গণি মিয়া একজন দরিদ্র কৃষক। তাঁর নিজের কোনও জমি নেই। অন্যের জমিতে চাষ করে পরিবারের মুখের ভাত জোটান তিনি। প্রায়ই নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। আধপেটা খেয়ে না খেয়ে দিনাতিপাত করেন। ভাঙা ঘরের চাঁদের আলোয় স্বপ্ন ভর করে তাঁর ছানি পড়া চোখে। ছেলেটাকে মানুষ করবেন। তাঁর মতো করে জীবনটাকে কাদা পানিতে কাটিয়ে দিতে দেবেন না। প্রতিবেশীর ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। পাড়ায় তার কত নাম ডাক, কত সম্মান! বাবা– মায়ের গর্বের শেষ নেই। গণি মিয়া বৌ–এর সঙ্গে পরামর্শ করেন। প্রয়োজনে তাঁরা এক বেলা খাবেন। ছেলেকে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াবেনই। দেখতে দেখতে ছেলে তাঁর উচ্চ মাধ্যমিকে পা দেয়। স্বপ্ন পূরণ হল বলে। গণি মিয়া অপেক্ষার প্রহর গোনেন, আগামী দিনের জাল বোনেন।
এক সন্ধ্যায় পাড়ার চা–দোকানে খবরের কাগজ দেখেন গণি মিয়া। অনেকগুলো ভাঙা বাস, পোড়া আসবাব আর কয়েকজন আহত ছেলের ছবি ছাপানো হয়েছে কাগজে। তিনিতো আর পড়তে জানেন না। যিনি পড়ছিলেন তিনি জানান, এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছবি। আঁতকে ওঠেন গণি মিয়া; এসব কী করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছবি হয়? এতদিন মনে মনে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ছবি আঁকছিলেন তিনি, সেখানেতো কেবল বই আর বই, আর হাজার হাজার নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষার্থী ও শিক্ষক। ভাঙা গাড়ি, আগুন, আর রক্তাক্ত ছাত্রের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের কি সংযোগ থাকতে পারে? গণি মিয়ার কৃষক মাথায় তা ধরে না।
পত্রিকার পাঠক গণি মিয়াকে সবিস্তারে বুঝিয়ে বলেন। শার্টল ট্রেন দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে এত ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ। গণি মিয়া আগেই শুনেছেন– বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের যাতায়াতের জন্য চট্টগ্রাম শহর হতে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিদিন দিনে রাতে বেশ কয়েকটি রেলগাড়ি আসা যাওয়া করে। শার্টল ট্রেন নামের এই বাহনের খ্যাতি দেশের সীমা ছাড়িয়ে বিদেশেও পৌঁছে গিয়েছে। এ যেন এক কিংবদন্তী। প্রতি সকালে শিক্ষার্থী বোঝাই করে কু ঝিক ঝিক শব্দে শার্টল প্রবেশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমানায়। শার্টলের পেট হতে পিল পিল করে ধেয়ে আসা বিদ্যানুরাগী ছেলেমেয়েদের পায়ের আওয়াজ পেয়ে আড়মোড়া ভেঙে জেগে ওঠে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। গণি মিয়া শার্টলের ছবি দেখেছেন প্রতিবেশীর ছেলের মুঠোফোনে; তিল ধারনের ঠাঁই নেই ভেতরে বাহিরে। কেমন নিশ্চিন্তে নির্ভীক চিত্তে রেলগাড়ির ছাদে বসে ভ্রমণ করে ছেলেরা! ভয়ে বুক কেঁপে ওঠে গণি মিয়ার। পরক্ষণেই ভাবেন– দুরন্ত ওরা। একটু বেপরোয়া হলোই বা। প্রার্থনা করেন ওদের নিরাপদ ভ্রমণের জন্য।
কিন্তু সেই সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়গামী ট্রেনে ছাদে বসা জনা বিশেক ছেলে গাছের ডালের সাথে ধাক্কা খেয়ে আহত ও রক্তাক্ত হয়। কয়েকজন পড়ে গিয়েও আহত হয়। কয়েকজনকে মুমূর্ষু অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়া হয়। খবরটা স্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়ে। সহপাঠীর রক্তের বদলা নিতে সময় নেয় না ছেলেরা। হামলে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তির ওপর। আগুন জ্বালিয়ে, ফটকের আশপাশের ভবনসমূহ তছনছ করে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যায় তারা উপাচার্যের বাসভবনে। পাহাড়ের ওপর সুরক্ষিত সরকারি বাসভবনের আসবাবপত্র ভেঙে চুরে, পুড়িয়ে, লুটপাট করে ব্যাপক ধ্বংসলীলা চালিয়ে বীরদর্পে নেমে আসে পাহাড় হতে। এরপর ওদের গন্তব্য পরিবহন দপ্তর। শিক্ষকদের যাতায়াতের জন্য বাসগুলো দাঁড়িয়ে আছে কার্যালয়ের আশেপাশে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নামের অসীম শক্তিশালী অকুতোভয় সোনার ছেলেরা চোখের নিমিষেই ভেঙেচুরে দেয় বাসগুলোকে। ওরা ট্রেনের ছাদে রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা যাওয়া করে, আর শিক্ষকরা তাপানুকুল বাহনে ভ্রমণ করে। স্বাধীন দেশের গণতান্ত্রিক সমাজে এই বৈষম্যতো তারা চলতে দিতে পারে না। আফটার অল! তারাইতো আগামী দিনের জাতির কর্ণধার। নির্বাক পরিবহণ দপ্তর আর অদুরের পাহাড়গুলো শ্বাসরুদ্ধকর এই ঘটনার সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। প্রতিবেশী নিরাপত্তা দপ্তর হয়তো বোধশক্তি হারিয়ে ফেলেছিল অতর্কিত হামলায়। কোটি কোটি টাকার (খবরে প্রকাশ আনুমানিক ৩০ কোটি) জাতীয় সম্পদ তছনছ করে দিয়ে অবশেষে তাদের মনের খেদ মিটেছিল কি না, তা জানা হয়নি।
গণি মিয়া নির্বাক ও নিস্তব্ধ। বজ্রাহতের মতো থমকে যান কিছু সময়ের জন্য। ঘোর কাটার পর বাড়ির পথ ধরেন ধীর পায়ে। সে রাতে তাঁর ঘুম হয় না। পরদিন সকালে মন বসে না কাজে। এলোমেলো কাজে অর্থহীন একটা দিন কাটিয়ে সন্ধ্যায় চলে যান পাড়ার সমাজ সংঘ কার্যালয়ে। এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিগণ আসেন এখানে আলাপ করতে। দেশ, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, এমনকি বিশ্বরাজনীতি নিয়েও তাঁরা মত বিনিময় করেন। এই আসরে গণি মিয়ার প্রবেশাধিকার নেই। এ নিয়ে তাঁর দুঃখ নেই। দূরে দাঁড়িয়ে কান পেতে শোনেন জ্ঞানীগুণীদের যুক্তি তর্ক গল্প। আজ তাঁরা ইতোপূর্বে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে যাওয়া তাণ্ডব নিয়ে উচ্চস্বরে কথা বলছেন। তাঁদের কয়েকজন নেতাদের দায়ী করছেন, কেউ কেউ আবার শিক্ষকদেরও দোষ দিচ্ছেন। ওপরের কারও ইন্ধন ছাড়া ছাত্রদের এত সাহস পাওয়ার কথা নয়।
গণি মিয়া আরও স্তব্ধ হয় শোনেন– স্বার্থান্বেষীদের ওপরে ওঠার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহৃত হয় ছাত্ররা। একারণেইতো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্ররাজনীতি তুলে দেওয়া যাচ্ছে না। কথায় কথায় কখনও বাহান্ন, কখনও একাত্তরে ফিরে গিয়ে মানুষকে বোকা বানান এইসব ছদ্মবেশী নেতারা। ইতিহাসের দোহাই দিয়ে বিষফোঁড়াটাকে বাঁচিয়ে রাখতে মরিয়া তাঁরা। সহস্র কোটি টাকা ওড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আকাশে বাতাসে, যার ছিটেফোঁটা যায় ছাত্রনেতাদের ঝুলিতে। হাত সাফাইয়ের মাধ্যমে কামাই নিশ্চিত হলে কী দরকার আর লেখাপড়ার?
সমাজসংঘের সভ্যগণ বিশ্বাস করেন, বাংলাদেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থীই পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা পায় না। মানবেতর জীবন যাপন করে অনেকেই। আর্থিক সীমাবদ্ধতাতো থাকেই, সেই সঙ্গে থাকে কর্তৃপক্ষের অবহেলা। তহবিল তছরুপতো আমাদের চিরন্তন জাতীয় চরিত্র। আমরা একে অন্যের দিকে আঙুল তুলেই নিজের পাপ চাপা দিয়ে ফেলি। আলোচকগণ অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করেন কলমজীবীদর অনেকে সাফাই গাইছেন শিক্ষার্থীদের পক্ষে। অনেকটা এমন– আগুন দিয়েছে, গাড়ি ভেঙেছে– বেশ হয়েছে। কর্তৃপক্ষ বিপাকে পড়ায় তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছেন অনেকে। অন্যদিকে কর্তৃপক্ষ ঘটনার শুরুতেই কোনও রকম তদন্ত ছাড়াই বিলুপ্তপ্রায় বিরোধী পক্ষের ওপর দায় চাপিয়ে দায়মুক্ত থাকার বৃথা চেষ্টাও করেছেন। ‘অন্যের পাপ গনিবার আগে নিজের পাপ গোনা’ র কথা কেউ মনে রাখেনি, কেউ মনে রাখে না।
কেন কেউ বলছে না– কোন অব্যবস্থাপনাই ছাত্রদের এই বীভৎস, নারকীয় আচরণের পক্ষে যুক্তি দাঁড় করাতে পারে না। ওরা তো রাস্তার ছেলে নয়, পাড়ার মাস্তানও নয়। ওরা যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র; হাজার হাজার শিক্ষার্থীর সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রত্ব লাভ করে। শুধু কি তাই? দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত চষে ফেলে তারা কেবলমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে বলে। তাদের বেশির ভাগই প্রান্তিক পরিবারের সন্তান। জীবন যুদ্ধে সবার গল্প প্রায় একই রকম। পৃথিবীর নামীদামী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পার্থক্য এখানেই ওসব বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে বাবা মায়ের, পরিবারের, গ্রামের, সমাজের, সর্বোপরি দেশ ও জাতির আবেগ মেশানো থাকে না। সর্বজনীন এই আবেগ নিয়ে তাই ছলচাতুরি চলে না, তথাকথিত ‘খেলা’ও চলে না। কেন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জ্ঞানচর্চার পথ ভুলে ক্ষমতা ও পেশীশক্তি চর্চার কেন্দ্রভূমিতে পরিণত হচ্ছে, সে প্রশ্নের উত্তর আমাদের খুঁজে বের করতেই হবে। আমাদের জীবনে, কর্মে, আচরণে শিক্ষার শক্তি, সৌন্দর্য ও দর্শনকে ধারন করতে হবে।
জ্ঞানীগুণীদের আলোচনার যৎসামান্যই গণি মিয়ার কাছে বোধগম্য হয়। তবে তিনি মনস্থির করে ফেলছেন। আজ আর টলমল পায়ে নয়, দৃপ্ত পদে বাড়ি ফেরেন। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেন– ঐ বীভৎস যজ্ঞপুরিতে ছেলেকে পাঠাবেন না; রক্ত পানি করা টাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে মানুষ না হয়ে যদি এমন দানবে রূপান্তরিত হয় ছেলে! এই প্রথম গণি মিয়া লেখাপড়া না জানার দুঃখ ভুলে যান। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে যদি কলমের পরিবর্তে অস্ত্রের ব্যবহার হয়, শিক্ষক শিক্ষার্থী পরস্পরের প্রতিপক্ষ হয়, মানবিকতা, সহিষ্ণুতা, নৈতিকতার চর্চা না হয়, তাহলে পুরো দেশটাইতো অন্ধকারে তলিয়ে যাবে। কাদেরকে নিয়ে আমরা মানবিক সমাজ গড়ে তুলব? কাজ নেই আর দিন বদলের স্বপ্ন দেখে। দারিদ্রই তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ মুকুট। আজ রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে যান গণি মিয়া।
লেখক : প্রাবন্ধিক; অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।