সকাল হতেই অঝোর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে। টুপটাপ করে বৃষ্টির মনভোলা ছন্দ জেগে ওঠে। পাড়ার লোকেরা নিজেদের কাজে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। পথের দু’পাশে অল্প অল্প করে জল জমে ফুলে উঠেছে। এ সময় গানের স্যার তার ঘরে বসে মধুর সুরে গান জুড়ে দেয়। পাড়ার লোকেরা কান পেতে শোনে সেই গান, সেই সুর–
‘টুপুর টাপুর ছন্দ হয়ে
বৃষ্টি ঝরে ওই,
আয়রে নীড়ে স্নেহের তীরে
মনের কথা কই;
বাদল দিনের মাদল এলো
নীরব কেনো রই।’
গানের স্যারের গানের সুরে বৃষ্টির স্বর মিলেমিশে একাকার হয়ে গেলো। পাড়ার ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা স্যারের ঘরে আসতে শুরু করে। মাদুর পেতে একে একে অনেকেই বসে গেল। স্যার মিষ্টি হেসে বলেন, আমার কিশোর কলি, ছাত্ররা, কেমন আছো? সকলে এক স্বরে জবাব দেয় ভালো আছি স্যার!’ আপনি কেমন আছেন?
‘হুম, ভালো আছি’। বৃষ্টিকাল তো তোমাদের সবার প্রিয়, তাই না?
: হ্যাঁ স্যার, আমাদের সবার প্রিয়!
: তোমরা কী একবার ঘরের বাইরের পরিবেশটা ভালো করে দেখেছো?
: হ্যাঁ স্যার। অনেকে জবাব দেয়।
: কী দেখেছো?
: স্যার দেখেছি, ঝুপঝাপ, টুপ–টাপ স্বরে বৃষ্টি ঝরছে …। এক কিশোরী উৎফুল্ল মনে জবাব দেয়!
: আমি দেখেছি, বৃষ্টিবলে ফুলে উঠে দুলে উঠেছে, আর এদিক–ওদিক ছুটে চলেছে …’ আরেকজন ছেলে জবাব দেয়।
: আমি দেখেছি, নিচু এলাকায় জল জমেছে। আর একে–একে ছুটে চলেছে নদীর দিকে…! একটি ছেলে বলল।
: স্যার, স্যার, নদীতে ঢলের সৃষ্টি হয়েছে। সে কী তীব্র স্রোত, কত জলের ঘরের চালা, ক্ষেতের ফসল, নদী তীরের গাছপালা ঢলের স্রোতে ভেসে যাচ্ছে। ‘একজন ছেলের বিস্ময় ভরা কণ্ঠে সব জীবন্ত হয়ে ওঠে। একথায় যোগ দিয়ে অন্য একজন বলল, লাগাতার বৃষ্টিতে নন্দীপাড়ায় অনেক ঘরবাড়ি ডুবে গেছে। অনেকে ঠাঁই নিয়েছে পথের পাশে, গাছের ডালে, আরেকজন বলল, ‘স্যার, রুমি, সুমি, সুবল, অমল মিলে ইয়া বড় কলা গাছের ভেলা বানিয়েছি। কাল বিকেলে আমরা এতে চড়ে বেড়িয়েছি। স্যার মুচকি হাসেন। একটু থেমে গানের স্যার বলেন, ‘বল তো একজন শিল্পী হয়ে এ মুহূর্তে আমাদের কী করা উচিত? সকলে জবাব দেয়, ‘আমাদের মধুর সুরে বৃষ্টির গান গাওয়া উচিত’। স্যার বলেন, তবে গাও’। সকলে আবার গাইতে শুরু করল–বৃষ্টি জলে ঢল নেমেছে/ সুর জেগেছে মনে/ চলরে সবাই যাই ছুটে যাই। স্নেহের মায়া বলে, ‘গান শেষে গানের স্যার হাততালি দিয়ে সবাইকে উৎসাহ দেয়।
: গান তো গেয়েছো ভালো, তাতে কি দুস্থ মানুষের কোন কাজে এসেছে (?) যারা জলের ঢলে বন্দি, তাদের জন্য এখন গানই যথেষ্ট? গানের স্যারের কথা শুনে সবাই নীরব হয়ে গেল।
: তবে, আমাদের কী করা উচিত স্যার? একজন জানতে চাইলো, স্যার মুখে হাত দিয়ে কিছুক্ষণ নীরব রইলেন। তারপর বলেন, ‘চল আমাদের যা আছে পানিবন্দি মানুষের উপকারে ছুটে যাই। যাও, সাধ্যিমতো, নিজেদের ঘর হতে কিছু শুকনো খাবার নিয়ে আসো। ছেলেমেয়েরা নিজেদের ঘরে ছুটে গেল।
গানের স্যার সুরের সাথে জীবনের ও প্রকৃতির রহস্যা খুঁজে বেড়ান বলে সবাই ওই নামে ডাকে।
ছোটরা নিজেদের ঘর থেকে চাল, ডাল, ভাত, মুড়ি নিয়ে এল। গানের স্যার বলেন, ‘চল আমরা ছুটে যাই মানুষের কল্যাণে।’
বাইরে তখনো অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরছে। দিকে দিকে জলের ঢলের মাতম লেগেছে। কাদা জল পেরিয়ে গানের স্যার ছোটদের নিয়ে এলো নিচু এলাকায়। এখানে ছোটদের বড়দের কান্নায় বাতাস ভারি হয়ে আসে। নিজেদের সাথে আনা খাবার উঁচু স্থানে রাখলো। স্যারের সাথে হাত মিলিয়ে উদ্ধার করতে থাকে বানবাসীদের।