গাজায় দুর্ভিক্ষ চলছে

এ দুর্ভিক্ষ মানবসৃষ্ট, জানাল জাতিসংঘ সমর্থিত সংস্থা ৫ লাখের বেশি মানুষ অনাহারে মৃত্যু ঝুঁকির মধ্যে আছে

আজাদী ডেস্ক | শনিবার , ২৩ আগস্ট, ২০২৫ at ৬:০৬ পূর্বাহ্ণ

ইসরায়েলের সামরিক অভিযানে বিধ্বস্ত গাজা সিটি ও তার আশেপাশের এলাকায় দুর্ভিক্ষ দেখা দেওয়ার কথা জানিয়েছে খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা জাতিসংঘ সমর্থিত একটি সংস্থা। বিবিসি জানিয়েছে, ‘ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্লাসিফিকেশন’ (আইপিসি) গাজার পরিস্থিতিকে তাদের স্কেলের সবচেয়ে গুরুতর স্তর ‘ফেজ ফাইভ’ ঘোষণা করেছে, যা তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার সর্বোচ্চ পর্যায়। গতকাল শুক্রবার প্রকাশিত আইপিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজা সিটি এবং আশপাশের এলাকায় দুর্ভিক্ষ ইতোমধ্যে বিপর্যয়কর রূপ নিয়েছে। সেপ্টেম্বরের মধ্যে দেইর এলবালাহ এবং খান ইউনিসেও একই পরিস্থিতি তৈরির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। আইপিসি বলছে, গাজার ৫ লাখের বেশি মানুষ বর্তমানে অনাহারে চরম দারিদ্র্য আর মৃত্যু ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করছে। আইপিসি নিজে সরাসরি দুর্ভিক্ষ ঘোষণা করে না। তবে তাদের বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণ সংশ্লিষ্ট সরকার বা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে সে রকম ঘোষণা দেওয়ার ভিত্তি তৈরি করে দেয়। খবর বিডিনিউজের।

এর আগে গত মে মাসে আইপিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ইসরায়েলের অবরোধে গাজার প্রায় ২১ লাখ ফিলিস্তিনি চরম খাদ্য সংকটে পড়েছে এবং দুর্ভিক্ষের গুরুতর ঝুঁকিতে রয়েছে। ওই ভূখণ্ডে ত্রাণ বিতরণে নিয়োজিত বিভিন্ন সংস্থা সেখানকার পরিস্থিতিকে বেশ কয়েক মাস ধরেই দুর্ভিক্ষ বলে এলেও জাতিসংঘ সমর্থিত কোনো সংস্থা এই প্রথম গাজার পরিস্থিতিকে সরাসরি দুর্ভিক্ষ হিসেবে বর্ণনা করল। গাজার দুর্ভিক্ষ সম্পূর্ণ মানবসৃষ্ট : আইপিসি তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, গাজার দুর্ভিক্ষ পুরোপুরি মানুষের তৈরি। এটি থামানো এবং গতিপথ বদলানো যেতে পারে। ‘গাজার বিষয়টি নিয়ে এখন বিতর্ক আর সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রের দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগার সময় ফুরিয়ে গেছে। তীব্র ক্ষুধা সেখানে এবং সেই পরিস্থিতি দ্রুত গতিতে ছড়াচ্ছে’, প্রতিবেদনে বলেছে সংস্থাটি।

কোনো এলাকায় দুর্ভিক্ষ ঘটছে কিনা, সেই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে প্রাথমিকভাবে আইপিসির মানদণ্ড ধরে নেওয়া হয়। গাজায় দুর্ভিক্ষের কথা তুলে ধরা প্রতিবেদনে সংস্থাটি বলেছে, দুর্ভিক্ষ নিয়ে কারো মনে সন্দেহ থাকা উচিত নয় যে সেখানে একটি তাৎক্ষণিক ব্যাপক প্রতিক্রিয়া, অর্থাৎ ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। এর জন্য কোনো রকমের বিলম্ব, এমনকি সেটা যদি কয়েকদিনও হয়, তাতে দুর্ভিক্ষজনিত প্রাণহানি অগ্রহণযোগ্য মাত্রায় বেড়ে যাবে।

গাজার দুর্ভিক্ষ মানবতারই ব্যর্থতা : গাজার দুর্ভিক্ষের কথা জানানো আইপিসির প্রতিবেদনের পর জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, যখন মনে হচ্ছে গাজার নরকের পরিস্থিতি বর্ণনা করার মতো আর কোনো শব্দও অবশিষ্ট নেই, সেই মুহূর্তে আরেকটি শব্দ যোগ হলো ‘দুর্ভিক্ষ’। তিনি বলেন, এটি কোনো কল্পরহস্য নয়। এটি মানবসৃষ্ট দুর্যোগ, নৈতিক দায় এবং মানবতারই ব্যর্থতা। দুর্ভিক্ষ কেবল খাদ্যেরই ব্যাপার নয়, মানুষের বেঁচে থাকার জন্য পুরো ব্যবস্থারই ইচ্ছাকৃত পতন বয়ে আনা।

আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী সেখানে খাদ্য ও চিকিৎসা নিশ্চিত করা ইসরায়েলের দ্ব্যর্থহীন বাধ্যবাধকতা রয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। মহাসচিব বলেন, দায়মুক্তি দিয়ে আমরা এই পরিস্থিতি চলতে দিতে পারি না। আর কোনো অজুহাত নয়। ব্যবস্থা নেওয়ার সময় এখনই, আগামীকাল নয়। এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে। আমাদের অনতিবিলম্বে যুদ্ধবিরতি প্রয়োজন। সকল জিম্মির মুক্তি প্রয়োজন এবং বাধাহীনভাবে সম্পূর্ণ মানবিক সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে।

বানোয়াট প্রতিবেদন, বলছে ইসরায়েল : গাজা নিয়ে আইপিসির প্রতিবেদনের পর প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ইসরায়েল। ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, হামাসের ভুয়া ক্যাম্পেইনের সঙ্গে মিলিয়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বানোয়াট প্রতিবেদন তৈরি করেছে আইপিসি। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ তুলতে আইপিসি তার নিয়মের বিকৃতি ঘটিয়েছে এবং মানদণ্ড লঙ্ঘন করেছে। মন্ত্রণালয় বলেছে, আইপিসি তার নিজস্ব বৈশ্বিক মান পরিবর্তন করেছে। মৃত্যুর হার নির্ধারণের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় মানদণ্ডকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেছে। প্রতিবেদনটি হামাসের মিথ্যা তথ্যের উপর ভিত্তি করে তৈরি। তবে ইসরায়েলের এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে আইপিসি।

ইসরায়েল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দাবি, গাজায় কোনো দুর্ভিক্ষ নেই। প্রায় দুই বছরের যুদ্ধে সেখানে এক লাখ ট্রাক ঢুকছে। সম্প্রতি খাবারের দামও অনেক কমেছে। যুদ্ধের সময় থেকে আইপিসির প্রতিটি পূর্বাভাস ভিত্তিহীন ও সম্পূর্ণ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। রাজনৈতিক নথির আবর্জনার ঝুড়িতে আইপিসির এ মূল্যায়ন বা প্রতিবেদনও ফেলে দেওয়া হবে।

১ লাখ ৩২ হাজার শিশুর জীবন হুমকির মুখে : আইপিসি প্রতিবেদনে বলেছে, গাজায় বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় আগামী বছরের জুনের মধ্যে সেখানকার ১ লাখ ৩২ হাজার শিশু অপুষ্টিতে জীবন হুমকির মুখে পড়তে পারে। এসব শিশু চরম অপুষ্টিতে ভুগবে বলে অনুমান করছে সংস্থাটি।

আইপিসি বলছে, এই শিশুদের মধ্যে ৪১ হাজার মারাত্মক অপুষ্টিতে ভুগবে, যা সংস্থাটির মে মাসের মূল্যায়নের থেকে দ্বিগুণ। এই শিশুদের মৃত্যুর উচ্চঝুঁকিতে রেখেছে সংস্থটি।

জাতিসংঘের চার সংস্থার যৌথ বিবৃতি : জাতিসংঘের চারটি সংস্থা গাজায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি এবং ক্ষুধা ও অপুষ্টিজনিত মৃত্যু রোধে নিরবচ্ছিন্ন মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেছে। খাদ্য ও কৃষি সংস্থা বা এফএও, ইউনিসেফ, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি বা ডব্লিউএফপি এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা ডব্লিউএইচও এই যৌথ বিবৃতি দিয়েছে।

জাতিসংঘের সংস্থাগুলো বলছে, যেকোনো মূল্যে দুর্ভিক্ষ বন্ধ করতে হবে। এছাড়া গাজা শহরে তীব্র সামরিক আক্রমণের হুমকি এবং সংঘাতের যেকোনো বৃদ্ধি বেসামরিক নাগরিকদের জন্য ধ্বংসাত্মক পরিণতি বয়ে আনবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজুলাই সনদে মতামত দিয়েছে বিএনপি, এনসিপিসহ ২৩ দল
পরবর্তী নিবন্ধঅনিশ্চয়তায় আটকে গেছে রাউজানে কম্বাইন্ড বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প