বাংলাদেশ আজ এক অদ্ভুত সংকটের মুখোমুখি। আইন আছে, আদালত আছে, পুলিশ আছে, আবার জনতা নিজেই বিচারক হয়ে উঠেছে। প্রতিদিন খবরে দেখা যাচ্ছে গুজব, ছোটখাটো বিরোধ বা চুরি ছিনতাইয়ের অভিযোগে মানুষকে জনতার হাতে মার খেতে হচ্ছে। এমন কি প্রাণও হারাচ্ছে। এই গণরোষ ভিত্তিক সহিংসতা এখন আর বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং এটি ভয়াবহ সামাজিক প্রবণতায় পরিণত হয়েছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও আস্থাহীনতা এখন বাংলাদেশে নিত্য সঙ্গী। কোনো অপরাধ ঘটলে মানুষ স্বাভাবিকভাবে রাষ্ট্রীয় আইন ও বিচার ব্যবস্থার উপর নির্ভর করার কথা। কিন্তু বাস্তবতা হলো বছরের পর বছর মামলা ঝুলে থাকে, বিচার বিলম্বিত হয়, অপরাধীরা প্রভাব খাটিয়ে পার পেয়ে যায়। সাধারণ মানুষের কাছে তাই আদালত নয় বরং রাস্তার বিচারই দ্রুততম সমাধান মনে হয়। এর ফলে গণপিটুনি, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ সবকিছুরই এক ভয়ঙ্কর বিশৃঙ্খলার রূপ নেয়। কেন মানুষ এমন করছে? উত্তর একটাই– বিচারহীনতার সংস্কৃতি। কিন্তু এই গণরোষের পেছনের কারণ কী। ১. বিচার ব্যবস্থার ধীরগতি ও অকার্যকারিতা, ২. দুর্নীতি ও পক্ষপাতিত্ব ৩. সামাজিক হতাশা ও চাপ, ৪. গুজব ও ভুয়া তথ্য এবং ৫. রাষ্ট্রীয় শাসনের দুর্বলতা। গণরোষভিত্তিক সহিংসতা শুধু একটি ব্যক্তিকে হত্যা করে না, পুরো সমাজকে অস্থিতিশীল করে তোলে। এতে সাধারণ মানুষ রাস্তায় নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে, আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা নতুন প্রজন্মকে ভুল বার্তা দেয়। রাষ্ট্রের প্রতি আস্থা ক্ষয়ে যায়। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা নিরাপত্তার অভাবে ভীত হয়, অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এক কথায় এটি সামাজিক অবক্ষয় ও রাষ্ট্রীয় শাসনের ধসের বার্তা বহন করে। কিন্তু এভাবে সমাজ কি টিকে থাকতে পারে? ন্যায় বিচারের অভাবে শুধু অপরাধীকে নয়, পুরো সমাজকে অপরাধী করে তোলে। এতে নিরাপত্তাহীনতা বাড়ে, সামাজিক আস্থা ভেঙ্গে পড়ে, রাষ্ট্রের প্রতি বিশ্বাস নষ্ট হয়।
এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে এই মুহূর্তে আমাদের করণীয়: ১. দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা ২. আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা, ৩. গুজব প্রতিরোধ করা, ৪. সামাজিক নিরাপত্তা জোরদার করা, ৫. জনগণের প্রতি রাষ্ট্রের দৃঢ়বার্তা প্রদান করা ।
এখনই সময় রাষ্ট্রকে দৃঢ়বার্তা দেওয়ার—বিচার হবে আদালতে, রাস্তায় নয়। দ্রুত বিচার, স্বচ্ছতা ও আইন সবার জন্য সমানভাবে প্রয়োগ নিশ্চিত না করলেই এই গণরোষ আমাদের সমাজকেই গ্রাস করবে। গণরোষ কোন আকস্মিক প্রতিক্রিয়া নয়; এটি রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। ন্যায় বিচারের শূন্যতা ও আস্থা হীনতার ফসল হিসেবেই এই সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে। যদি রাষ্ট্র দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা না নেয় তবে সমাজে আইন–শৃঙ্খলা আরো ভেঙে পড়বে এবং মানুষ রাষ্ট্রের পরিবর্তে ভয়ঙ্কর ‘রাস্তা বিচারে’ বিশ্বাস করতে শুরু করবে। এখনই সময় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করে নাগরিকদের দেখিয়ে দেওয়ার যে, বিচার কেবল আদালতেই হয়, রাস্তায় নয়।