চালুর এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই জৌলুস হারাচ্ছে কর্ণফুলী টানেল। প্রত্যাশিত গাড়ি চলাচল না থাকায় শুধুমাত্র রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ প্রতিদিন লোকসান গুণতে হচ্ছে প্রায় ২৬ লাখ টাকা। চালুর পর ১১ মাসের গড় হিসাবে প্রতিদিন ১১ লাখ ৮০ হাজার টাকা আয় হলেও গত সেপ্টেম্বর মাসে তা নেমে এসেছে ৮ লাখ টাকায়। প্রতিদিন যে পরিমাণ গাড়ি চলছে তা প্রাথমিক সমীক্ষার মাত্র ১৮ শতাংশ।
এদিকে আনোয়ারা প্রান্তে কোরিয়ান ইপিজেড ছাড়া নতুন শিল্প কারখানা বা কাঙ্ক্ষিত ব্যবসায়িক সম্ভাবনা তৈরি না হওয়ায় নতুন যাত্রা শুরু করা ব্যাংকের শাখা ও হাতেগোনা কয়েকটি দোকানপাট ক্রমাগত লোকসান দিচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। টানেল ঘিরে চীনা শিল্পজোন গড়ে তোলার লক্ষ্যে ভূমি অধিগ্রহণ করে রেখে দেওয়া ছাড়া গত কয়েক বছরে এ প্রকল্পের কোনো অগ্রগতি নেই। টানেল চালুর পর প্রথম কয়েক মাস টানেল দেখার জন্য মানুষের মাঝে ব্যাপক আগ্রহ ছিল। এখন পর্যন্ত যেসব গাড়ি চলাচল করছে তার বেশিরভাগই টানেল দেখতে আসা পর্যটকের গাড়ি বলে জানা গেছে। যতই দিন যাচ্ছে কমছে পর্যটকের গাড়ি। হাতেগোনা যে কয়েকটি খাবারের দোকান গড়ে উঠেছে তাদের ব্যবসা মোটামুটি চলছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা।
ওয়ান সিটি টু টাউনের আদলে ব্যবসা–বাণিজ্য ও নতুন সম্ভাবনার যে কথা বলা হয়েছিল তার কিছুই গত এক বছরে হয়নি। পরিকল্পনাধীন পতেঙ্গা টার্মিনাল, বে টার্মিনাল, মহেশখালীর মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ শিল্পাঞ্চল পরিকল্পনায় তেমন অগ্রগতি নেই। আনোয়ারা প্রান্তে নতুন কোনো শিল্প কারখানা হয়নি। এতে টানেল চত্বর থেকে কালা বিবির দিঘির মোড় পর্যন্ত নতুন করে যে সাতটি ব্যাংকের শাখা গড়ে উঠেছে তারা মাসের পর মাস লোকসান গুণছে।
তড়িঘড়ি করে টানেল চালু করা হলেও কঙবাজার বা টেকনাফ পর্যন্ত যেতে গাড়িগুলোকে আবার ঘুরপথে শিকলবাহা ওয়াই জংশন হয়ে পটিয়া–চন্দনাইশ রোডে গন্তব্য পৌঁছতে হচ্ছে। মূলত টানেলের কার্যকারিতা এখানে বড় ধাক্কা খায়। টানেলে যে পরিমাণ টোল লাগছে তার অর্ধেকে শাহ আমানত সেতু হয়ে কঙবাজার যাওয়া যাচ্ছে। ফলে টানেলের প্রতি মানুষের আগ্রহ দিন দিন কমছে। কেউ কেউ দেখার জন্য একবার পার হলেও দ্বিতীয়বার ওইমুখী হচ্ছেন না। শুধুমাত্র শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাওয়ার জন্য নামমাত্র কিছু গাড়ি টানেল ব্যবহার করছে বলে জানা গেছে।
টানেল সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সেপ্টেম্বর মাসে টোল আদায় হয়েছে ২ কোটি ৩৯ লাখ ২৩ হাজার টাকা। এ হিসাবে প্রতিদিন গড়ে আদায় হয় ৭ লাখ ৯৭ হাজার টাকার টোল। সারা মাসে গাড়ি চলেছে ৯১ হাজার ৬৬২টি। প্রতিদিন গাড়ি চলেছে ৩ হাজার ৫৫টি। অথচ একদিন টানেল চালু রাখতে শুধুমাত্র রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ খরচ হয় ৩৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। টানেলে বর্তমানে যে পরিমাণ গাড়ি চলছে তা প্রাথমিক সমীক্ষার ধারেকাছে নেই।
২০১৩ সালে টানেল নিয়ে যে সম্ভাব্যতা জরিপ হয় তাতে বছরে ৬৩ লাখ গাড়ি চলাচল করতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়। সেই হিসাবে গড়ে প্রতিদিন পার হবে ১৭ হাজার ২৬০টি গাড়ি। কিন্তু গত ১১ মাস পর এসে এখন গাড়ি চলছে ৩ হাজারের সামান্য বেশি। বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে যে হারে গাড়ি পার হচ্ছে তা লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ১৮ শতাংশ। ট্যুরিস্টদের গাড়ি যত কমছে গাড়ির সংখ্যাও দ্রুত নামছে। টানেল নির্মাণের পর অনেকে গাড়ি নিয়ে টানেল ঘুরে আসছেন। এটা কমে গেলে যানবাহন চলাচল আরো কমবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সূূত্র জানায়, টানেলে কৃত্রিম অঙিজেন ও আলো সরবরাহ, সামগ্রিক নিরাপত্তা ও জরুরি নিরাপত্তা ব্যবস্থাসহ আনুষঙ্গিক বাবদ প্রতিদিন গড়ে সাড়ে ৩৭ লাখ টাকা; যা আয়ের চেয়ে তিন গুণের বেশি। বর্তমানে টানেলে বাইসাইকেল, সিএনজি ও মোটরসাইকেল পারাপারের সুযোগ নেই। আবার টানেলের আনোয়ারা অংশে তেমন শিল্পকারখানাও গড়ে উঠেনি। ফলে যান চলাচল বাড়ছে না। টানেলের সামগ্রিক ব্যয়ের মধ্যে ৬ হাজার ৭০ কোটি টাকার চীনা ঋণ ২ শতাংশ সুদসহ আগামী ২০ বছরে পরিশোধ করতে হবে। ২০২৫ সাল থেকে টানেলের আয় দিয়ে সেই ঋণ পরিশোধ করা শুরু করবে সরকার। টানেলের নির্মাণ ব্যয় তুলে আনাসহ পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ খরচ মূলত আদায়কৃত টোল থেকে নির্বাহ হওয়ার কথা। তাই আগামী বছর টানেল ব্যবস্থাপনা অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ওয়ান সিটি টু টাউন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে টানেল নির্মিত হয়। চট্টগ্রাম থেকে কঙবাজার হয়ে টেকনাফ পর্যন্ত বিশাল অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়তে সড়ক নেটওয়ার্কে এটি আওয়ামী লীগ সরকারের বাস্তবায়িত দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রকল্প।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে টানেলের টোল বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, গাড়ি চলাচল কমে যাওয়ায় টোল আদায় দিন দিন কমছে। দৈনিক টোল আদায়, গাড়ি চলাচলসহ সব তথ্য প্রতিদিন সেতু কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইটে দেওয়া হচ্ছে। এতে যে কেউ আয়–ব্যয় সম্পর্কে ধারণা নিতে পারেন।
টানেল সংলগ্ন এলাকার বেসরকারি ব্যাংকের এক ম্যানেজার বলেন, টানেল চালুর এক বছর আগে থেকে সন্নিহিত এলাকায় শাখা খোলার হিড়িক পড়ে। তখন বলা হয়েছিল বন্দর সম্প্রসারণ হবে, ব্যবসা বাড়বে। বাস্তবে হাতেগোনা কয়েকটি খাবারের দোকান ছাড়া আর কিছু হয়নি। সবই এখন লোকসান গুণছে।