ভাবছো তুমি চুপচাপ শহরে
গ্রাফিতি আঁকা দেয়াল জুড়ে
রক্তের দাগ ছড়িয়ে দেবে নিয়তির শরীরে
বুকের পাঁজরে…
ছোটবেলা হতে ঢাকা শহরের সাদা দেয়ালে হাতে আঁকা বিভিন্ন ছবি বা মোটা অক্ষরে কালো বা লাল রং দিয়ে লেখাগুলি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করতো। আগ্রহ নিয়ে দেখতাম। পড়তাম।
তখন এসব বুঝতাম না। এখন জানি সহজ ভাষায় দেয়ালে লিখা বা আঁকা এসব ছবিকে গ্রাফিতি বলে। অর্থাৎ গ্রাফিতি হলো যেখানে দেয়াল শিল্পী তার চিত্রকর্ম বা দেয়াল লিখনের মাধ্যমে কোন সূক্ষ্ম বার্তা অনেকের মাঝে প্রচারের চেষ্টা করেন।
গ্রাফিতি শব্দের উৎপত্তি গ্রিক শব্দ গ্রাফিয়েন (graphien) থেকে, যার অর্থ ‘লেখা’। এটি মূলত ভাষা ও শিল্পের এক অনন্য সমন্বয়। গ্রাফিতির ইতিহাস বেশ পুরোনো। ধারণা করা হয়, প্রাচীন গুহাচিত্র হতে আজকের গ্রাফিতির সূচনা। অর্থাৎ মানব সভ্যতার বিকাশের সাথে সাথে গ্রাফিতিও বিকশিত হয়েছে। সেই গ্রিক-রোমান সভ্যতা থেকে শুরু করে আজ অবধি শিল্পীরা গ্রাফিতির মাধ্যমে সমসাময়িক রাজনৈতিক বা সামাজিক পরিস্থিতি, অন্যায়-অবিচার, যুদ্ধের বিপক্ষে কিংবা শান্তির পক্ষে নানা বার্তা দিয়ে থাকেন। এসকল গ্রাফিতি হতো কোথাও পশুর চর্বি মেশানো পাথর গুঁড়ার রং দিয়ে আঁকা, কোথাও দেখা যেত খোদাইকর্মে, আবার কোথাও মোজাইক করা দেয়ালচিত্রে।
আজকের গ্রাফিতি সংস্কৃতির বর্তমান আঙ্গিকের যাত্রা শুরু ষাটের দশকে যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ায়। তবে তা তুমুল জনপ্রিয়তা পায় নিউইয়র্কে। ওই সময়ে প্রচলিত সমাজ বদলের একটি জোয়ার উঠেছিল পৃথিবীতে। আমেরিকাও সে জোয়ার থেকে পিছিয়ে ছিল না এবং এরপর বেশ দ্রুতই তা ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র পৃথিবীতে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কাল থেকে গ্রাফিতি প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে ‘Kilroy was here’ নামক গ্রাফিতি আমেরিকার দেয়ালে দেয়ালে ছড়িয়ে পড়ে। টাকমাথার লম্বা নাকওয়ালা এক লোক দেয়াল ধরে বসে আছে- এটাই ছিল কিলরয়ের উপজীব্য। ছবিটি সে সময়ে আঁকা, যখন আমেরিকান জাহাজের চালান ধরা পড়ে জার্মানদের হাতে আর এডলফ হিটলার ভাবতে শুরু করেন, এটা নিশ্চয়ই আমেরিকান কোনো গুপ্তচরের সাংকেতিক নাম।
অথচ এ কিলরয়ের রহস্য আজও অজানা।
২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত ব্রাজিল বিশ্বকাপে পথশিল্পী পাওলো ইতো একটি গ্রাফিতি আঁকেন একটি ক্ষুধার্ত শিশুর সামনে ফুটবলের একটি ছবি যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে বিশেষভাবে ভাইরাল হয়। এটি আঁকা হয়েছিল আয়োজক দেশ হিসেবে ব্রাজিলের অমিতব্যয়ী আচরণের প্রতিবাদ হিসেবে। শামসিয়া হাসানি হলেন যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানের প্রথম নারী গ্রাফিতি শিল্পী। গ্রাফিতির মাধ্যমেই আফগান নারীদের জীবনের ভয়ঙ্কর সব স্মৃতি মুছে দেওয়ার স্বপ্ন দেখেন। যদিও এখন নিজেই ভয় পাচ্ছেন এই গ্রাফিতি অঙ্কন উনার জীবনে কতটা হুমকি হতে পারে ভেবে। যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ ‘হাউজ অব কমন্স’ এ মানুষের বদলে বসে আছে একপাল শিম্পাঞ্জি তারাই চালাচ্ছে রাষ্ট্র। একশ’ কোটি টাকারও (৯.৯ মিলিয়ন পাউন্ড) বেশি দামে বিক্রি হয়েছে এমন একটি ছবি এবং ছবিটি এঁকেছেন সমকালীন বিশ্বের তুমুল আলোচিত যুক্তরাজ্যেও শিল্পী ব্যাঙ্কসি। দক্ষিণ ইংল্যান্ডের সাউথাম্পটন জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগের কাছেই একটি দেয়ালে আরেকটি চিত্রকর্ম রেখে যান ব্যাঙ্কসি। চিত্রকর্মে যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা দেখিয়েছেন তিনি।
কিন্তু কেউ কখনো দেখেনি এ-শিল্পীকে। গেরিলার মতো গোপনে, সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় ছবি এঁকে রাতারাতি লাপাত্তা হয়ে যান তিনি। ছবি ও ভাস্কর্য এঁকে এখন পর্যন্ত ফিলিস্তিনসহ বিভিন্ন দেশের বিপ্লবী, সংগ্রামী জনতার সঙ্গে সংহতি জানিয়েছেন এ-শিল্পী। তুমুল ব্যঙ্গ ও সমালোচনার জন্য ক্ষমতাশালীদের চোখের কাটা ব্যাঙ্কসির শিল্পকর্ম। ব্যাঙ্কসি মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলী দখলদারিত্ব নীতির বিরোধিতা করেও গ্রাফিতি এঁকেছেন। গ্রাফিতির নবজাগরণের পেছনে শিল্পী ব্যাঙ্কসির অবদান রয়েছে মনে করেন অনেকেই।
সাউথ হ্যাম্পশায়ারের গু Dogsighs নামে পরিচিত একজন শিল্পী ইউক্রেনের পতাকার রং এর উপর একটি ক্রন্দনরত চোখ এঁকে যুদ্ধ বিধ্বস্ত সে-দেশের জনগণের পক্ষে সমর্থন হিসেবে কার্ডিফের নর্থ কোট লেন-এ এই গ্রাফিতি চিত্রটি অঙ্কন করেন। আমাদের দেশে গ্রাফিতির ইতিহাস দেখলে দেয়াল লিখন বিশাল জায়গা জুড়ে আছে। ট্রেনের কামরায়, বাসস্ট্যান্ডে, এমনকী পার্কে দেয়ালে বা গাছের গায়ে একটি ছেলে ও একটি মেয়ের নাম লিখে রাখা হয়, তা-ও গ্রাফিতির অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ দেয়াল লিখনের একটি শাখা হিসেবে গ্রাফিতিকে অন্তর্ভুক্ত করা যায়। তবে সব দেয়াল লিখন গ্রাফিতি নয়।
দেয়াল লিখন আমাদের দেশে ‘দেয়ালে চিকা মারা’ নামে পরিচিত। এ নিয়ে একটা মজার গল্প আছে। দু’জন ছাত্র দেয়ালে লেখার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এ-সময় সেখানে পুলিশ এসে জানতে চায় তারা কী করছে এখানে। ওরা বলে: চিকা (ছুচো ইঁদুর) মারছি। সেই থেকে দেয়াল লিখনের মতো গ্রাফিতি বাংলাদেশে ‘চিকা মারা’ নামে চিহ্নিত। মূলত তখন জিগা গাছের ডালের থেতলানো অংশ আর আলকাতরা দিয়ে দেয়াল লিখনগুলো করা হতো।
আমাদের দেশে সামরিক শাসনের আমলে একমাত্র মতপ্রকাশের জায়গা ছিল এই দেয়াল লিখন। তবে এ-সকল ক্ষেত্রে অবশ্যই গ্রাফিতি শিল্পী সবসময় নিজেকে আড়ালেই রেখেছেন।
সেই বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনে ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’ থেকে শুরু কওে একাত্তরের ‘জয় বাংলা’ নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’,‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা’ এর মতো দেয়াল লিখন আমাদের উদ্দীপ্ত করেছে। আবার বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে, যখন সব পত্রপত্রিকায়, রেডিও-টেলিভিশনে বঙ্গবন্ধুর নাম নিষিদ্ধ সে সময়ে দেয়ালেই লেখা হয়েছে: ‘এক মুজিব লোকান্তরে, লক্ষ মুজিব ঘরে ঘরে’ বা এমন আরো অনেক।
এ ধরনের দেয়াল লিখনের বাইরে বাংলাদেশে গ্রাফিতি নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা বা চর্চা ছিল না বললেই চলে নব্বইয়ের দশকে, বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ‘কষ্টে আছি-আইজদ্দিন’ ও পরের দশকে-‘অপেক্ষায়…নাজির’ লেখাকে বাংলাদেশে গ্রাফিতি লেখার সূচনা ধরা হলেও আমাদের দেশে প্রকৃত গ্রাফিতি হিসেবে গণ্য করা যায় ‘সুবোধ’কে।
নিজের অজান্তেই বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম সফল গ্রাফিতির জনক আইজউদ্দিন অভাব-অনটনের সংসার, আর্থিক দৈন্যের কারণে স্ত্রীর চলে যাওয়া, সেই কষ্ট সাথে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, দুর্নীতি ইত্যাদি কারণে জনগণের যে কষ্ট, তা প্রকাশ করার জন্য তিনি উন্মুক্ত দেয়াল বেছে নিয়েছিলেন। ৯৭ থেকে ২০০২-০৩ পর্যন্ত তিনি প্রায় সব দেশে ঘুরেছেন আর ‘কষ্টে আছি আইজদ্দিন’ লিখে দেয়াল ভরিয়েছেন যা মানুষের নজরে পড়ে।
২০১৭ এর দিকে ঢাকার আগারগাঁও এলাকার দেয়ালে আঁকা একটি চিত্রকর্ম হঠাৎ সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মাথা ভরা উষ্কখুষ্ক লম্বা চুল, রুক্ষ চেহারা, হাতে একটি খাঁচায় বন্দি সূর্য নিয়ে বসে আছে এক যুবক, পাশে লেখা ‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা, তোর ভাগ্যে কিছু নেই’ পাশে লোগো হিসেবে ইংরেজিতে লেখা ‘Hobe Ki?’ এই দেয়ালচিত্র একটি সিরিজ আকারে ঢাকা শহরের বিভিন্ন দেয়ালে আঁকা হয়েছিল এ-সবই প্রতীকী অর্থে ব্যবহার করা। এখানে সুবোধ বা ‘স বোধ’ হয়তো আমাদের সুন্দর বোধগুলো, আমাদের সুন্দর চিন্তাগুলো কিংবা আমাদের সুন্দর স্বপ্নগুলো ধারণা করা হয়। এখানে এই সুবোধ বলতে কোনো একজন ব্যক্তি নন এটি সমাজ, রাষ্ট্র কিংবা জনগণকে ইঙ্গিত করে বৃহত্তর অর্থে বোঝানো হয়েছে, বলার চেষ্টা করা হয়েছে, সুবোধ চরিত্রটি খুব কষ্টে আছে সেখান থেকে মুক্তি পেতে সে প্রহর গুনছে।
এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানের দেয়ালে আরও কয়েকটি গ্রাফিতি অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
২০১৮ এর সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের দেয়ালে আঁকা হয় ‘হেলমেট ভাই’ এই গ্রাফিতি নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হেলমেট মাথায় একটি দলের হামলার কথা তখন সবার জানা। রূপক অর্থে তাদের ক্ষমতার দাপটকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ওই ব্যক্তির স্বাস্থ্য ও সুপারম্যানের অতিপ্রাকৃতিক শক্তিসম্পন্ন বস্ত্রের মাধ্যমে। ন্যায় আর যুক্তির ঊর্ধ্বে উঠে বিনা শর্তে কারও মতকে মেনে নেওয়া ব্যক্তির চরিত্রের ধারণা থেকে রোকেয়া হলের দেয়ালে আঁকা হয়েছিল ‘সহমত ভাই’ নামের গ্রাফিতি। ধারণা করা হয় এসব সহমত ভাইয়েরাই হেলমেট বাহিনীর সদস্য। সহমত ভাই ‘কথাটির প্রচলন হয়েছে মূলত ব্যাঙ্গাত্মক অর্থে রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে মিলিয়ে অনেকে এগুলোকে ব্যাখ্যা করেন।
২০১৯ এর ৬ অক্টোবর আবরার হত্যার পর থেকে প্রতিবাদ আর ক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়। ন্যায় বিচার পাবার আশায় সেই প্রতিবাদ প্রকাশের একটা ভাষা হিসেবে শিক্ষার্থীরা বেছে নেয় ক্যাম্পাসের দেয়াল। আবরার ফাহাদের বাবার এ-আকুতির জবাব আছে কি কোনো?
২০২১ এর ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতের আঁধারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় কারাগারের দেয়ালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রাফিতিকে কে বা কারা বিকৃতি করেছিল। পরে বিষয়টি জানার পর গ্রাফিতির অঙ্কনকারী ফরহাদ হাসান সুজন কল রোড অংশটি আবার অঙ্কন করে ঠিক করে দেন।
ব্যাঙ্কসি, ডেভিড কো, এদুয়ার্দো কোবরা, ব্লেক লে রেট, ওস জিমিওস পৃথিবী বিখ্যাত কয়েকজন গ্রাফিতি শিল্পী। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দেয়ালে দেয়ালে গ্রাফিতি আঁকা সরকার এবং জনগণের সম্পত্তি বিনষ্টকারী অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। এ কারণে বিভিন্ন মেয়াদে সাজার আইনও আছে। সাজা হতে পারে জেনেও শিল্পীদের গ্রাফিতি আঁকা থেকে বিরত রাখা যায় না। যেমন শোনা যায়, দেয়াল লিখন শিল্পী সেই আইজুদ্দিন (৪৫) অথবা সুবোধ অংকন করা গ্রাফিতি শিল্পীদের বিভিন্ন মামলায় গ্রেফতার করেছিল পুলিশ।
দুনিয়াজুড়েই প্রচলিত শিল্পকলার বাইরে এই গ্রাফিতি বা দেয়ালচিত্র এবং নানান ধরনের ‘স্ট্রিট আর্ট’ বা পথশিল্প খুবই জনপ্রিয়। এ সকল গ্রাফিতি-শিল্পীদের কাছে পৃথিবীর সব দেয়ালই তাই একেকটা ক্যানভাস। গ্রাফিতি শিল্পী কোন স্থায়ী উদ্দেশ্য নিয়ে নয়, মূলত সাধারণ জনগণ, রাষ্ট্রের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য তার কর্ম সম্পাদন করেন।
কবি কাজী জুবেরীর লিখা ‘শব্দের গ্রাফিতি’ কবিতা দিয়েই ইতি টানছি এই লেখার-
পৃথিবীর দেয়াল জুড়ে ছড়িয়ে দাও শব্দের গ্রাফিতি
প্রতিবাদী শব্দতে ধ্বংস করো সকল অন্যায় দুর্নীতি, মনে
রেখো তুমিই চে ফিদেল কাস্ত্রো
কিম্বা অরুন্ধতি।