সিনহা তার আব্বুর সাথে ধানের খেত দেখতে এসেছে। পাকা পাকা ধানের সুগন্ধে দুই বাপ–বেটার মন খুশিতে ভরে উঠেছে। সিনহা বলল, আব্বু আমাদের ধান কাটবে কবে?
কালই ধানে পোছ দেবো। বাড়ি গিয়ে কামলা ঠিক করতে হবে, চল।
সিনহা তার আব্বুর হাত ধরে বলল, হুম চলো।
চলতে চলতে সিনহা বলল, আব্বু ধান কাটা হলে এবার কিন্তু আমাকে স্কুলের সাইকেল কিনে দিতে হবে। ব্যাগটাও ছিঁড়ে গেছে।
সিরাজ মিয়া মুখে হাসি মেখে বলল, আচ্ছা বাবা ধান কাটা হলে সব হবে।
পরদিন ধান কাটতে সিনহাও গেলো তার আব্বুর সাথে। দুজন কামলা মনের সুখে গান গাইছে আর ধান কাটছে। সিনহা খুব মুগ্ধ হয়ে ওদের সাথে ধান কাটতে লাগলো। বেলাও হয়েছে খানিক। গামছায় মুড়ে সকালে ভাত নিয়ে এসেছে সিনহার আম্মু জাহিদা বেগম। সবাই হাত–মুখ ধুয়ে আলের সবুজ পিড়েয় বসে গেলো খেতে।
খাবার মুখে দিয়ে সিনহা তার আম্মুকে বলল, আম্মু উঠোনের চুলাটা ভালো করে লেপেপেুছে রেখেছ তো? কদিন পরেই কিন্তু পিঠাপুলি বানাতে হবে।
আম্মু সিনহার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, রেখেছি বাবা রেখেছি, তুমি খাও তো। আর খেয়ে দেয়ে আমার সাথে বাড়ি চলো স্কুলে যেতে হবে।তোমার আর ধান কাটতে হবে না।
সিনহা বলল, না! না! আমি আরো কাটব।
তখন সিনহার আব্বু জাহিদা বেগমকে বলল, স্কুলে যাবার জন্য বিশ টাকা নয়, আজ আমার আব্বুকে চল্লিশ টাকা দেবে কিন্তু।
যাও বাবা স্কুলে। মাথায় খানিকটা হাত বুলালো সিরাজ।
সিনহা তার আব্বুর সাথে ধানের আঁটি বোঝাই করে করে বাড়ি আনলো। মাড়াইয়ের কাজটাও করল আম্মুর সাথে। গোলা ভরে ধান তুললো। এগুলো করতে সিনহার আব্বু নিষেধ করলেও সে শোনে নি। বলল, আমি গাঁয়ের ছেলে এসব না করলে কি হয়! তাছাড়া তোমাদের খাটনি দেখেলে আমার খুব মায়া হয়। আমি বড় হলে তোমাদেরকে কাজ করতে দেবো না। আমি চাকরি করব, তোমরা বসে বসে খাবা। ছেলের এমন কথায় সিরাজ মিয়া দিল ভরে ওঠে।
গোলগাল চাঁদ। সন্ধের পর আঙিনাটা জোসনায় টইটুম্বুর। ডালিম গাছের ফাঁকে ফাঁকে জোসনারা খেলছে। তার পাশেই চুলো, পিঠে বানাতে বসেছে জাহিদা বেগম। চুলোর পিঠে মাদুর পেতে বই নিয়ে বসেছে সিনহা। পিঠে খাওয়ার জন্য ব্যাকুল তার মন। কিন্তু আম্মু বলেছে, অল্প একটু দেরি করলেই হবে।
সিনহা মনানন্দে বই পড়তে শুরু করল। একটু পর হঠাৎ সাইকেলের কিড়িং কিড়িং বেজে উঠলো। সিনহার আব্বু এসেছে হাট থেকে, ধান বেচতে গিয়েছিল। বই ফেলে দৌঁড়ে কাছে চলে গেলো সিনহা। ব্যাগটা চুলোর পিঠে এনে সবকিছু বের করলো। সিনহার জন্য নতুন জামা–প্যান্ট, মায়ের জন্য রঙিন শাড়ি। দাদির জন্য জায়নামাজের পাটি ও তসবি। বড় রুই মাছ। আর মন্ডা মিঠাই তো আছেই।
খানিক মিঠাই নিয়ে সিনহা তার দাদিকে দিয়ে আসলো। সিরাজ মিয়াও হাত–মুখ ধুয়ে চুলোর পিঠে গিয়ে বসলো।
সিনহা মিঠাই খেতে খেতে আব্বুকে বলল, আব্বু আমার সাইকেল আর ব্যাগ কবে দেবে?
এই তো আব্বু, কালই শহরে যাব। সবকিছু দেবো, কিন্তু লেখাপড়া ঠিকমত করতে হবে যে।
সিনহা শুনে খুশিতে আটখান হয়ে গেলো। বলল, আচ্ছা আব্বু। ক্লাসের ফার্স্ট বয় আমি কাউকে হতে দেবো না।
ততক্ষণে পিঠা হয়ে গেলো কিছু। সাথে সাথে জাহিদা বেগম দুই বাপ–বেটাকে এক থালে বেড়ে দিলো। পিঠার সুগন্ধ সিনহার খুশি খুশি মনটাকে আরো ভরে দিলো। গরম গরম পিঠা নিয়ে কী হাসিমুখে খাচ্ছে! এমন হাসিমুখ দেখে সিরাজ মিয়া ও জাহিদা বেগম যেন এই মুহূর্তে পৃথিবীর সেরা সুখী মানুষ। কিন্তু হাসিমুখের আয়নায় হঠাৎ করে ভেসে উঠলো কিছু হৃদয় নিঙড়ানো স্মৃতি। গত বছর এই সময়ে এই চুলোর পিঠে‘ই বসে সিনহার মত পরম হাসিমুখে পিঠা খাচ্ছিল মেয়ে নুশরাত। আজ নেই সে। থাকলে সিনহার মত সেও এ রকম হাসিমুখে পিঠা খেতো। কিন্তু স্মৃতির মেঘেরা মন উঠোনের চাঁদকে মুহূর্তে আড়াল করে ফেলেছে। সিরাজ ও জাহিদা বেগমের মুখটা নিরব এক দুঃখের ছায়ায় নিমজ্জিত হলো। এমন দৃশ্য দেখে সিনহা বুঝতে পেরেছে, আব্বু–আম্মুর মনে হয় বুবুর কথা মনে পড়েছে।
সিনহা যখন গরম পিঠা মুখে দিয়েছিল, তখন তারও খুব বুবুর কথা খুব মনে পড়ছিল। খুব কষ্ট হচ্ছিল। আব্বু আম্মুকে বুবুর গরম পিঠা খাওয়ার কথাটা বলবে বলবে করে স্মৃতির জলে কিছুটা সাঁতরিয়ে আর বলতে পারিনি। না বললেও কি, আম্মু আম্মুকে স্মৃতিরা ছেড়ে দেয়নি। জোসনালোকিত আঙিনাটা ঘন অন্ধকারে ঢেকে দিয়েছে।