অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এক বছর অতিবাহিত হলো। গত বছরের এই দিনে আন্দোলনকারী সকল পক্ষের সম্মতিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে ৮ আগস্ট নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস শপথ গ্রহণ করেন। একজন আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে তাঁর প্রতি মানুষের প্রত্যাশা ছিল অনেক বেশি। দায়িত্ব নেওয়ার পর হতে প্রফেসর ইউনূসকে দেশি–বিদেশি অনেক চক্রান্ত মোকাবিলা করতে হয়েছে। মোকাবিলা করতে হয়েছে – দেশের অভ্যন্তরে প্রায় দু‘শ আন্দোলন। এতো ঝক্কি–ঝামেলার পরও তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্বে দেশ অনেকটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে বলেই অনেকের মূল্যায়ন। দায়িত্ব নেয়ার প্রাক্কালে দেশের ব্যাংকিং সেক্টর ও অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল বিপর্যস্ত। তৎকালীন সরকারের মন্ত্রী–এমপিদের দুর্নীতি, টাকা পাচার ও লুটপাটের কারণে ব্যাংকগুলোর তহবিল প্রায় খালি হয়ে গিয়েছিল, ডলার সংকট প্রকট ছিলো। ভারতসহ অন্যান্য দেশের ঋণ পরিশোধের চাপ ছিল। এরপর শুরু হয় ভয়াবহ বন্যা। সরকার অত্যন্ত দক্ষ হাতে এসব সমস্যা সমাধান করেছে। ব্যাংকিং খাত সংস্কারের জন্য একটি বিশেষ শিল্পগ্রুপের হাত হতে ব্যাংকগুলো পুনরুদ্ধার করে নতুন পরিচালনা পরিষদের হাতে ন্যস্ত করেছে। (যদিও ব্যাংক খাতে এখনও কিছুটা অস্থিরতা বিরাজ করছে)। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মোট ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। এই কমিশনগুলো হলো: সংবিধান সংস্কার কমিশন, নির্বাচন কমিশন, পুলিশ প্রশাসন, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন, অন্যান্য সংস্কার কমিশন ৫টি। কমিশনগুলো তাঁদের রিপোর্ট দিয়েছে। আশাকরি, কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়ন করা হলে দেশে অরাজকতা কমবে এবং সুশাসন আসবে। সরকারের সুচিন্তিত পদক্ষেপের ফলে রিজার্ভ বৃদ্ধি পেয়েছে।। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সবশেষ তথ্যানুযায়ী, ৪ আগস্ট পর্যন্ত দেশের গ্রস রিজার্ভের পরিমাণ ৩০.৮১ মিলিয়ন ডলার।(২০২৪ সালের ৩১ জুলাই আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সপ্তাহে মোট রিজার্ভ ছিল ২৫.৯২ বিলিয়ন ডলার)। গত এক বছরে (২০২৪–২৫ অর্থবছরে) বাংলাদেশ ৪.০৮৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করেছে, যা ছিলো রেকর্ড। বিভিন্ন সংস্থার সর্বমোট বকেয়া ছিল ৩.২ বিলিয়ন ডলার। অন্তর্বর্তী সরকার সেটি ৬০০ মিলিয়নে নামিয়ে এনেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ভোগ্যপণ্য ও দ্রব্যমুল্য সাধারণ মানুষের নাগালে রাখার চেষ্টা করেছে। বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়নি। তবে চালের দাম উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। আগে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যেরকম ব্যাপক দুর্নীতির কথা শোনা যেতো, তাঁর ও উপদেষ্টাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির সামান্য গল্পও শোনা যাচ্ছে না। বরং মেগাপ্রকল্প হতে ‘অর্থ বরাদ্দ কমানোর’ সংবাদ আমরা পত্রিকার পাতায় দেখেছি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ইতোমধ্যে ‘আন্তর্জাতিক গুম বিরোধী সনদে স্বাক্ষর’ করেছে। রেমিট্যান্স প্রবাহ বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ২৭.৪৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। যা গতবছরের এই সময়ের তুলনায় ৪ বিলিয়ন বেশি। প্রবাসীদের ভিআইপি মর্যাদা দিয়েছেন তিনি। তাঁর যোগ্য নেতৃত্বে আরব আমিরাতে প্রবাসী বাংলাদেশিদের কারাগার থেকে বেকসুর খালাস পেয়েছে। ডলারের দামের উল্লম্পন ঠেকানো সম্ভব হয়েছে। স্কুলের বইগুলোতে পারিবারিক তোষামোদির গল্প বাদ দিয়ে সাজানো গোছানো সিলেবাস দেওয়া হচ্ছে। সকল সরকারি কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব একমাত্র তার পক্ষেই আদায় করা সম্ভব হয়েছে। বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে ও ডিজিটাল প্লাটফর্মে তুমুল সমালোচনা ও তার বিরুদ্ধে কুৎসিত ভাষায় অপপ্রচার করা যাচ্ছে। বিরোধীরা পাগলের মতই তাঁকে এবং তাঁর উপদেষ্টাদের গালমন্দ করে যাচ্ছেন। কাউকে তিনি গ্রেফতার করেন নি। যা বিগত দিনে কল্পনাও করা যেতো না।
বাংলাদেশের জন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হলো ২০২৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ইইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশের ভিসা আমাদের দেশে হবে। যা আগে ভারত থেকে নিতে হতো। প্রফেসর ইউনূসের সরকার জুলাই আন্দোলনে শহীদ ও আহতদের পরিবারকে সহায়তা দানের জন্য নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
আমরা লক্ষ্য করেছি যে, ড. ইউনুস কখনও অ–কাজের কথা বলেন না। তিনি কখনও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিক্রি করেন না। আমিত্ব প্রচার করেন না। তিনি ভবিষ্যতের কথা বলেন। স্বপ্নের কথা বলেন। দারিদ্র্য বিমোচন ও তরুণদের এগিয়ে যাওয়ার কথা বলেন। তিনি ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করেন না। জনগণ দীর্ঘ মেয়াদে তাঁকে চাইলেও তিনি ২০২৬‘র ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন দিয়ে নিজের কাজে ফিরে যেতে চান বলে জানা গেছে। আমরা আশাকরি প্রফেসর ইউনূসের নেতৃত্বে আগামী কয়েকমাসও দেশের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট ও সমাজকর্মী।