ঘরের সকল কাজে নারীর পাশাপাশি পুরুষদেরও হাত লাগাতে হবে

ডেইজী মউদুদ | শনিবার , ২৮ জুন, ২০২৫ at ১২:০৯ অপরাহ্ণ

আমাদের সমাজে জেন্ডার বৈষম্য চিরাচরিত ঘটনা। সমাজ নারীদের কঠিন বিভাজনে আটকে দিয়ে নারীকে কেবল ঘরকন্না, সন্তান ধারণ, জন্মদান লালনপালন এবং যাবতীয় সাংসারিক কায়িক পরিশ্রমের দায়িত্ব দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, নারীর জন্মই যেনো এই কাজের জন্য তা চিরদিনের জন্য পোক্ত করে রেখেছে। একটি সময় ছিল, তখন সেটি ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় নারীদের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল। কিন্তু কালক্রমে নারী যখন ঘরের চার দেয়াল থেকে বের হওয়ার সুযোগ পেলো, তখন সে লেখাপড়া করলো, শিক্ষা দীক্ষায় নিজেকে এগিয়ে নিয়ে পুরুষের পাশাপাশি নানা সাফল্য আর অর্জনের মুকুট মাথায় পড়লো, তখন তার সত্যিকারের অধিকার আর মর্যাদা কি? অর্থাৎ আত্মসম্মান বোধ কি? তা নারীর চেতনা আর শিরা উপ শিরায় জাগ্রত হলো। সে কথা বলতে শিখলো। নিজে শিখলো, শিখালো পিছিয়ে পড়া নারীদেরও। কিন্তু আমরা বাস্তবে কি দেখি! বাস্তবতা অত্যন্ত নির্মম এবং মোটেও নারীবান্ধব না। আমরা শিশুকালে দেখেছি, ঘরে বাইরে ছেলেমেয়ে বৈষম্য। ছেলেরা বাইরে খেলাধুলা করবে, বিলেঝিলে পুকুরে হাটে মাঠে বাটে ঘুরবে, আর মেয়েরা পুতুল খেলবে, রান্নাবাটি খেলবে, তাও ঘরের চৌহদ্দীর বাইরে নয়। স্কুলে ও কো এডুকেশনে মেয়েরা থাকবে কমন রুমে। স্যারের পেছনে পেছনে ক্লাসরুমে যাবে, আবার ক্লাস শেষ করেই বের হয়ে যাবে। অন্যদিকে মা বাবার চিন্তা কিভাবে তাড়াতাড়ি মেয়েকে পাত্রস্থ করে চিন্তামুক্ত হবেন। এই অবস্থায় মেয়ে শিশুরা অনেক বঞ্চিত হয়। তারা তাদের মেধা আর প্রজ্ঞার সঠিক বিকাশ করতে পারে না। এক নেতিবাদক মানসিকতা আর দুর্বলচিত্ত নিয়ে স্বামীর বাড়ি গিয়ে আরো দমন পীড়ন আর যাতনার শিকার হয়। সেই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার গ্যাড়াকলে পড়ে নারীদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়ে। এখন সেই চিত্র কিছুটা কমেছে বটে, তবে পূর্ণ মর্যাদা আর সম্মান নারী পাচ্ছে বলে মনে হয় না। সে পেশাজীবী হোক আর, সাধারণ গৃহিণীই হোক। এর জন্য আমরা দায়ী। আমরা নিজেরাই আমাদের ছেলেমেয়েকে কাজ করতে দিইনি। আমাদের উচিত ছিল, উভয়কে দিয়ে ঘরের কাজকর্ম শেখানোর।

আমি ৮৫ সালে শ্বশুরবাড়িতে আসি। আমার ভাসুর ড. মাহমুদুল আলম সদ্য বিলেত ফেরৎ একজন আধুনিকমনস্ক ব্যক্তি ছিলেন। তিনি বলেন, ফ্রাইডে ছুটির দিন। আজ মেয়েরা বসে থাকবে, টিভি দেখবে, গল্প করবে। আমরা ছেলেরা বাজার করবো, রান্না করবো। এই কথায় আমি অবাক হয়েছিলাম, বিস্মিত হয়েছিলাম রীতিমতো। যাক, সে দিন গড়িয়েছে চার দশক হলো। নারীরা রয়ে গেলো একই জায়গায়। আমি এখনো দেখছি আমার চারপাশে, এমনকি আমার নিজের ঘরের মানুষটিও ভাবেন, তিনি পুরুষ, তাই গৃহস্থালির কোনো কাজ ওর না। তবে আমি পঞ্চব্যাঞ্জন রান্না করে ওর পাতে তুলে দেবো, বেড়ে খাওয়াবো আমি না পারলেও,আমি সেই নারী না। যখন বয়স কম ছিল, তখন একআধটু হয়তো বা দিয়েছিলাম, তবে অনেকদিন সেটি হয়নি। কারণ আমি সংবাদপত্রে রাতের শিফটে কাজ সেরে যখন ফিরি তখন বাসার সকলে খেয়েদেয়ে ঘুমের দেশে থাকতো। এজন্য আমি গরম গরম বেড়েধরে খাওয়াবো, সেই আশা বা অভ্যাস ছিল না। কিন্তু কষ্ট লাগে যখন আমার সত্তরোর্ধ ঘনিষ্ঠজনকে দেখি, বাজার করা থেকে রান্নাবান্না করা, আবার নরম নরম গরম রুটি বানিয়ে ব্রেকফার্স্ট রেডি করে দিতে। আমার অনেক বন্ধুকেও দেখেছি, একটি রুটি সেঁকবে, সেটি গরমগরম খাওয়াবে স্বামীকে। অনেক ঘরেই আছে রেওয়াজ টি। এবার স্বামী স্ত্রীর কথায় আসি। আমি খুব খুব আধুনিক এবং প্রগতিশীল পুরুষকে দেখেছি, স্ত্রীটি যেনো, ওর কেনা পণ্য। ওর কথার বাইরে যাওয়া তো দূরের কথা, ওর স্বাদ আহ্লাদ, পূরণ করে রুটিন মাফিক জীবনযাপন যেনো স্ত্রীর একমাত্র ব্রত! স্ত্রী নামের এই মানবীটি কি চায়, সে কিসে আনন্দ পায়, এসব খুব কমজনই ভাবেন। ঘরের কাজে সাহায্য তো করেন ইনা,অনেকে মানসিক যাতনায় ও অতিষ্ঠ করে ফেলে জীবন। একসময়ে ভালোবেসে প্রেমে ভরপুর থাকা মানুষটিও দেখি এই জায়গায় আমূল বদলে যান। জীবন কতো ছোট। অথচ এই জীবনে নারী আর পুরুষ মিলে সংসারী। আমরা দেখছি পরিবার থেকে সমাজ, তথা দেশ থেকে উপমহাদেশ জুড়ে যেনো একই অবস্থা বিদ্যমান। এই থেকে মুক্তির কি উপায়? আমাদের সন্তানদেরকে প্রতিটি কাজের সাথে সম্পৃক্ত করতে হবে

ঘরের কাজে নারী পুরুষ, কন্যা পুত্র বলে কোনো বিভাজন থাকবে না। ছোট্টবেলা থেকেই মা কিংবা নানী দাদীর সাথে গেরস্থালি কাজে অংশগ্রহণ করাতে হবে। বাজার করা, কাটাকুটি, ঝাড়ামোছা, কাপড় কাঁচা, নিজের কাজগুলো গুছিয়ে রাখা এসব শিক্ষা দিতে হবে। রান্না করাটাও শিখে নেয়া জরুরি। এই কাজগুলো একজন ছেলে সন্তানের জন্য যে কোনো অসম্মানের কাজ না, তা পিতামাতাকেই নিজেদের কাজের মধ্য দিয়ে সন্তানকে বুঝিয়ে দিতে হবে। তবেই সে বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে, ভালোবেসেই কাজ করবে, কাজ করতে ভালোবাসবে। এবং একদিন বড় হয়ে সে তা নিজের সংসারে এমন কি কর্মক্ষেত্রেও প্রয়োগ করবে। এতে করে সংসারের কর্ত্রী কিছু সুখ পাবে। আর পুরুষটিও মানসিক তৃপ্তি পাবে, কায়িক পরিশ্রমের জন্য থাকবে শারিরীকভাবে সুস্থ। আসুন, সংসারের ছোটখাট সব কাজে আমরা নারী পুরুষ ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে কাজ করি মিলেমিশে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমেয়েদের খৎনা: একটি অমানবিক প্রথা
পরবর্তী নিবন্ধবাঁশখালীতে কৃষকের মাঝে বীজ ও সার বিতরণ