নিবন্ধিত বা অনিবন্ধিত মাল্টিপারপাস কো–অপারেটিভ সমিতি (এমএলএম) ও সমবায় সমিতির নামে চলছে মহাপ্রতারণা। অবৈধভাবে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা ও সাধারণ মানুষের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহে এক শ্রেণীর প্রতিষ্ঠান প্রতারণা করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়াই উচ্চ মুনাফার লোভ দেখিয়ে এসব প্রতিষ্ঠান গ্রাহকদের কাছ থেকে শত শত কোটি টাকা আমানত সংগ্রহ করে নিজেদের অন্য ব্যবসায় বিনিয়োগ করছে। গ্রাহকদের ফতুর করে এসব সমিতি কোনো কোনো ক্ষেত্রে লাপাত্তাও হচ্ছে। ফলে গ্রাহকের চোখের পানি থামছে না। চট্টগ্রামে এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১০ হাজারের অধিক। এর মধ্যে বেশিরভাগই আবার অনিবন্ধিত। চট্টগ্রাম জেলায় মোট নিবন্ধিত ৩ হাজার ২৩৬টি সমবায় সমিতির মধ্যে মহানগরীতে ১ হাজার ৪৫১টি, এর মধ্যে শুধু ইপিজেড, বন্দর এলাকাতেই রয়েছে ৮৬৪টি সমিতি। এসব সমিতির মধ্যে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান বিশেষ অঞ্চলকে টার্গেট করে সেখান থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ তুলে গা–ঢাকা দেয়। নামমাত্র অভিযোগ থানায় গড়ালেও সমবায় কর্মকর্তাদের নজরদারি না থাকায় দেদারছে চলছে এমন সুদের কারবার।
জেলা সমবায় কর্মকর্তা মুরাদ আহম্মদ বলেন, সমবায় আইন অনুযায়ী সমিতিগুলোর ব্যাংকিং করার সুযোগ নেই। তবে সমবায় বিধিমালায় সদস্যদের মধ্য থেকে স্থায়ী আমানত সংগ্রহ করার সুযোগ রয়েছে। ওই বিধিমালা ব্যবহার করে বিভিন্ন সমিতি এই ব্যাংকিং কাজ করে। শিগগির এই বিধিমালায় সংশোধনী আনা হচ্ছে।
সমবায় কার্যালয়ের তথ্য বলছে, গেল কয়েক বছরে শুধুমাত্র নগরীর ডবলমুরিং জোন থেকেই উধাও হয়েছে অন্তত ১৩৭টি সমবায় সমিতি। প্রসঙ্গত, সমবায় সমিতি আইন–২০০২ অনুযায়ী সমবায় সমিতি ব্যাংকিং করতে পারবে না। কিন্তু এসব বিষয়ে কেউ দৃশ্যমান পদক্ষেপ না নেয়ায় তারা বেপরোয়া।
নগরীর ইপিজেড থানার বিপরীতের ১নং নেভী ওয়েলফেয়ার মার্কেটে একতা শ্রমজীবী কো–অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড নামে একটি সমবায় সমিতির মালিক মো. রাসেল গ্রাহকের অন্তত দুই কোটি টাকা মেরে লাপাত্তা হয়ে যান। সমিতির লাইসেন্সও তার নামেই করা। মূলত গার্মেন্টস শ্রমিক এবং নিম্ন আয়ের মানুষকে টার্গেট করে এই সমিতি থেকে ঋণ দেওয়ার কথা বলে টাকা নিয়েছে। এর আগেও অর্ধশতাধিক প্রতিষ্ঠান হাজার হাজার গ্রাহকের আমানত ফেরত না দিয়ে ইপিজেড এলাকা থেকে কার্যক্রম গুটিয়ে নিয়েছে।
নগরীর কোর্ট বিল্ডিং এলাকায় আছে ৫০টিরও বেশি মাল্টিপারপাস বহুমুখী কিংবা মাল্টিপারপাস কো–অপারেটিভ সোসাইটি। তারা সেখানে সমিতি নামেই পরিচিত। রুবেল নামে এক দোকান কর্মচারী জানান, পেশকার, বিভিন্ন ভেন্ডার ও কোর্টের বিভিন্ন কর্মকর্তা–কর্মচারীরা আমানত জমা দেন সমিতির মাঠকর্মীদের হাতে। নামমাত্র অল্প বেতনে মাঠকর্মীরা এসব প্রতিষ্ঠানে চাকরি করলেও মূল নেপথ্যে থাকে প্রতারকরা। এভাবে শুধু কোটি টাকার আমানত সংগ্রহ করা হচ্ছে।
দক্ষিণ মধ্যম হালিশহরের ১ নম্বর সাইট হিন্দু পাড়া এলাকার ‘অনস্টেইজ’ উধাও হয়ে যাওয়ার পর সেখানে টাকা জমা রাখা অনেকেই মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে। অসুস্থ হয়ে মারা যাওয়ার মতো ঘটনাও আছে। ১২ সদস্যের এ সমিতির গ্রাহক ২ হাজার ১০৬ জন। জানা গেছে, স্বল্প সঞ্চয়ে ঋণ দেওয়ার নামে এবং আকর্ষণীয় সুদ দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে চট্টগ্রামের গার্মেন্টস শ্রমিক, গৃহিণীসহ সকল শ্রেণিপেশার মানুষ থেকে তারা এককালীন বিশাল অংকের টাকা আমানত সংগ্রহ করেছিল। শুধু এ সমিতি নয় ওই এলাকায় রয়েছে আরও ১৭টি নিবন্ধিত সমিতি। এসব সমিতি নিয়েও শঙ্কায় সদস্যরা।
চট্টগ্রামের যেসব এলাকায় মাল্টিপারপাসের আধিক্য বেশি : নগরীর ৪১ ওয়ার্ডের মধ্যে মাল্টিপারপাস বেশি ইপিজেড, উত্তর ও দক্ষিণ কাট্টলী, হালিশহর, পতেঙ্গা, বাকলিয়া, চকবাজার, কোর্ট বিল্ডিং এলাকা, কাজির দেউড়ি, দেওয়ান বাজার, আমবাগান, ঝাউতলা, পাহাড়তলী, খাতুনগঞ্জ, তুলাতলী এবং পাথরঘাটাসহ নগরীর বিভিন্ন শ্রমিক অধ্যুষিত এলাকায়। সরকারি আইনে তফসিলি ব্যাংক ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠানের ব্যাংকিং লেনদেন নিয়মনীতি না থাকলেও এসব এলাকায় ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়েছে মাল্টিপারপাস।
যারা টার্গেট : নগরীর অধিকাংশ শ্রমজীবী ও নিম্নবিত্তের মানুষ তাদের কষ্টার্জিত আয়ের একটি অংশ গচ্ছিত রাখছে মাল্টিপারপাসে। ব্যাংকের চাইতে বেশি সুদের লোভ দেখিয়ে ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের টাকা আত্মসাত করতে হকার, রিকশা চালক, রাজমিস্ত্রি, বস্তির বাসিন্দারা টার্গেট মাল্টিপারপাস নামক সমিতিতে।
যেভাবে ফাঁদ পেতে সদস্য সংগ্রহ : ৮–১০ সদস্যের পরিচালনা কমিটিতে স্থানীয় মাস্তান, উঠতি বিত্তবান, পাতি নেতাসহ বিভিন্ন পেশার লোকদের নাম দিয়ে প্রতারক চক্র প্রথমে দোকান কিংবা কোনো ভবনে প্রতিষ্ঠান চালু করে। এরপর নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি সাঁটিয়ে চলে চাকরি বাণিজ্য। চাকরি দেয়ার কথা বলে মাঠ পর্যায়ে কর্মী নিয়োগ দেয়। তাদের মাধ্যমে বিভিন্ন বস্তি এলাকার দোকানদার, বুয়া, হকার, ভিক্ষুক, প্রতিবন্ধী, ফুটপাতের দোকানিদের সদস্য করে আমানত সংগ্রহ করে। এরপর ঋণের লোভ দেখিয়ে সঞ্চয় বাড়াতে থাকে। তারপর চলে ডিপিএসসহ বিভিন্ন হিসাব খোলার লোভ দেখানো।
অবৈধ ব্যাংকিং কার্যক্রম চলছে শরিয়াহভিত্তিক প্রচারে : শরিয়াহভিত্তিক বিভিন্ন স্কিমের প্রচারণা দিয়েও চলছে বিশেষ সঞ্চয়ের নামে হিসাব খোলানোর প্রতারণা। ডিপোজিটের লোভ দেখিয়ে শ্রমজীবী মানুষকে পেনশন, মুদারাবা, কোটিপতি স্কিমের প্রলোভন দেখিয়ে ব্যাংকিং কার্যক্রম করছে ব্যাপকভাবে। ব্যাংকের চাইতে বেশি আমানতে বেশি সুদ এবং ঋণের সহজলভ্যতার কথা বলে তারা প্রতারণা করে হাতিয়ে নিচ্ছে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা।
শুভঙ্করের ফাঁকিতে চলছে সুদের ব্যবসা : সমবায়ের নিবন্ধন নিয়ে ক্ষুদ্র ঋণের নামে সাধারণ মানুষ থেকে গলাকাটা হারে চলছে সুদের ব্যবসা। লাখ টাকার ঋণ দিয়ে ১০ হাজার টাকার বেশি সুদ নিচ্ছে এসব মাল্টিপারপাস। এদিকে সুদ পরিশোধে সঞ্চয় করা টাকাও খোয়াচ্ছেন শ্রমজীবী সঞ্চয়কারীরা। স্বল্প সুদের অল্প সময়ের কথা বলে প্রতিদিন সুদ পরিশোধে বাধ্য করছে এসব প্রতিষ্ঠান।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের নীতিমালায় উল্লেখ করেছে তালিকাভুক্ত তফসিলি ব্যাংক ও তাদের শাখা ছাড়া এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যাংকিং কার্যক্রম অননুমোদিত। যা সম্পূর্ণভাবে বাংলাদেশে অবৈধ। এনজিও হিসেবেও এসব মাইক্রো–ক্রেডিট রেগুলেটরি আর্থিক লেনদেনের জন্য অবৈধ।
এদিকে প্রতিদিনই নগরীর কোনো না কোনো এলাকায় প্রতারক সমবায় সমিতির ফাঁদে পড়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। এ বিষয়ে প্রশাসনকে ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানিয়েছেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সাবেক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন।