গ্রামীণ সড়ক উন্নয়ন ও গ্রামীণ বাস্তবতা

মো. দিদারুল আলম | মঙ্গলবার , ১৮ এপ্রিল, ২০২৩ at ৫:৩৫ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশে বিদ্যমান স্থানীয় সরকার কাঠামোর মধ্যে গ্রামীণ পর্যায়ে স্থানীয় সরকারের ৩ টি স্তর রয়েছে। স্তরসমূহের মধ্যে সর্বনিম্নের স্তর ইউনিয়ন পরিষদ, মাঝখানে উপজেলা পরিষদ এবং সর্বোচ্চ স্তরে জেলা পরিষদের অবস্থান। স্থানীয় সরকারের এ সবগুলো পরিষদ জনগণের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত পরিচালিত হয়ে থাকে। স্থানীয় সরকারের প্রতিটি স্তর নিজস্ব আয় দ্বারা পরিচালিত হওয়ার কথা। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহের অন্যতম কাজ হচ্ছে গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন।

আমার গ্রাম, আমার শহর’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকার। এ রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির কারণে গ্রামের অধিবাসীদের প্রত্যাশাও অনেক বেড়েছে। গ্রামীণ যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে এলজিইডি বড় প্রকল্পগুলো গ্রহণ করে থাকে। এলজিইডির আইডিভূক্ত গ্রামীণ সড়ক, ইউনিয়ন সড়ক এবং উপজেলা সড়কসমূহ সাধারণত এলজিইডি উন্নয়ন করে থাকে। অবশ্য কিছু রাস্তা সড়ক বিভাগ কর্তৃক উন্নয়ন করা হয়। এর বাইরে ছোট খাটো গ্রামীণ ফিডার রাস্তাগুলো জনগণের নির্বাচিত পরিষদসমূহের মাধ্যমে ছোট ছোট প্রকল্প গ্রহণ করে উন্নয়ন করা হয়ে থাকে। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহ এবং এলজিইডি সাধারণত জমি অধিগ্রহণ করে ক্ষতিপূরণ প্রদানপূর্বক রাস্তা নির্মাণ করে না বরং বর্তমানে বিদ্যমান রাস্তাসমূহের উন্নয়ন করে থাকে। তবে বর্তমানে এলজিইডি বিশেষ কোনো কোনো প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনে ভূমি অধিগ্রহণ করছে।

স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহ গ্রামীণ রাস্তাসমূহ ব্রিক সলিং, এইচবিবি, সিসি, আরসিসি দ্বারা ড্রেনসহ বা ড্রেন ব্যতীত উন্নয়ন করে থাকে। চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ এর মাধ্যমে টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে থাকে। ঠিকাদার যখন কার্যাদেশ নিয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে সরেজমিন উপস্থিত হয় তখনি শুরু হয় নানা নাটকীয়তা। ঠিকাদারের স্বাভাবিক প্রবণতা যত বেশি লাভ করা যায় আবার স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মকর্তা ও প্রকৌশলীদের প্রবণতা যত কম সময়ে প্রকল্পটি প্রাক্কলন অনুযায়ী গুণগতমান ঠিক রেখে আদায় করা যায়। অন্যদিকে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিগণের প্রবণতা থাকে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে জনপ্রিয়তা কীভাবে বাড়ানো যায়। সাধারণ জনগণের মাঝে এ ধরনের প্রকল্প ঘিরে ভাবনা চিন্তা জনে জনে আলাদা। এ আলাদা চিন্তা ভাবনাগুলোর মধ্যে একটি কমন চিন্তা হলো রাস্তাটি যেন তার বাড়ি বা মালিকানাধীন জায়গা পর্যন্ত যায়। ঠিকাদারদের বক্তব্য শুনলে মনে হবে তারা জীবনে কখনো লাভের মুখ দেখেনি আর সব সময় তাদের নানা কারণে প্রাক্কলনের অতিরিক্ত কাজ করতে হয়েছে। তবে জীবনে কখনো লাভ না করতে পারার কথা বললেও তাদের পেশাটি খুব কম ক্ষেত্রে পরির্বতন করতে দেখা যায়। এমনকি অনেকের পরবর্তী প্রজন্মকেও এ পেশায় যোগ দিতে দেখা যায়।

সিসি বা আরসিসি দ্বারা সড়ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে ককশিট ব্যবহার করে এক্সপানশন জয়েন্ট রাখা হয়। গরমের দিনে অধিক তাপে রাস্তা সমপ্রসারণের সুযোগ এবং শুধুমাত্র রাস্তাটির ভাঙা অংশের সেকশনটি কেটে ভবিষ্যতে রাস্তা মেরামত করার স্বার্থে এক্সপানশন জয়েন্টগুলো রাখা হয়। সচরাচর দেখা যায় সাধারণ লোকজন ককশিট ব্যবহারে বাধা প্রদান করে থাকে। তাদের ধারণা এর মাধ্যমে ঠিকাদার কাজে অধিক লাভের চিন্তা করছেন। স্থানীয় জনসাধারণ সাধারণভাবে যে কোনো রাস্তা সিসি করার চেয়ে আরসিসি করার জন্য অনুরোধ বেশি করে থাকে, সবক্ষেত্রে আসলে আরসিসির প্রয়োজন হয় না। যেহেতু স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহ স্বল্প বাজেটে গ্রামীণ রাস্তাসমূহ উন্নয়ন করে তাই বরাদ্দকৃত বাজেটের মধ্যে যেক্ষেত্রে ভারী যানবাহনের চাপ নেই সেক্ষেত্রে সিসি দ্বারা সড়ক উন্নয়নকে যৌক্তিক মনে করে। যেসব রাস্তায় শুধুমাত্র রিকশা, অটো রিকশা, সিএনজি, ভ্যান ও প্রাইভেট কারের মত যানবাহনগুলো চলাচল করে সেসব রাস্তা সিসি দ্বারা উন্নয়ন করলে স্বল্প বরাদ্দ দিয়ে আরসিসির চেয়ে অধিক দৈর্ঘ্যের রাস্তার উন্নয়ন কাজ করা সম্ভব হয়।

বর্তমানে গ্রামীণ জনসাধারণের মাঝে অন্য একটি প্রবণতা প্রায় লক্ষ্য করা যায় তা হলো রাস্তার যে অংশে তাদের নিজেদের মালিকানাধীন সেদিকে সমপ্রসারণ না করে বিপরীত দিকে যেন রাস্তাটি সমপ্রসারণ করা হয় অর্থাৎ উন্নয়ন আমার খুব প্রয়োজন তবে আমার মালিকানাধীন জায়গা যেন উন্নয়ন কাজে ব্যবহৃত না হয়। অনেক এলাকায় রাস্তা করতে গিয়ে উদ্ভূত ঝামেলা থেকে ফৌজদারি মামলা মোকদ্দমা রুজু হওয়ার মতো ঘটনাও ঘটছে। এসব কারণে প্রকল্প বাস্তবায়ন বিলম্ব হওয়াসহ প্রকল্প বাতিল হওয়ার মতো ঘটনাও কম নয়। অনাদিকাল হতে যে জায়গা দিয়ে পানি প্রবাহিত হতো সে জায়গাটাও নতুন করে সড়ক উন্নয়নের সময় বন্ধ করে দেওয়ার উপক্রম হতে দেখা যায়। কিছু কিছু সড়ক উন্নয়নে গাছের শিকড়, দেয়াল, বেড়া ইত্যাদি নানা প্রতিবন্ধক হিসেবে দেখা যায়। এ প্রতিবন্ধকতাগুলো অপসারণে ঘটে নানা বিপত্তি। মালিক পক্ষ সড়কের স্বার্থে অনেক সময় এগুলো নিজ দায়িত্বে অপসারণ করে দেয় তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এ অপসারণে স্থানীয় জনসাধারণের বাধার মুখে পড়তে হবে। সড়কের দুইদিকে শোল্ডারিংয়ের জন্য কিছু মাটি কেটে দিতে হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এ মাটি কাটতে বিপত্তির মুখে পড়তে হয়।

নোয়াখালী জেলায় চাটখিল উপজেলার উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে কর্মকালের একটি অভিজ্ঞতার কথা এখানে আলোকপাত করতে চাই। আমার কর্মকালে চাটখিল উপজেলা পরিষদ হতে ২ লক্ষ টাকা বরাদ্দ দিয়ে সড়ক উন্নয়নের একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল। হঠাৎ করে একদিন চাটখিল থানার অফিসার ইনচার্জ ফোন করে আমাকে জানান, আপনাদের উপজেলা পরিষদের একটি রাস্তা করার জন্য গতরাত্রে এক ব্যক্তির মালিকানাধীন জায়গা হতে প্রায় ১০০ টির মতো ছোট ও মাঝারি সাইজের গাছ কেটে ফেলা হয়। পরবর্তীতে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও অন্যান্য জনপ্রতিনিধিগণের সহায়তায় এটি স্থানীয়ভাবে সমাধান করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে যাদের অনুরোধে প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয় তাদের দীর্ঘদিনের প্রতিপক্ষ (যার পরিবার ঢাকায় অবস্থান করে) সে সুযোগ নিয়ে রাতারাতি এ গাছগুলো কেটে ফেলা হয় কিন্তু বিষয়টি আমাদের প্রকৌশলীরা জ্ঞাত ছিলেন না। পরবর্তীতে গাছের মালিক পক্ষকে ১.৫০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদান করার মাধ্যমে অভিযোগটি নিষ্পত্তি করা হয়। যে পরিমাণ বরাদ্দ এই সড়ক উন্নয়নের জন্য করা হয়েছিল তার প্রায় পুরোই ক্ষতিপূরণ প্রদানে ব্যয় করতে হয় (ভ্যাট, আইটি ও ঠিকাদারের লভ্যাংশ ইত্যাদি বাদ দিয়ে)। তাহলে বলা যায় রাস্তাটি আবেদনকারীদের টাকায় উন্নয়ন করা হয়েছিল। তাদের লাভ হয়েছিল মূলত দীর্ঘদিনের বিরোধীয় প্রতিপক্ষের গাছগুলো কাটতে পারা। এই কাজটি করা সম্ভব হয়েছিল মূলত উপজেলা পরিষদের কাজের অজুহাত দিয়ে।

দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় দেখতে পেয়েছি সড়ক উন্নয়নের কাজ যখন চলমান থাকে তখন গ্রামের লোকজন প্রথমেই প্রাক্কলনটি হাতে পাওয়ার চেষ্টা করে। যেদিন ঢালাইয়ের কাজ হয় সেদিন অনেক গ্রামবাসী উপস্থিত হয়ে ঢালাই কাজে ব্যবহার্য কংকর, সিমেন্ট ও বালির অনুপাত যাচাই করে। কেউ ব্যস্ত থাকে কত নম্বরের ইট ব্যবহার হচ্ছে আবার কেউ ব্যস্ত থাকে রডের সাইজ ও গুণগত মান পরীক্ষায়। রাস্তা উন্নয়ন করার সময় প্রাক্কলন করতে গিয়ে জেলা পরিষদের প্র্যাকটিস স্যালভেজ মেটেরিয়ালগুলোর দাম প্রাক্কলনে ধরে দেয়া। কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্থানীয় জনসাধারণ আবার পূর্ববর্তী স্যালভেজ মেটেরিয়ালগুলো ব্যবহার করতে বাধা প্রদান করে থাকে। তাই এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সৃষ্ট সমস্যাসমূহ প্রতিনিয়ত সামাজিকভাবে সমাধান করতে হয়।

সবশেষে প্রায় সমাপ্ত প্রকল্পটিতে যে সমস্যাটি উদ্ভূত হয় তা ফলক বসানো নিয়ে। সড়কটির নাম নিয়ে ঘটে নতুন বিপত্তি। যে সড়কগুলো স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহের মাধ্যমে উন্নয়ন করা হয় অধিকাংশ ক্ষেত্রে এগুলোর পূর্বের কোনো নাম দেয়া থাকে না। প্রকল্পের কাজ সমাপ্ত হলে বরাদ্দের পরিমাণ, অর্থ বছর, বরাদ্দের প্রকৃতি উল্লেখ করে ফলক লাগানো আবশ্যক অন্যথায় চূড়ান্ত বিল দাখিল করা যায় না। উপজেলা পরিষদ বা জেলা পরিষদ সড়কের কোনো নামকরণ করে না। নাম নিয়ে স্থানীয় লোকজনের কোন্দলের কারণে অনেক সময় ফলক ভেঙে ফেলার মতো ঘটনাও ঘটতে দেখা যায়।

এত কিছুর পরও এ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রামের প্রত্যন্ত এলাকার ফিডার রাস্তাগুলো উন্নয়নের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ সড়কগুলোর কারণে এলাকার উন্নয়ন মানুষের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছায়। জীবনযাত্রায় আসে ইতিবাচক পরিবর্তন। এমন কিছু বাড়ি রয়েছে যেখানে কখনো একটি রিকশা দিয়ে এক বস্তা চাল নেয়া যায় নি। বর্ষাকালে একটি খাটিয়া নিয়ে লাশ বের করতে যেখানে কষ্ট হয় সেখানে এ রাস্তাগুলো এলাকার মানুষের জন্য সত্যিই আশীর্বাদ। এমনও শোনা যায় রাস্তার দুরবস্থার কারণে অনেক এলাকার সাথে অপেক্ষাকৃত উন্নত এলাকার লোকজন আত্মীয়তা করতে চান না। সড়ক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন সমাপ্ত হলে যখন গ্রামবাসীরা রাস্তাটির সুফল পেতে শুরু করে তখন সর্বস্তরের জনসাধারণের মাঝে যে আনন্দ বিরাজ করে তা দেখার মতো। যোগাযোগ ব্যবস্থার পুরোপুরি সুফল নির্ভর করে মূলত গ্রামীণ সড়কগুলোর উন্নয়নের উপর। তাই গ্রামীণ জনসাধারণকে তাদের ক্ষুদ্র স্বার্থ ত্যাগ করে স্থানীয় সরকারের প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়নে সহযোগীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে।

লেখক: নির্বাহী কর্মকর্তা, জেলা পরিষদ, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনিরাপদ হোক ঈদ যাত্রা
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ: মুক্তির স্বপ্নে এই বাংলায় প্রথম সশস্ত্র বিপ্লব