গ্রামীণ মৃৎশিল্পের সন্ধানে

নীলুফা সুলতানা | সোমবার , ২৮ এপ্রিল, ২০২৫ at ১০:৪৫ পূর্বাহ্ণ

মৃৎশিল্প শব্দটি শোনামাত্রই আবেশে মুগ্ধ হয়ে আসত চায় মন। যেন এর পোড়ামাটির গন্ধ আমাদের নাকে লেগে আছে এর সুদীর্ঘ বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে। স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে নিয়ে মৃৎশিল্পের অবস্‌হান দেদীপ্যমান হলে ও বর্তমানে ভিন্ন শিল্পের বাজারের সাথে প্রতিযোগিতায় সে তার অতীত ঐতিহ্য প্রায় হারাতে বসেছে। তবুও বলা যায় মৃৎশিল্পের রয়েছে নিজস্ব ইতিহাস ও ঐতিহ্য যা আমাদেরকে এই শিল্পের প্রাচীনতার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়।

মৃৎশিল্প বলতে শিল্পকলার একটি বিশেষ শাখাকে বোঝায়, যেখানে কুমোরের মাটি বা এই জাতীয় গঠন উপাদান দিয়ে শিল্পকর্ম সৃষ্টি করা হয়। টালি, ছোট মূর্তি, ভাস্কর্য এমনকি ব্যবহারিক কারিগরি মৃৎশিল্পে উৎপন্ন কিন্তু শৈল্পিক অভিব্যক্তিবিশিষ্ট খাবার টেবিলের তৈজসপত্রকে ও মৃৎশিল্পের একেকটি রুপ হিসেবে গণ্য করা যায়।প্রয়োজনে মাটির সাথে অন্যান্য উপকরণ, যেমন: কাদামাটি, জল বা মাটি শক্তিশালী করার জন্য অন্যান্য উপাদান মিশিয়ে নিতে হয়। মাটিকে গুঁড়ো করার পর সেটি হাতে বা মেশিনে মাখতে হয়। এর ফলে মাটি মসৃণ ও একরূপ হয়। তারপর প্রস্তুতকৃত মাটিকে আকৃতি দেওয়া হয় এবং এটি বিভিন্ন মৃৎশিল্প পণ্য তৈরীর জন্য প্রস্তত হয়। মৃৎশিল্প মানুষের প্রাচীনতম আবিষ্কার।

খৃস্টপূর্ব ২৯ হাজার থেকে ২৫ হাজার অব্দের নব্যপ্রস্তর যুগে এর সূচনা হয়। ইতিহাস অনুযায়ী চীনের বিখ্যাত শহর থ্যাংশান এ মৃৎশিল্পের জন্ম হয়েছিল। আর এ কারণেই এ শহরটিকে মৃৎশিল্পের শহর বলা হয়। নব্য প্রস্তরযুগের চেক প্রজাতন্ত্রে গ্রাভেতিয়ান সভ্যতার ডলনে ভোসনিসে, জাপানের জোমেন (খৃস্টপূর্ব ১০,৫০০), রাশিয়ার সর্বপূর্বে (খৃস্টপূর্ব ১৪,০০০), সাব সাহারান দক্ষিণ আফ্রিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকায় এর আবিস্কারের তথ্য পাওয়া যায়।

ইতিহাসের কথা বাদ দেওয়া যাক। আমরা আমাদের জায়গায় ফিরে আসি যেখান থেকে বন্ধুরা মিলে মৃৎশিল্পের সন্ধানে বের হবার মনস্থির করার সিদ্ধান্ত নিই। যদিও তাদের ভাষ্যমতে, এ শিল্পটি এখন হারিয়ে যাওয়ার পথে। সেই চেনাজানা রুপ ও তার জৌলুস হারাতে বসেছে অন্যান্য শিল্পের দৌরাত্মের কারণে। তারপর ও এ শিল্পের যে একেবারে কদর নাই তা বলা যাবে না। এখন ও স্বল্পপরিসরে সংগ্রামের সাথে টিকে রয়েছে বাংলার মাটিতে। যারা এই শিল্পের সাথে জড়িত তাদের বলা হয় কুৃমোর। এই কুমোরেরা দীর্ঘদিন ধরে বংশ পরস্পরায় কাজ করে যাচ্ছেন এবং আমাদের জন্য তৈরী করছেন হাঁড়ি, কলস, থালাবাসন, ফুলদানিসহ আর ও নানাজাতীয় দ্রব্য। যেহেতু অন্যান্য জেলার চাইতে কুমিল্লা জেলাটি বিখ্যাত হয়ে আছে মৃৎশিল্পের অতীত গৌরবময় ইতিহাস নিয়ে এবং বন্ধুরা ও মিলে ঠিক করা হলো এই জেলার ঐতিহ্যকে ধারণ করছে এমন স্থানগুলা দর্শন করার। একদা কুমিল্লার প্রায় প্রতিটি উপজেলাতেই মৃৎশিল্প ছিলো। সময়ের ব্যবধানে বর্তমানে গুটিকয়েক স্থানে এই শিল্পটি টিকে থাকলেও আশার কথা হচ্ছে শতপ্রতিকূলতার মাঝে ও সগৌরবে মাথা উঁচু করে টিকে আছে এবং বিশ্বময় নিজেদের সুনাম ছড়িয়ে দিয়ে কুমিল্লার মাথাকে উঁচু করেছে একটি প্রতিষ্ঠান বিজয়পুর মৃৎশিল্প।

কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার বিজয়পুর গ্রামের মৃৎশিল্পের কথাই বলা হচ্ছে। দীর্ঘসময় ধরে এ গ্রামের মৃৎশিল্পীরা মাটির তৈজসপত্রসহ নানান সামগ্রী তৈরী ও বাজারজাতের মাধ্যমে নিজেরা অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি, তাদের নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় উৎপাদিত মাটির সামগ্রী বিদেশে রপ্তানি করে দেশে বয়ে আনছেন বৈদেশিক মুদ্রাও। কুমিল্লার লালমাই পাহাড়ের কোল ঘেঁষে সমতল ভূমির সাতটি গ্রাম। ওই গ্রামগুলোয় পাল বংশের অধিবাসীরা বংশপরম্পরায় মাটির জিনিসপত্র তৈরির কাজটা পরম মমতায় করে যাচ্ছেন। অনন্য বৈশিষ্ট্য ও নকশার কারণে এখানকার মাটির সামগ্রীগুলোর বিশেষ পরিচিতি রয়েছে। বাংলা নববর্ষের পূর্বে এই গ্রামের কুমোরদের মাটির তৈরী পণ্য তৈরী করার ধুম পড়ে যায়। তখন পালবংশের মানুষজনের ব্যস্ততা বেড়ে যেতে থাকে ধীরে ধীরে। নিজস্ব ইতিহাসকে লালন করার বিষয়ে বারপাড়াসহ অন্যান্য গ্রামের মানুষজনের আন্তরিকতার বিষয়টি বেশ দৃষ্টিনন্দন। এখানকার প্রতিটা দৃশ্য যেন তরে তরে সাজানো। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি কুমোরেরা মাটি নিয়ে কাজ করতে বসে যান। এই মৃৎশিল্পীদের জীবনযাপনের প্রতিটা স্তরে গ্রাম বাংলার মানুষজনের হাসি কান্না সমেত নিঁখুত জীবনের ছবি ফুটে উঠছে লক্ষ্য করা যায়। আন্তরিকতার সহিত ব্যবহারই প্রাচীন মানুষের কাঁচামাটির ঘ্রাণের পরিচয় করিয়ে দিবে। সরেজমিনে যা আমাদের পরখ করাই ছিল মূলত উদ্দেশ্য। বেশিরভাগ পরিবারকেই বাহিরের থেকে মাটি ক্রয় করতে হলেও স্বল্প পরিবারকে দেখা যায় নিজেদের ভিটেমাটি থেকেই মাটি সংগ্রহ করার কাজে ব্যস্ত। মাটি সংগ্রহ করে তা চূর্ণ করার কাজে পরিবারের সকলে হাত মেলান। এ কাজে পরিপূর্ণ সহকারে জল ব্যবহার করেন তারা।

বৈশাখী মেলা উপলক্ষে তাদের বানানো পণ্য তারা নিয়ে যাবেন হাটবাজারে বিক্রয়ের আশায়। যদিও অতীতের মতো এই পেশায় তাদের বেচাবিক্রি ভালো নয় তবুও প্রাণের বৈশাখী মেলায় কুমোরেরা অংশগ্রহণ করেন তাদের প্রস্তুতকৃত পণ্যের উত্তম দাম এবং ভালো বিক্রয়ের আশায়। গ্রামে গঞ্জে তো বটেই শহুরে মেলায় ও তাদের বানানো তৈজসপত্রের কদরের কমতি আছে তা বলা যাবে না। মাটির তৈরী হাঁড়িপাতিল, থালাবাসন, সানকি, ঘটি, মটকা, কলস, সাজ ব্যাংক, প্রদীপ, পুতুল, কলকি, দেবদেবীর মূর্তি ইত্যাদি তৈরী করে কামার কুমোরেরা আমাদের বাঙালি ঐতিহ্যের একটা জায়গা এখনো ধরে রেখেছেন তাতো বলার অপেক্ষা রাখে না। সেই ১৯৭১ সালের দেশ স্বাধীন হওয়ার অব্যবহিত পর থেকেই বৈশ্বিক ও দেশীয় বাজারে তাদের অবস্থান সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও বিভিন্ন এনজিও সহযোগিতার কারণে কুমিল্লা জেলার বারপাড়াসহ অন্যান্য গ্রামের মানুষজনকেই মৃৎশিল্পীর ঐতিহ্য এবং পেশার সুনাম ধরে রাখাসহ এখনও চমৎকার ভাবে কাজ করে যেতে পারছেন যেখানে এ্যালুমিনিয়াম ও অন্যান্য সামগ্রীর চাহিদা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। ক্রয় এবং বিক্রয়বাবদ তাদের যে লভ্যাংশ তা দিয়েই মৃৎশিল্পীদের নিজেদের সংসার চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো সক্ষমতা আছে বলা গেলেও মাসিক আয় ও ব্যয় মিলিয়ে লাভবানের হিসেব মিলোতে গেলে থৈ পাওয়া কঠিন, তবু বাপদাদাদের এই প্রাচীন পেশার প্রতি ভালোবাসা ও সম্মানের কারণে তারা এখন ও লড়াইয়ের সঙ্গে এ শিল্পের ইতিহাস ও ঐতিহ্য ধরে রাখার বিষয়ে সদা সচেষ্ট। বৈশাখ ছাড়াও তাদের বানানো দ্রব্যাদি বছরের অন্যান্যসময় গ্রামীণ হাটবাজার এবং স্থানীয় দোকানগুলোতে বিক্রয় হতে দেখা যায়।

লেখক : কবি, সাহিত্যকর্মী

পূর্ববর্তী নিবন্ধশ্রমিকের ঘামে গড়ে উঠে সমাজের পরিচয়
পরবর্তী নিবন্ধআমার বাবা ড. প্রণব কুমার বড়ুয়া