ষার্থীকে নিয়ে হৃদয়স্পর্শী কথামালা। আছে আন্দোলনে যুক্ত শিক্ষার্থীদের রক্তে–রঞ্জিত ইতিহাস। আছে আগামী দিনের স্বপ্নগুলোও।
সরকার পতনের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বানে সারা দেশে গ্রাফিতি ও দেয়াল লিখন শুরু করে শিক্ষার্থীরা। তারই ধারাবাহিকতায় নগরেও বিভিন্ন দেয়ালে হয়েছে গ্রাফিতি ও দেয়াল লিখন। বিভিন্ন স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরা স্বতঃর্স্ফূতভাবে এগিয়ে আসে এ গ্রাফিতি আঁকতে। অনেক জায়গায় সাধারণ মানুষও এগিয়ে আশে তাদের পাশে।
গতকাল নগরের জামাল খান, জিইসি মোড়, ২ নম্বর গেট, শিল্পকলা একাডেমি, চকবাজার, পাঁচলাইশ, মহসিন কলেজের সীমানা দেয়াল, চন্দনপুরা, গুডস হিল, নিউ মার্কেটসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এসব গ্রাফিতি দেখা গেছে।
গুডস হিলের দেয়ালে আঁকা হয় একটি দাড়ি পাল্লা। এক পাল্লায় লেখা আছে ছাত্র সমাজ ও সত্য এবং অপর পাল্লায় রয়েছে স্বৈরাচার ও মিথ্যা। চিত্রে সত্যের পাল্লা ছিল ভারী। পাশে ছিল একটি স্লোগান–মিথ্যা যতই ভারী হোক, সত্যের চেয়ে ওজন কম।
নিউ মার্কেট মোড়ের ভাস্কর্যে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬৯’র গণ অভ্যুত্থান ও ৭১’র মহান মুক্তিযুদ্ধ। সবার উপরে ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর ‘২০২৪ স্বাধীনতা’।
কোটা সংস্কার আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র মীর মাহফুজুর রহমান (মুগ্ধ)। আন্দোলন চলাকালে তার একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে। যেখানে মুগ্ধ বলছিল, ‘ভাই কারও পানি লাগবে, পানি…’। গুলিতে মারা গেলেও তার সে কথা ভুলে যাননি আন্দোলনকারীরা। তাদের পরবর্তী কর্মসূচিগুলোতে বার বার উচ্চারিত হয়েছে ‘পানি লাগবে পানি…’। সরকার পতনেরও পরও তার স্মৃতি ধরে রেখেছেন আন্দোলনকারীরা। সাদা দেয়ালে লাল কালি দিয়ে লেখা হয়েছে, ‘পানি লাগবে পানি…’।
এছাড়া বিভিন্ন দেয়ালে আছে আন্দোলনের সময় গুলির সামনে বুক পেতে দেওয়া আবু সাঈদ। আলোচিত নানা স্লোগানের মধ্যে আছে ‘স্বাধীনতা এনেছি যখন, সংস্কার করি’, ‘ইতিহাসের নতুন অধ্যায় জুলাই ’২৪, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো জুলাই’, ‘আমাদের দেশের ভাগ্য আমরা পরিবর্তন করব’, ‘আমাদের দেশ আমাদেরই গড়ে নিতে হবে’।
কয়েকদিন আগে গ্রাফিতি কর্মসূচিতে অংশ নেয়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাদিয়া নাজনীন সাংবাদিকদের বলেন, দেয়ালগুলো খুব বেশি নোংরা ছিল। দেখতে ভালো লাগছে না। আর শিক্ষার্থীরা একটি সুন্দর বাংলাদেশের জন্য আন্দোলন করেছেন। তাই যেকোনো ধরনের ময়লা–আবর্জনা আর খারাপ ধারণা মুছে দিতে চাই। আমরা একটা সুদর বাংলাদেশ উপহার দিতে চাই।