খৎনায় শিশুমৃত্যু দুর্ভাগ্যজনক

মো. শফিকুল আলম খান | বৃহস্পতিবার , ২৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ at ৬:৫৫ পূর্বাহ্ণ

একমাস সময়ের মধ্যে সুন্নতে খৎনা করতে গিয়ে কোমলমতী দুই শিশুর মৃত্যু এবং এক শিশুর পুরুষাঙ্গের অগ্রভাগ কেটে ফেলায় এদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা তথা ডাক্তারদের দায়িত্বহীনতা নিয়ে সারাদেশে শুরু হয়েছে সমালোচনার ঝড়।

গত ২০শে ফেব্রুয়ারি মতিঝিল আইডিয়েল স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র আহনাফ তাহমিন আয়হামকে খৎনার জন্য মালিবাগের জে এস ডায়গনস্টিক সেন্টারে ভর্তি করা হয়। সেখানে অ্যানেস্থেসিয়ার ভুল প্রয়োগে তার আর ঘুম ভাঙে নি। পরে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করে। একইভাবে সাতই জানুয়ারি ইউনাইটেড হাসপাতালে খৎনা করতে এসে প্রাণ প্রদীপ নিভে যায় শিশু আয়ানের। অ্যানেস্থেসিয়ার ভুল প্রয়োগের শিকার হয়ে প্রায় এক সপ্তাহ লাইফ সাপোর্টে থাকার পর সে মারা যায়। এই দুই শিশুর মৃত্যুতে তাদের পরিবার ও আত্মীয়স্বজনের আহাজারি টেলিভিশনে যারা দেখেছে তাদের চোখের পানি কেউ সংবরণ করতে পারে নি। এ শিশু দুটির মা বাবা এখন কী নিয়ে বাঁচবে? ছেলে দুটিকে নিয়ে তাদের সব স্বপ্ন চুরমার হয়ে গেছে। এখন কান্নাই হবে তাদের সারা জীবনের সম্বল। তাদের সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা অভিধানে খুঁজে পাওয়া যাবে না। এ ধরনের মৃত্যু খুবই অনাকাঙ্ক্ষিত ও দুর্ভাগ্যজনক। এর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে যাতে কারো অবহেলা ও দায়িত্বজ্ঞানহীনতায় আর কেউ অকালে প্রাণ না হারায়। এই শিশু দুটির মৃত্যুর রেশ কাটতে না কাটতেই গত বাইশ ফেব্রুয়ারি নোয়াখালীর কোম্পানিগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আরেক শিশুর পুরুষাঙ্গের অগ্রভাগ কেটে ফেলা হয়। এর আগে পায়ে হেঁটে হাসপাতালে আসা এক টগবগে যুবক রেজাকে এন্ডোস্কোপি করতে অতিরিক্ত অ্যানেস্থেসিয়ার ঘোর কাটতে না পারায় অকালে চলে যেতে হয় না ফেরার দেশে। ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসীরা শিশু সন্তানের বয়স সাত আট বছর হলে সুন্নত হিসেবে তাদের খৎনা করে থাকে। আমাদের সময়ে হাসপাতালে নিয়ে খৎনা করার সুযোগ ছিল না। স্থানীয় হাজাম তখন গ্রামের হাজার হাজার শিশুকে খৎনা করাতেন। আমাদের খৎনাও হাজামই করেছে। যতটুকু মনে পড়ে হাজাম বাঁশের খুবই সরু ধারালো চিকন কঞ্চি দিয়ে পুরুষাঙ্গের উপরের চামড়ার অগ্রভাগ কেটে ছাই বা স্থানীয় টোটকা জাতীয় কিছু ওষুধ লাগিয়ে কাপড়ের বেন্ডেজ করে দিতেন। এন্টিবায়োটিক বা অন্য কোনও ওষুধ দেয়া হত না। কয়েকদিন পর পর মায়েরা বা পরিবারের বড় কেহ কাপড়ের বেন্ডেজ বদলিয়ে গরম পানির সেক দিতেন। আমরা লুঙ্গি দুহাতে মেলে ধরে বাইরে হাঁটতাম যাতে পুরুষাঙ্গের সাথে লুঙ্গি না লাগে। মূলত তখন থেকেই হাফ প্যান্ট ছেড়ে আমাদের লুঙ্গি পরা শুরু।

খৎনা সাধারণত মুসলমানের পরিচয় বহন করে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সৈন্যরা রাস্তায় দাঁড় করিয়ে পুরুষের পরনের প্যান্ট বা লুঙ্গি ফাঁক করে দেখতেন কে মুসলমান বা কে অন্য ধর্মের। সে অনগ্রসর সময়ে হাজামের করা খতনায় কেউ মারা গেছে বলে কোনও সময় শুনা যায়নি। একবিংশ শতাব্দীতে এসে যখন দেশের স্বাস্থ্য চিকিৎসা সেবায় অভাবনীয় উন্নতি হয়েছে এবং আধুনিক প্রযুক্তির উদ্ভাবন হয়েছে সে সময় খৎনা করাতে পরপর তিনটি দুর্ঘটনা কোনও অবস্থাতেই কাম্য নয়।

পরপর ঘটে যাওয়া এই দুর্ঘটনাগুলো আমাদের দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা তথা ডাক্তারদের সেবা প্রদানে তাদের আন্তরিকতা, দক্ষতা নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে দেশের সিংহভাগ মানুষ এদেশের চিকিৎসা সেবায় নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছে। তাদের ওপর আস্থাহীনতার কারণে ধনাঢ্য ব্যক্তিরা সিংগাপুর ও ব্যাংকক এবং একটু সচ্ছল পরিবারের লোকজন পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে যান চিকিৎসা সেবা নিতে। এতে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা বৈধ এবং অবৈধভাবে বিদেশে পাচার হচ্ছে।

আমাদের দেশে, দক্ষ ও অভিজ্ঞতা সম্পন্ন চিকিৎসকের অভাব নেই। তাদের অনেকেরই দক্ষতা অন্য যে কোনও দেশের চিকিৎসকের তুলনায় ঈর্ষণীয়। তারা ইতোমধ্যে চিকিৎসার স্ব স্ব ক্ষেত্রে অসাধারণ অবদান রেখে সুনামের অধিকারী হয়েছেন। কিন্তু মুষ্টিমেয় কিছু চিকিৎসকের অতি মুনাফালোভী ও অনৈতিক আচরণ সমগ্র চিকিৎসক সমাজকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। স্বাস্থ্‌্য দপ্তরের অযোগ্যতা, অদক্ষতা, অব্যস্থাপনা, অনিয়ম, দুর্নীতি, জনবলের ঘাটতি, ব্যাঙের ছাতার মত অবৈধভাবে গড়ে উঠা বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার ইত্যাদি পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সংকটকে আরো ঘনীভূত করেছে। করোনাকালীন সময়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কিছু কর্মকর্তার আশ্রয় প্রশ্রয়ে শাহেদ ও ডাক্তার সাবরিনা ও তার স্বামীর উত্থান ও জোচ্চুরি কেলেঙ্কারি তখন সারাদেশে আলোচনার খোরাক ছিল। এই অধিদপ্তরের ড্রাইভার মালেকের শতকোটি টাকার মালিক হওয়া ও কেরানী আবজালের দেশে ছাড়াও কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে বাড়ি কেনার অনেক খবর তখন ছিল বিভিন্ন পত্রিকার শিরোনামে। এগুলো ছাড়াও পর্দার অন্তরালে থেকে যায় আরো শত শত অনিয়ম ও দুর্নীতির খবর। ডাক্তারদের বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে আন্তরিকতার অভাব, রোগীকে পর্যাপ্ত সময় না দিয়ে প্রেসক্রিপসন লিখে দেয়া, কমিশনের জন্য অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা দেয়া, হাসপাতালে নির্দিষ্ট সময়ে ডিউটি না করে বিভিন্ন ক্লিনিকে রোগী দেখা ও অপারেশন করা। তাদের বিরূদ্ধে আরো অভিযোগ হচ্ছে গর্ভধারী মহিলাদের স্বাভাবিক প্রসব না করিয়ে অপ্রয়োজনে অস্ত্রোপচার করা। বর্তমানে এই আস্ত্রোপচারের হার উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। অবশ্য সচ্ছল শ্রেণির কিছূ মহিলা প্রসব বেদনা থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্য অনেক সময় নিজেরাই অস্ত্রোপচারে সম্মতি প্রদান করে। অথচ গ্রামাঞ্চলে বা এমনকি শহরের বস্তীতে প্রতিনিয়ত মেয়েদের স্বাভাবিক ডেলিভারি হতে দেখা যায়। পঞ্চাশ ষাট বছর আগে গ্রামাঞ্চলে প্রতিটি মায়ের গড়ে সাত আটটি করে সন্তান হত। স্থানীয় ধাত্রীরা তাদের স্বাভাবিক ডেলিভারি করাতেন।

জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বাস্থ্য সেবাকে জনগণের দোড়গোড়ায় নিয়ে যাওয়ার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। করোনাকালীন সময়ে দেশের ষোল কোটি মানুষকে বিনা মূল্যে তিন ডোজ করে টিকা দিয়ে দেশে করোনায় মৃত্যুহার অন্য যে কোনও দেশের তুলনায় ন্যূনতম সীমায় রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। বর্তমানে মা ও শিশুর মৃত্যুহার আমাদের দেশে এ অঞ্চলের দেশগুলোর তুলনায় খুবই কম। একইভাবে সামগ্রিক স্বাস্থ্য সেবার সুফল হিসেবে আমাদের দেশের জনগণের আয়ুস্কাল অন্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি। স্বাস্থ্‌্য অধিদপ্তর তথা চিকিৎসকরা তাদের কাজে আরো নৈতিক ও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিলে আর কেউ ভুল চিকিৎসায় প্রাণ হারাবে না।

লেখক : প্রাবন্ধিক; বাংলাদেশ রেলওয়ের অবসরপ্রাপ্ত পরিচালক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআল্লামা শাহ্‌ সফিরুর রহমান হাশেমী নক্‌শবন্দী-মুজাদ্দেদী (রহ.)
পরবর্তী নিবন্ধড. মঈনুল ইসলামের কলাম