চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের মাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এসএসসি) পরীক্ষায় এবার (২০২৩) মহানগরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থীদের তুলনায় ৭ দশমিক ৩৩ শতাংশ কম পাস করেছে চট্টগ্রামের ১৫ উপজেলার শিক্ষার্থীরা। এর আগে ২০২২ সালে এ ব্যবধান ছিল ৬ দশমিক ৫৭ শতাংশ। অর্থাৎ ফলাফলের দিক দিয়ে নগরের চেয়ে মফস্বলের শিক্ষার্থীরা কেবল পিছিয়ে নেই, বরং পিছিয়ে থাকার এ ব্যবধান বাড়ছে। শুধু পাসের হারেই মফস্বল পিছিয়ে নেই; জিপিএ–৫ অর্জনের ক্ষেত্রেও এগিয়ে আছে নগর। এমনকি জিপিএ–৫ এর ভিত্তিতে প্রস্তুতকৃত শীর্ষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তালিকায়ও পিছিয়ে আছে মফস্বল। শুধুমাত্র শতভাগ পাস করেছে এমন স্কুলের তালিকায় এগিয়ে আছে মফস্বল।
সরকারের নানা উদ্যোগ ও উপজেলা পর্যায়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সুযোগ–সুবিধা বৃদ্ধির পরও মফস্বলের শিক্ষার্থীদের পিছিয়ে পড়া নিয়ে ভাবাচ্ছে শিক্ষাবিদদের। বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন স্থানীয় অভিভাবকরাও। তবে এ পিছিয়ে পড়ার কারণ হিসেবে শিক্ষাবিদরা মনে করেন, গ্রামে দক্ষ শিক্ষকের অভাব রয়েছে। আছে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক সংকট। উপজেলার বহু স্কুল রয়েছে যেখানে এক শিক্ষক একাধিক বিষয়ের ক্লাসও নিয়ে থাকেন। যেমন যিনি বাংলা পড়ান তিনি আবার ইংরেজি ও গণিতের ক্লাসও নিয়ে থাকেন। তাছাড়া শহরের স্কুলগুলোতে অপেক্ষাকৃত মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা ভর্তি হয়ে যায়। শিক্ষার্থীদের জন্য বিদ্যমান বা নিত্যনতুন সুযোগ–সুবিধাগুলোরও বেশিরভাগ নগরকেন্দ্রিক চিন্তা থেকে করা হয় বেশিরভাগ সময়। পক্ষান্তরে মফস্বলের স্কুলগুলোতে অপেক্ষাকৃত কম মেধাবীরা ভর্তি হয়ে থাকে। সুযোগ সুবিধাও কম। দক্ষ শিক্ষকরাও শহরমুখী। সবমিলিয়ে নানা সংকটের কারণে বরাবরই পিছিয়ে থাকছে মফস্বল। তাছাড়া তুলনামূলকভাবে শহরের চেয়ে গ্রামের শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞানে পিছিয়ে থাকে। যার প্রভাব পড়ে সামগ্রিক রেজাল্টে।
চট্টগ্রাম মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নারায়ণ চন্দ্র নাথ সাংবাদিকদের বলেন, সাধারণ গণিতে সার্বিকভাবে পরীক্ষার্থীরা খারাপ করেছে। ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রে তেমন খারাপ করেনি, তবে আরও ভালো হলে পাসের হার বাড়তো। গণিত ও ইংরেজির ক্ষেত্রে আমাদের মূল্যায়ন হচ্ছে, স্কুলে পর্যাপ্ত সংখ্যক বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নেই। বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ করে মানসম্মত পাঠদানের বিকল্প নেই।
পাসের হার বিশ্লেষণ : এবার (২০২৩) চট্টগ্রাম মহানগরে পাসের হার ৮৫ দশমিক ৪৩ শতাংশ। যা গতবার (২০২২) ছিল ৯৪ দশমিক ২১ শতাংশ। অর্থাৎ গতবারের চেয়ে এবার নগরে পাসের হার কমেছে ৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ। এবার মহানগর বাদে জেলায় পাশের হার ৭৮ দশমিক ১০ শতাংশ। যা ২০২২ সালে ছিল ৮৭ দশমিক ৬৪ শতাংশ। অর্থাৎ গতবারের তুলনায় এবার মফস্বলে পাসের হার কমেছে ৯ দশমিক ৫৪ শতাংশ।
গত কয়েক বছরের ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০২১ সালে চট্টগ্রাম মহানগরে পাসের হার ছিল ৯৪ দশমিক ২১ শতাংশ। একই বছর জেলায় পাসের ছিল ৯১ দশমিক ০১ শতাংশ। অর্থাৎ পাসের হারে ২০২১ সালে মফস্বলের চেয়ে ৩ দশমিক ২ শতাংশে এগিয়ে ছিল নগর। এর আগে ২০২০ সালে নগরের বাইরের স্কুলগুলোতে পাসের হার ছিল ৮৫ দশমিক ১৪ শতাংশ। একই বছর নগরে পাসের হার ছিল ৯০ দশমিক ৩৪ শতাংশ। অর্থাৎ ২০২০ সালে মফস্বলের চেয়ে নগরের পাসের ৫ দশমিক ২ শতাংশ বেশি ছিল।
জিপিএ–৫ এর হার : চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডে এবার জিপিএ– ৫ পেয়েছে ১১ হাজার ৪৫০জন শিক্ষার্থী। এরমধ্যে শুধু চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী আছেন ৬ হাজার ৭৬০জন। বিপরীতে চট্টগ্রামের ১৫ উপজেলার শিক্ষার্থী আছেন ২ হাজার ৮২৫ জন। অর্থাৎ নগরের চেয়ে ৩ হাজার ৯৩৫ জন শিক্ষার্থী কম জিপিএ–৫ পেয়েছে মফস্বলে। এছাড়া জিপিএ–৫ পাওয়া ভিত্তিতে বোর্ডের প্রস্তুতকৃত সেরা ১০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৯টিই নগরের।
তিন পার্বত্য জেলার অবস্থাও খারাপ : চট্টগ্রাম মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের অধীন পাঁচটি জেলার (চট্টগ্রাম, কঙবাজার, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান) এসএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। গত বছর (২০২২) এই পাঁচ জেলার মধ্যে তিন পার্বত্য জেলার ফলাফল পিছিয়ে ছিল। গতকাল প্রকাশিত ফলাফলেও দেখা গেছে একই চিত্র। অর্থাৎ এবারও বোর্ডের মধ্যে বেশি খারাপ করে তিন পার্বত্য জেলা।
চট্টগ্রাম বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, এবার বোর্ডে ফলাফলে পিছিয়ে আছে রাঙামাটি জেলা। এ জেলায় পাসের হার ৬৭ দশমিক ৯২ শতাংশ। যা ২০২২ সালে ৮১ দশমিক ৬০ শতাংশ এবং ২০২১ সালে ছিল ৮৬ দশমিক ৮৩ শতাংশ। এবার খাগড়াছড়ি জেলায় পাসের হার হচ্ছে ৬৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ। যা ২০২২ সালে ৭৫ দশমিক ৮৭ শতাংশ এবং ২০২১ সালে ছিল ৮৪ দশমিক ১৯ শতাংশ। বান্দরবান জেলায় এবার পাসের হার হচ্ছে ৭০ দশমিক ৩০ শতাংশ। যা ২০২২ সালে ৭৮ দশমিক ৩৬ শতাংশ এবং ২০২১ সালে ছিল ৯০ দশমিক ৮৬ শতাংশ।
এছাড়া কঙবাজার জেলায় এবার পাসের হার হচ্ছে ৭৭ দশমিক ২৫ শতাংশ। যা গতবার ছিল ৮৮ দশমিক ৪৫ শতাংশ। এর আগে ২০২১ সালে এ পাসের হার ছিল ৯০ দশমিক ৯৪ শতাংশ। চট্টগ্রাম জেলায় পাসের হার ৮০ দশমিক ৬৫ শতাংশ। যা গতবার ছিল ৮৯ দশমিক ১১ শতাংশ।
শতভাগ পাস করা স্কুল মফস্বলে বেশি : বোর্ডে এবার শতভাগ পাস করেছে এমন স্কুলের সংখ্যা ৪৫টি। এর মধ্যে মফস্বল এলাকায় অবস্থিত স্কুল আছে ২৫টি। বাকি ২০টির অবস্থান নগরের। অর্থাৎ শতভাগ পাস করেছে এমন স্কুলের সংখ্যা মফস্বলেই বেশি। এর আগে ২০২২ সালে চট্টগ্রাম বোর্ডে শতভাগ পাস করে ৭১টি স্কুলের শিক্ষার্থীরা। এর মধ্যে মফস্বল এলাকায় অবস্থিত স্কুল ছিল ৪০টি। অর্থাৎ গতবারও শতভাগ পাস করেছে এমন স্কুল মফস্বলে বেশি ছিল।