গুলির নির্দেশ শেখ হাসিনাই দিয়েছিলেন

অডিও যাচাই করে বলছে বিবিসি

| বৃহস্পতিবার , ১০ জুলাই, ২০২৫ at ৬:২০ পূর্বাহ্ণ

চব্বিশের ছাত্র আন্দোলন দমাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে প্রাণঘাতী দমনপীড়ন চালানোর অনুমোদন তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই দিয়েছিলেনএমন অভিযোগের সত্যতা পাওয়ার কথা বলছে বিবিসি। এক প্রতিবেদনে বিবিসি লিখেছে, তাদের বিবিসি আই ইউনিট ফাঁস হওয়া একটি অডিও টেপ যাচাই করে ওই অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে। চলতি বছরের মার্চে অনলাইনে ফাঁস হওয়া ওই অডিওতে হাসিনাকে বলতে শোনা যায়, তিনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি দিয়ে বলেন, যেখানেই পাবে, গুলি করবে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় এই অডিও ক্লিপটি প্রমাণ হিসেবে ব্যবহারের প্রস্তুতি নিচ্ছে প্রসিকিউশন। বর্তমানে ভারতে অবস্থানরত শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতেই এ মামলার কার্যক্রম চলছে। গত ফেব্রুয়ারিতে জাতিসংঘ মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনের এক প্রতিবেদনে বলা হয় চব্বিশের জুলাইআগস্টে ছাত্রজনতার আন্দোলনে হত্যা ও নির্বিচার গুলির একাধিক বড় অভিযান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ ও তদারকিতেই হয়েছিল। বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে পাওয়া মৃত্যুর তথ্যের ভিত্তিতে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্টের মধ্যে ১,৪০০ জনের বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে, যাদের বেশিরভাগই বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর ব্যবহৃত প্রাণঘাতী অস্ত্র, সামরিক রাইফেল এবং শটগানের গুলিতে নিহত হন। খবর বিডিনিউজের।

বিবিসি লিখেছে, অজ্ঞাতপরিচয় একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার সঙ্গে শেখ হাসিনার কথোপকথনের ফাঁস হওয়া ওই অডিও রেকর্ড এখন পর্যন্ত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ, যা দিয়ে বলা যায়, সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালানোর সরাসরি অনুমতি দিয়েছিলেন তিনি। জুলাইআগস্টের ঘটনাপ্রবাহকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের সবচেয়ে ভয়াবহ সহিংসতা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে বিবিসির প্রতিবেদনে। বিবিসি বলছে, তাদের ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের অনুসন্ধানে ঢাকায় বিক্ষোভকারীদের ওপর পুলিশি হত্যাযজ্ঞের নতুন কিছু তথ্য উঠে এসেছে, যা আগে এতটা স্পষ্টভাবে আসেনি। এই অনুসন্ধানে মৃত্যুর সংখ্যাও অনেক বেশি পাওয়া গেছে। ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন বলছে, বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায় নিজেদের লোক দিয়ে আগুন লাগিয়ে তার দায় আন্দোলনকারীদের ওপর চাপানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল, সেই টেলিফোনিক নির্দেশ তদন্ত সংস্থার হস্তগত হয়েছে।

বিবিসি আই ফাঁস হওয়া যে অডিও টেপ যাচাই করে দেখার কথা বলছে, সেটা ১৮ জুলাইয়ের ঘটনা। বিষয়টি সম্পর্কে জানেন, এমন একজনের বরাতে বিবিসি লিখেছে, শেখ হাসিনা ওই সময়ে ছিলেন তার সরকারি বাসভবন গণভবনে। বিক্ষোভ তখন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। পুলিশের গুলিতে আন্দোলনকারীদের হতাহত হওয়ার বহু ছবি আর ভিডিও তখন সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ছে। এসব নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্তা ব্যক্তিদের। টেলিফোনে শেখ হাসিনার ওই নির্দেশের পরের কয়েক দিনে ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ দমাতে পুলিশের হাতে সামরিক মানের রাইফেল দেওয়া এবং তা ব্যবহৃত হওয়ার কথা পুলিশি নথিতে লিপিবদ্ধ থাকার কথা বলা হয়েছে বিবিসির প্রতিবেদনে। বিবিসি লিখেছে, বাংলাদেশ সরকারের নজরদারি সংস্থা এনটিএমসি সে সময় শেখ হাসিনার অনেকগুলো অডিও কল রেকর্ড করে। তারই একটি কল রেকর্ড যাচাই করে দেখেছে বিবিসি আই।

এ বছরের মার্চ মাসের শুরুতে ওই ফোনালাপের অডিও কে সোশাল মিডিয়ায় ফাঁস করেছিল, তা স্পষ্ট নয়। অভ্যুত্থানের পর হাসিনার ফোনালাপের অনেকগুলো ক্লিপ অনলাইনে এসেছে, যার বেশিরভাগই স্বাধীনভাবে যাচাই করা হয়নি। বিবিসি লিখেছে, ১৮ জুলাইয়ের কল রেকর্ডটি শেখ হাসিনার অন্য অডিওর সঙ্গে মিলিয়ে দেখেছে বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। স্বতন্ত্রভাবে যাচাই করার জন্য বিবিসি ওই অডিও টেপ অডিও ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠান ইয়ারশটকে দিয়েছিল। ইয়ারশট বলেছে, অডিওটি জাল বা সম্পাদিত নয়। সেটি কৃত্রিমভাবেও তৈরি করা হয়েছেএমন সম্ভাবনাও খুব কম।

ইয়ারশটের বিশেষজ্ঞদের মনে হয়েছে, ফাঁস হওয়া রেকর্ডিংটি সম্ভবত এমন একটি ঘরে নেওয়া হয়েছে যেখানে ফোনকলটি স্পিকার দিয়ে বাজানো হচ্ছিল, কারণ সেখানে স্বতন্ত্র টেলিফোনিক ফ্রিকোয়েন্সি এবং বাইরের শব্দ ধরা পড়েছে। রেকর্ডিংজুড়ে ইলেকট্রিক নেটওয়ার্ক ফ্রিকোয়েন্সি (ইএনএফ) শনাক্ত করেছে ইয়ারশট, যা সাধারণত একটি রেকর্ডিং ডিভাইস ও বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ব্যবহৃত হওয়ার কারণে ধরা পড়ে। বিবিসি লিখেছে, এটা ইঙ্গিত দেয় যে ওই অডিওটি ম্যানিপুলেট করা হয়নি।

ইয়ারশট শেখ হাসিনার কথাও বিশ্লেষণ করেছে। তার বাক্যচরণ, স্বরের উঠানামা এবং শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ পরীক্ষা করে তারা ‘নয়েজ ফ্লোর লেভেল’ একই রকম পেয়েছে। কৃত্রিমভাবে অডিওটি তৈরি করার কোনো প্রমাণও তারা খুঁজে পায়নি। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান কৌঁসুলির বিশেষ পরামর্শক, ব্রিটিশ মানবাধিকার আইনজীবী টবি ক্যাডম্যান বিবিসিকে বলেছেন, সে সময় হাসিনার ভূমিকা প্রমাণ করার জন্য এই রেকর্ডিংগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো স্পষ্ট এবং সঠিকভাবে যাচাই করা হয়েছে। মামলার অন্যান্য প্রমাণের সঙ্গেও এগুলো সামঞ্জস্যপূর্ণ।

আওয়ামী লীগের একজন মুখপাত্র বলেছেন, বিবিসি যে অডিও রেকর্ডের কথা বলেছে, সেটি আসল কি না, সে বিষয়ে তারা নিশ্চিত নন। শেখ হাসিনার সঙ্গে তার সরকারের মন্ত্রীএমপি এবং তখনকার পুলিশ কর্মকর্তারাও মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আসামি হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এ পর্যন্ত ২০৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ৭৩ জন কারাগারে আছেন।

বিবিসি লিখেছে, গতবছর জুলাইআগস্টে ৩৬ দিনের আন্দোলনের বিভিন্ন সময়ে বিক্ষোভকারীদের ওপর পুলিশের হামলার শত শত ভিডিও, ছবি ও নথিপত্র বিশ্লেষণ ও যাচাই করে দেখেছে বিবিসি আই। তাদের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ঢাকার ব্যস্ত এলাকা যাত্রাবাড়ীতে ৫ আগস্টের একটি ঘটনায় পুলিশের গুলিতে অন্তত ৫২ জন নিহত হয়েছিলেন, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে পুলিশি সহিংসতার অন্যতম ভয়াবহ ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। ঘটনার সময়কার প্রাথমিক প্রতিবেদনে যাত্রাবাড়ীতে ওই দিন ৩০ জন নিহত হওয়ার কথা বলা হয়েছিল।

বিবিসি বলছে, কীভাবে সেই সহিংসতার শুরু ও শেষ হয়েছিল, সে বিষয়ে বিস্তারিত নতুন তথ্য উঠে এসেছে তাদের অনুসন্ধানে। প্রত্যক্ষদর্শীদের তোলা ভিডিও, সিসিটিভি ভিডিও এবং ড্রোন থেকে তোলা ছবি বিশ্লেষণ করে বিবিসি আই নিশ্চিত হয়েছে যে পুলিশ বাহিনী ও বিক্ষোভকারীদের মধ্যে অবস্থান নিয়ে থাকা সেনা সদস্যরা সরে যাওয়ার পরপরই পুলিশ আন্দোলনকারীদের ওপর নির্বিচারে গুলি শুরু করে। গুলি শুরুর পর বিক্ষোভকারীরা মহাসড়ক এবং আশপাশের অলিগলি দিয়ে পালানোর চেষ্টা করছিল। সেই অবস্থায় টানা ৩০ মিনিট ধরে গুলি চালিয়ে যায় পুলিশ। পরে পুলিশ কর্মকর্তারা কাছের সেনা ক্যাম্পে গিয়ে আশ্রয় নেন।

বিক্ষোভকারীরা পরে যাত্রাবাড়ী থানায় হামলা চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। অন্তত ছয়জন পুলিশ সদস্য সেখানে নিহত হন। বাংলাদেশ পুলিশের একজন মুখপাত্রের বরাত দিয়ে বিবিসি লিখেছে, গত বছর জুলাইআগস্টের সহিংসতার ঘটনায় সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ৬০ জন পুলিশ সদস্যকে এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিছু দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে, যেখানে তৎকালীন পুলিশ বাহিনীর কিছু সদস্য অতিরিক্ত বলপ্রয়োগে জড়িয়ে পড়েছিলেন। বাংলাদেশ পুলিশ ইতোমধ্যে পূর্ণাঙ্গ ও নিরপেক্ষ তদন্ত শুরু করেছে, বলেন ওই মুখপাত্র।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ইতোমধ্যে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। হত্যা, সাধারণ নাগরিকদের ওপর সহিংসতার নির্দেশ দেওয়া, উসকানি, ষড়যন্ত্র এবং হত্যা ঠেকাতে ব্যর্থতাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে তার বিরুদ্ধে। ভারতে অবস্থানরত শেখ হাসিনাকে বিচারের মুখোমুখি করতে তাকে ফেরত পাঠানোর অনুরোধ জানিয়েছিল বাংলাদেশ সরকার। তবে ভারত সেই অনুরোধে সাড়া দেয়নি।

টবি ক্যাডম্যান বলছেন, হাসিনা স্বেচ্ছায় দেশে ফিরে বিচারের মুখোমুখি হবেনসেই সম্ভাবনা খুবই কম। আওয়ামী লীগ বলে আসছে, বিক্ষোভকারীদের ওপর বলপ্রয়োগের দায় তাদের নেতাদের ওপর বর্তায় না।

আওয়ামী লীগের একজন মুখপাত্র বিবিসিকে বলেন, দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা কিংবা প্রধানমন্ত্রী নিজে জনতার বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগের নির্দেশ দিয়েছিলেনএমন দাবি আওয়ামী লীগ স্পষ্টভাবে অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যান করছে। প্রাণহানি কমানোর জন্যই জ্যেষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তারা ইতিবাচক বিশ্বাস থেকে ওই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এবং তা ছিল যৌক্তিক।

জাতিসংঘ মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশন বলেছে, বিক্ষোভ দমনে শেখ হাসিনা এবং তার সরকারের কর্মকাণ্ড যে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে, সে বিষয়ে যুক্তিগ্রাহ্য প্রমাণ তারা পেয়েছে। তবে আওয়ামী লীগ তাদের ওই প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে। বিবিসি লিখেছে, এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য তারা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তারা কোনো জবাব দেয়নি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকাপ্তাই লেকে ১০ ফুট পানি বৃদ্ধি, ৫টি ইউনিট চালু
পরবর্তী নিবন্ধডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ প্রধান উপদেষ্টার