‘সাধের লাউ’ চুরির মাধ্যমে অপরাধ জগতে হাতে খড়ি সুনামগঞ্জের শফিকুল ইসলাম ওরফে শইক্যার (৩১)। এখন চুরি করে স্বর্ণ, মোবাইল, ল্যাপটপ। চুরি করতে এ পর্যন্ত দেশের ৪১টি জেলা ঘোরা হয়ে গেছে তার। যখন যে জেলায় যায়, সেখানে ব্যবসায়ী পরিচয়ে ১৫ দিন থেকে এক মাস পর্যন্ত হোটেলে অবস্থান করে। তার স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, এ পর্যন্ত পাঁচশ’রও বেশি চুরি করেছে। ধরা পড়েছে হাতেগোনা কয়েকবার। একবার ভেবেছিল এ পেশা ছেড়ে দেবে। কিন্তু মামলার খরচ চালাতে এবং নিজের মাত্রাতিরিক্ত ইয়াবা সেবনের খরচ যোগাতে এ পেশায় বারে বারে জড়িয়ে পড়ে। সম্প্রতি চট্টগ্রামে এসেছে জানুয়ারির ২২ তারিখ। নগরীর বিআরটিসি ফলমন্ডি এলাকার আবাসিক হোটেল হার্ট অব সিটি থেকে দুর্ধর্ষ এ চোরকে গ্রেপ্তার করেছে কোতোয়ালী থানা পুলিশ। এসময় তার চুরি করা মালামাল কেনার দায়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছে পুরাতন রেল স্টেশনের চোরাই মার্কেটের হকার নেতা আনোয়ার হোসেনকে। তাদের কাছ থেকে ৫০০ পিস ইয়াবা, ২টি আইফোন, দুটি স্বর্ণের চুড়ি, একটি স্বর্ণের চেইন ও একটি আংটি জব্দ করা হয়। শফিকুল ইসলাম সুনামগঞ্জ জেলার বাতাঘাট ইউনিয়নের মো. আক্তার হোসেনের ছেলে।
কোতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নেজাম উদ্দিন আজাদীকে বলেন, আমরা অনেক চেষ্টার পর অবশেষে শফিকুলকে গ্রেপ্তারে সক্ষম হয়েছি। তাকে ধরতে সোর্স নিয়োগ করি। এসআই মোমিনুল, এসআই মৃণাল, এএসআই অনুপ, এএসআই রণেশ ও এএসআই সাইফুলের নেতৃত্বে টিম গঠন করা হয়। তারা রিয়াজউদ্দিন বাজার জেবুন্নেছা রোডের কর্ণফুলী টাওয়ারস্থ হোটেল হার্ট অব সিটির ৭০৮ নম্বর রুম থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে।
তিনি বলেন, পেশাগত জীবনে অনেক চোর দেখেছি। কিন্তু শফিকুল চুরি করে কোনো ভয়-ডর ছাড়াই। এমনও প্রমাণ পেয়েছি যে, যে বাসায় চুরি করেছে, ক্ষিধে লাগায় বেরিয়ে আসার সময় সেই বাসার রান্নাঘরে কোয়েল পাখির মাংস দিয়ে ভাতও খেয়ে এসেছে। আর গ্রেপ্তার আনোয়ার চোরাই মোবাইল বিক্রি করে। ইয়াবা সে নিজে খায়, আবার বিক্রিও করে। তাদের বিরুদ্ধে মাদক ও চুরির অভিযোগে শুধু চট্টগ্রামেই রয়েছে চারটি মামলা। চুরি শেষ করে আবার অন্য জেলায় চলে যায় শইক্যা, যাতে কেউ তাকে ধরতে না পারে।
লাউ চুরি করে অপরাধ জগতে : জিজ্ঞাসাবাদে শফিকুল পুলিশকে জানিয়েছে, একসময় বাড়িতে সে কৃষিকাজ করতো। একদিন আবুল খায়ের নামে এক চোরের সাথে পরিচয়। খায়েরই এ লাইনে তার গুরু। খায়েরের সাথে মিলে প্রথম চুরি করে ১০টা লাউ। ১০ টাকা করে বিক্রি করে। দ্বিতীয় চুরি করে নিজের ঘরেই। বাবার জমানো অর্থ থেকে ২৫ হাজার টাকা চুরি করে। ধরা পড়লে মারধর করে তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। ১০ বছর আগে চট্টগ্রাম এসে শুঁটকির ব্যবসা শুরু করে। কিন্তু তাতেও লোকসান হয়। বছর পাঁচেক আগে লালদীঘির পাড়ে এক চোরের সাথে আলাপ হয়। তার সাথে মিলে চান্দগাঁওয়ের একটি বাসা থেকে দুইটি মোবাইল ও একটি টেলিভিশন চুরি করে। স্টেশনে মাদকের স্পট হিসেবে খ্যাত বরিশাল কলোনিতে মাদক ব্যবসায়ী আকাশের কাছে আড়াই হাজার টাকায় সেগুলা বিক্রি করে দেয়। এরপর থেকে চুরি চলতে থাকে। চোরাই মালামাল বিক্রি করতো আকাশের কাছে। আকাশই তাদের চালাতো। খাবারের পাশাপাশি ফেন্সিডিলও খাওয়াতো আকাশ। কিন্তু তাদের সখ্যতায় ফাটল ধরে এক বছর পর, যখন দশ ভরি চোরা স্বর্ণের বিনিময়ে আকাশ তাদের মাত্র দশ হাজার টাকা দেয়। আকাশের সঙ্গ ছেড়ে যোগ দেয় চট্টগ্রামের অন্ধকার জগতের আরেক অপরাধী ইলুর সাথে। এরই মধ্যে সে বিয়েও করে।
একাকি চুরির সিদ্ধান্ত : শফিকুল সিদ্ধান্ত নেয়, যা করার এখন থেকে একাই করবে। লাভ লস যা হওয়ার নিজেই ভোগ করবে। এ সিদ্ধান্তের পর প্রথম চুরি করে পতেঙ্গা এলাকায়। এরপর থেকে চলতেই থাকে। আগে ভোর বেলা চুরি করতো। দরজা খোলা দেখলেই ঢুকে মোবাইল চুরি করতো। তা বিক্রি করে পুরাতন রেল স্টেশনের চোরাই মার্কেটের ব্যবসায়ী আনোয়ার, সবুজ, মিজান, রুবেল, দেলোয়ার, কবীরসহ বেশ কয়েকজনের কাছে। ওসি বলেন, শফিকুল ১৫ দিনের চুরির মিশনে এসে নগরীর বিভিন্ন স্থানে কখনো রিক্সা বা কখনো পায়ে হেঁটে চুরি করার স্থান চিহ্নিত করে। পরে রাত ২টা/৩টার দিকে মাত্র কয়েক মিনিটেই গ্রিল কেটে বা তালা ভেঙে চুরি করে। সে চট্টগ্রাম শহরে ৫০/৬০টি চুরি করেছে এবং অনুরূপভাবে দেশের বিভিন্নস্থানে একই স্টাইলে চুরি করেছে বলে পুলিশের কাছে স্বীকার করেছে।
বাড়ি যেতে যেতেই চুরি : পুলিশের কাছে শফিকুল জানায়, বাড়ি যেতে আমার এক মাস সময় লাগে। চট্টগ্রাম থেকে সুনামগঞ্জ বাড়ি যাওয়ার সময় চট্টগ্রামে কয়েকদিন থেকে কয়েকটি কাজ করি। এরপর নোয়াখালী কয়েকটা, ফেনী কয়েকটা এভাবেই যেতে যেতে কাজ করে থাকি। এবার চট্টগ্রামে এসেছিলাম ২২ জানুয়ারি। ২৬ তারিখ আকবরশাহ এলাকায় একটি দোকানে চুরি করে দুইটা মোবাইল পাই। সেগুলো রেয়াজউদ্দিন বাজার বিক্রি করে দেই। ৩১ জানুয়ারি লাভলেইন একটি বাসায় চুরি করি। ৩ ফেব্রুয়ারি চেরাগী পাহাড় এলাকায় একটি দোকানে চুরি করি। ৪ তারিখ পাঁচলাইশ থানা এলাকায় এক প্রবাসীর বাসায় এবং একটি ক্যান্টিনে চুরি করি। চোরাই স্বর্ণ আগে বিক্রি করতাম বাড়ির পাশে এক স্বর্ণকারের কাছে। কিছুদিন আগে সে গ্রেপ্তার হওয়ায় বিপাকে পড়ে যাই। ২০১৮ সালে হাটহাজারী থেকে স্বর্ণ ও টাকা চুরি করে চট্টগ্রাম আসার সময় আকবরশাহ থানা পুলিশের হাতে ধরা পড়ি। বের হয়ে ভেবেছিলাম ভালো হয়ে যাবো। কিন্তু মামলার হাজিরা দেওয়ার টাকা যোগাড় করতে কষ্ট হতো। তা ছাড়া ততদিনে ইয়াবা আসক্ত হয়ে পড়েছিলাম। ইয়াবা সংগ্রহ করি রেয়াজউদ্দিন বাজারের ইয়াবা ব্যবসাযী মিজান ও সেলিমের থেকে। এরও একটা খরচ আছে। ভালো হওয়া হলো না আমার আর।
দাঁতে কেটে বুঝতে পারে স্বর্ণ বা ইমিটেশন : ওসি জানান, শফিকুল চুরি করার সময় স্বর্ণালংকার পেলে তা দাঁতে কামড় দিয়ে, আগুন লাগিয়ে টেস্ট করে দেখে আসল স্বর্ণ কিনা। আসল স্বর্ণ মনে হলে সাথে সাথে নিয়ে নেয়। ইমিটেশন মনে হলে সেটা ফেলে দেয়। গত ৪ তারিখ পাঁচলাইশে এক প্রবাসীর তিন তলা বাসায় চুরির পর প্রায় ২০ ভরি স্বর্ণালংকার পেয়েছিল। তার মধ্যে অনেকগুলো পাশের ড্রেনে ফেলে দিয়েছে স্বর্ণ মনে না হওয়ায়। তার নিকট থেকে পাওয়া স্বর্ণালংকার পাঁচলাইশ থানা এলাকা হতে চুরি করা স্বর্ণালংকার বলে সে স্বীকার করে। সে ওই বাসায় থাকা ভাত তরকারি খাওয়ার পর চা বানিয়েও খায়।
ইয়াবার আসক্তি মেটাতে গিয়ে বিক্রেতা : শফিকুল জানায় প্রথম দিকে সে অর্ধেক করে ইয়াবা ট্যাবলেট সেবন করতো। এখন দৈনিক ১০/১৫টি লাগে তার একার। ইয়াবা কিনতে গিয়ে সে দেখে যে ৫০ টাকার মাল বিক্রি করা হচ্ছে ১৫০ টাকায়। তখন থেকে সে ইয়াবা ব্যবসা শুরু করে মিজানের থেকে নিয়ে। একেকবার ৫০০ করে নিয়ে যায়। নিজেও খায়, অন্যের কাছে বিক্রিও করে। গ্রেপ্তারের সময়ও তার কাছে প্রায় ৫০০ পিস ইয়াবা পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।