গুম কমিশনে অভিযোগ দিলেন ব্যারিস্টার আরমান

| বুধবার , ৩০ অক্টোবর, ২০২৪ at ৮:২৫ পূর্বাহ্ণ

দীর্ঘ আট বছর পর ‘আয়নাঘর’ থেকে মুক্ত হওয়া জামায়াতের প্রয়াত নেতা মীর কাসেম আলীর ছেলে ব্যারিস্টার মীর আহমেদ বিন কাসেম (আরমান) গুম হওয়ার অভিযোগ দায়ের করেছেন গুম কমিশনে। গতকাল মঙ্গলবার তার পক্ষে গুম সংক্রান্ত কমিশন অব ইনকোয়ারিতে অভিযোগ দায়ের করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মুজাহিদুল ইসলাম শাহিন। খবর বাংলানিউজের।

অভিযোগে বলা হয়, ব্যারিস্টার মীর আহমাদ বিন কাসেম আরমানকে ২০১৬ সালের আগস্ট মাসের ৪ তারিখ রাত ৯টায় মিরপুর ডিওএইচএসের বাসা থেকে জোর করে স্ত্রী সন্তানের সামনে থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। তারা তাকে একটি জায়গায় নিয়ে গিয়ে একটি নির্জন কক্ষে/সেলে বন্দি করে রাখে। সেলটি খুবই পুরনো ছিল, সেখানে তাকে ১৬ দিন রাখা হয়।

এতে আরও বলা হয়, গুম করার কয়েক মাস পরে একজন প্রহরী গভীর রাতে তার সঙ্গে কথা বলতে আসেন এবং জানান, অপহরণের কয়েক মাসের মাথায় তাকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। হত্যা করে ইট বেঁধে লাশ নদীতে ফেলে দেওয়া, লাশ যাতে চেনা না যায় সেজন্য হত্যার পর মুখ ও হাত অ্যাসিড দিয়ে ঝলসে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু হত্যার সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের একজন বড় কর্মকর্তা হত্যার সিদ্ধান্তের কয়েকদিনের মাথায় সিলেটে একটি সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হওয়ায় তাকে হত্যার সেই পরিকল্পনা পিছিয়ে যায়।

অভিযোগে আরমান বলেন, আমি যেখানে ছিলাম সেখান থেকে খুব কাছেই ইন্টারোগেশন রুম ছিল। আমি ইন্টারোগেশনের হালকা আওয়াজ শুনতে পেতাম। যাদের ওপর নির্যাতন চলছে তাদের আওয়াজে ঘুমাতে পারতাম না। এভাবে দীর্ঘ ৮ বছর আমাকে সেখানে গুম করে রাখা হয়েছে। এই দীর্ঘ সময়ে আমি কোনো প্রাকৃতিক আলোবাতাসের ছোঁয়া পাইনি। গোপন বন্দিশালা সম্পর্কে কেউ যেন কোনো তথ্য না পায়, সে বিষয়ে তারা সর্বদা কঠোর নীতি অনুসরণ করতো। আমরা কোথায় আছি, তা কখনো বলা হতো না বা আমাদের ভাগ্যে কী ঘটবে সে বিষয়ে কোনো তথ্য দিতে তারা অস্বীকার করতো। তবে গভীর রাতে সামান্য সময়ের জন্য দুই একজন প্রহরী এসে কিছু কথা বলতো।

আমাকে বাইরের কোনো আওয়াজ শুনতে দেওয়া হতো না। মসজিদে যখন আজান দিতো, তখন উচ্চশব্দে গান বাজানো হতো, যেন আমি রাতদিনের পার্থক্য বুঝতে না পারি। নামাজের জন্য সময় জানতে চাইলেও আমাকে বলা হতো না। তারা বলতেন, এভাবেই নাকি তাদের আদেশ দেওয়া হয়েছে। মাঝে মাঝে গান বন্ধ হলে আমি অন্য বন্দিদের চিৎকার ও কান্নার আওয়াজ শুনতে পেতাম। অমানবিক নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে অন্য বন্দিরা চিৎকার করতো। তবে সেখানে অন্য কোনো বন্দির সঙ্গে যোগাযোগের কোনো সুযোগ ছিল না। একজন বন্দি হিসেবে খাওয়ার জন্য আমাকে পর্যাপ্ত খাবার দেওয়া হতো না, প্রয়োজনের অর্ধেক খাবার পরিবেশন করা হতো।

লিখিত অভিযোগে ব্যারিস্টার আরমান আরও বলেন, আমাকে বলা হতো না আমি কোথায় আছি, আমাকে দিনতারিখ এবং সময় কোনো কিছুই জানতে দেওয়া হতো না। শুধু রমজানে মাস এলে বলা হতো যে, রমজান আসছে। সিকিউরিটির দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা বলতো যে, আজ থেকে তারাবি পড়তে পারেন, চাঁদ দেখা গেছে, সেহরির সময় খাবার দেওয়া হবে। সেহরির সময় খাবার দিয়ে বলতো খেয়ে নেন। সময় শেষ হয়ে গেলে আমরা বলব যে, সময় শেষ হয়ে গেছে। এক সময় আওয়াজ দিয়ে বলতো যে আর খাওয়া যাবে না, সময় শেষ। ইফতারের সময় তারা ইফতার দিতো, আর বলতো এখনই খাবেন না, আওয়াজ দিলে খাবেন। হাতকড়া অবস্থায় নামাজ পড়তে হতো। একহাত দিয়ে রুকু করতে হতো, এক হাত দিয়ে সেজদা করতে হতো। একবার ডান হাত একবার বাম হাতে।

প্রথম বন্দিশালা/জায়গা থেকে দ্বিতীয় বন্দিশালা/টর্চার সেলে অনেক বেশি সিস্টেমেটিক পদ্ধতিতে নির্যাতন করা হতো। সেখানে মাঝেমধ্যে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পরিদর্শনে আসতেন। তারা যখন আসতেন তখন দেয়ালের দিকে মুখ করে বসে থাকতে হতো, নড়াচড়া করতে দেওয়া হতো না। সারাদিন দেয়ালের দিকে মুখ করে বসে থাকতে হতো। আমাকে এক অবর্ণনীয় দুঃখকষ্টের জীবন অতিবাহিত করতে হয়েছে। জীবিত ব্যক্তিদের জন্য এই বন্দিশালা ছিল একটি কবরের মতো। সুপরিকল্পিতভাবে এবং সিস্টেমেটিক পদ্ধতি অবলম্বন করে এমনভাবে বন্দিদের নির্যাতন করা হতো, যাতে বন্দিরা যেন মৃত্যুর চেয়েও আরও ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়।

লিখিত অভিযোগে আরমান বলেন, তাদের নিয়মকানুন ও কঠোরতা দেখে মনে হয়েছে তারা সেনাবাহিনীর সদস্য বা কর্মকর্তা। কর্তৃপক্ষের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এক মুহূর্তের জন্য আমাদের মুক্ত থাকার সুযোগ ছিল না বা স্বাধীনতা হরণ করা হয়েছিল। সরকারের অবগতি, নির্দেশ বা সহযোগিতা ব্যতীত কারো পক্ষে এত মানুষকে দিনের পরে দিন বা বছরের পর বছর গুম করে রাখার সুযোগ নাই।

অভিযোগে আরমান আরও উল্লেখ করেন, আমাকে গুম করার কয়েকমাস পরে একজন প্রহরী গভীর রাতে আমার সঙ্গে কথা বলতে আসে এবং আমাকে জানায় যে, আমাকে অপহরণের কয়েক মাসের মাথায় আমাকে তারা হত্যার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং হত্যা করে ইট বেঁধে লাশ নদীতে ফেলে দিবে যাতে ভেসে না উঠে। তাছাড়াও আমার লাশ যাতে চেনা না যায়, সেই জন্য হত্যার পরে আমার মুখ ও হাত এসিড দিয়ে ঝলসে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। প্রহরী আরও জানায় যে, যারা আমাকে হত্যার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন তাদের একজন বড় কর্মকর্তা হত্যার সিদ্ধান্ত গ্রহণের কয়েকদিনের মাথায় সিলেটে একটি সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হওয়ায় আমার হত্যার পরিকল্পনা পিছিয়ে যায়। পরবর্তীতে সেই পদে নতুন যে কর্মকর্তার পদায়ন হন, তিনি এসে তাদের ঊধ্বর্তন অফিসারদের সঙ্গে কথা বলে আমাকে হত্যার সিদ্ধান্ত স্থগিত করেন এবং বন্দি রাখার আদেশ দেন।

আমি মুক্তি পাওয়ার পরে এ বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারি যে, উল্লেখিত সিলেটে সন্ত্রাসী হামলায় গত ২০১৭ সালের মার্চের ৩১ তারিখে র‌্যাবের ইনটেলিজেন্স উইংয়ের ডিরেক্টর লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদ নিহত হন। তার নিহতের ঘটনাটি আমাকে গুম করার কয়েকমাস পরেই ঘটেছিল।

লিখিত অভিযোগে আরমান বলেন, আমি যখন বন্দি ছিলাম তিনটি জিনিস সুনির্দিষ্টভাবে শুনতে পেতাম। এক হচ্ছে বিমান ল্যান্ড করার শব্দ। দ্বিতীয়ত ট্রেনের আওয়াজ শুনতাম। তৃতীয়ত অনেক জোরে গাড়ি চলার শব্দ শুনতে পেতাম। এছাড়াও বাঙালি নয়, এমন লোকদের উপস্থিতিও টের পেয়েছি এবং তাদের ভিনদেশি ভাষায় কথা বলতে শুনেছি, যাদের আমার বাংলাদেশি মনে হয়নি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনগর জামায়াতের আমীর হিসেবে শপথ নিলেন শাহজাহান চৌধুরী
পরবর্তী নিবন্ধজেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হলেন সুজন চৌধুরী