‘খোঁড়া পায়ে’ ম্যাক্সওয়েলের অবিশ্বাস্য ২০১

সেমিতে অস্ট্রেলিয়া, ক্যাচ মিসেই হারল আফগানিস্তান

ক্রীড়া প্রতিবেদক | বুধবার , ৮ নভেম্বর, ২০২৩ at ৬:১৪ পূর্বাহ্ণ

টানা তিন ম্যাচ জিতে উড়ছিল আফগানিস্তান। অস্ট্রেলিয়াকেও প্রায় ধরেই ফেলেছিল। কিন্তু আফগানদের কব্জা থেকে ম্যাচ একাই বের করে নিয়ে গেলেন গ্লেন ম্যাক্সওয়েল। আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে অস্ট্রেলিয়াকে একার হাতে জেতালেন। একটা সময় দৌড়তেই পারছিলেন না।

খোঁড়া পায়ে’ অবিশ্বাস্য ইনিংস খেলে অস্ট্রেলিয়াকে সেমিতে তুলে দিলেন। কথায় আছে, ক্রিকেট দলগত খেলা। এখানে একার হাতে ম্যাচ জেতানো যায় না। সেই পুরনো কথাই আরও এক বার অসত্য প্রমাণ করে দিলেন গ্লেন ম্যাক্সওয়েল। কীভাবে একার হাতে ম্যাচ জেতানো যায়, তা আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে প্রমাণ করে দিলেন তিনি। আগামী বহু বহু বছর, যখনই ক্রিকেটে কোনও দল রান তাড়া করতে নামবে, তখনই ম্যাক্সওয়েলের এই ইনিংস উদাহরণ হয়ে থাকবে। কীভাবে খাদের কিনারা থেকে কোনও দল ঘুরে দাঁড়িয়ে, প্রায় অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলে একটা ম্যাচ জিততে পারে, তার আদর্শ প্রমাণ হয়ে থাকবে আফগানিস্তান বনাম অস্ট্রেলিয়া ম্যাচ। নিজের ইনিংসের সিংহভাগটাই ম্যাক্সওয়েল খেলেন কার্যত ‘এক পায়ে’। শতরানের আগে থেকেই পায়ের পেশিতে টান ধরা শুরু হয়েছিল। যত ইনিংস গড়ল, তত সেই ব্যথা বাড়ল। কয়েক ওভার অন্তর মাঠের ধার থেকে ছুটে আসছিলেন অস্ট্রেলিয়ার সাপোর্ট স্টাফেরা। প্রথমে ম্যাসাজ, তার পরে ব্যথা কমানোর ওষুধ, চেষ্টা করা হল অনেক কিছুরই। কিন্তু কি অসম্ভব মানসিক জেদ। সেটা না থাকলে এই ইনিংস খেলা সম্ভব নয়। ম্যাক্সওয়েলের এই ইনিংসকে তাই অতিমানবীয় বললেও কম বলা হয়। এক দিনের ক্রিকেটে বহু দিন এমন ইনিংস দেখা যায়নি। আগে ব্যাট করে অনেকেই দাপট দেখিয়েছেন, অনেকেই দাপুটে ইনিংস খেলেছেন। কিন্তু রান তাড়া করতে নেমে, দলের শেষ ভরসাযোগ্য ব্যাটারকে নিয়ে প্রায় একার কাঁধে দলকে জেতানো, এ জিনিস অনেক দিন দেখা যায়নি। নবম ওভারে ম্যাক্সওয়েল যখন ক্রিজে এলেন, অস্ট্রেলিয়ার অবস্থা তখন বেশ খারাপ। ৪৯ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে ফেলেছে তারা। প্রথম দু’বলে ডেভিড ওয়ার্নার এবং জশ ইংলিসকে তুলে নিয়ে পিচে আগুন ঝরাচ্ছেন আজমাতুল্লা। তার হ্যাটট্রিক আটকানোই প্রথম কাজ ছিল ম্যাক্সওয়েলের। অফস্টাম্পে পড়া বল তার ব্যাটের কানায় লেগে থার্ড ম্যান এলাকা দিয়ে বাউন্ডারিতে চলে যায়। আফগানিস্তান মরিয়া হয়ে রিভিউ নিয়েছিল। পরিষ্কার দেখা যায় বল তার ব্যাটে লেগেছে। কিন্তু আত্মবিশ্বাসে ফুটতে থাকা আফগানিস্তান হাল ছাড়েনি। এক দিকে ম্যাক্সওয়েল টিকে গেলেও উল্টো দিকে একের পর এক উইকেট পড়তে থাকে। ৯১ রানে ৭ উইকেট হারিয়ে ফেলে তারা। তখন মনে হচ্ছিল, আফগানিস্তানের বিরাট জয় এবং আরও একটা অঘটন সময়ের অপেক্ষা মাত্র। কিন্তু ক্রিকেটবিধাতা এই ম্যাচের ভাগ্য অন্য রকম লিখে রেখেছিলেন তা কে জানত। ম্যাক্সওয়েল এর পর একটাই সুযোগ দিয়েছিলেন ৩৩ রানের মাথায়।

নুর আহমেদের বলে সুইপ করেছিলেন। শর্ট ফাইন লেগে লোপ্পা ক্যাচ মিস্‌ করেন মুজিব উর রহমান। ওই মিসের জন্যে তিনি সারাজীবন আক্ষেপ করবেন নিশ্চয়ই। ওই একটা ক্যাচই ম্যাচ থেকে ছিটকে দেয় আফগানিস্তানকে। ৯১ রানে ৭ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের সঙ্গে ছিলেন দলের অধিনায়ক প্যাট কামিন্স। সেখান থেকে দলকে টানলেন ম্যাক্সওয়েল। ৯১ রান থেকে দলকে ২৯২ রানে নিয়ে যান ম্যাক্সওয়েল। করেন দ্বিশতরান। ১২৮ বলে ২০১ রানের এক অবিশ্বাস্য ইনিংস। ম্যাক্সওয়েল দেখালেন ক্রিকেটকে কেন মহান অনিশ্চয়তার খেলা বলা হয়। সেখানে শেষ বল হওয়া পর্যন্ত কিছুই বলা যায় না। নইলে কে ভেবেছিলেন খেলার ছবি এভাবে বদলে যাবে। আফগানিস্তানের বোলিংকে নিয়ে ছেলেখেলা করছিলেন তিনি। মাঠের এমন কোনও কোনা নেই যেখানে শট মারেননি তিনি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কভার থেকে মিড উইকেটের দিকে ছক্কা হাঁকালেন। আবার তার সুইচ হিট থার্ড ম্যানের উপর দিয়ে বাউন্ডারিতে গিয়ে পড়ল। স্রেফ মনের জোর আর নিজের শটের প্রতি আত্মবিশ্বাস থাকলে কীভাবে শট খেলা যায় তা দেখালেন ম্যাক্সওয়েল। তার কোনও জবাব ছিল না আফগান বোলারদের কাছে। রশিদ খান থেকে শুরু করে নবীন উল হক, কেউ পারলেন না ম্যাক্সওয়েলকে ফেরাতে। বিশ্বকাপের ইতিহাসে সব থেকে বড় রান তাড়া করে জিতল অস্ট্রেলিয়া। এই জয়ের ফলে তৃতীয় দল হিসাবে বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে পৌঁছে গেল অস্ট্রেলিয়া। অন্য দিকে জেতার মুখ থেকে ম্যাচ হেরে নিজেদের সেমিফাইনালে যাওয়ার অঙ্ক নিজেরাই কঠিন করে ফেলল আফগানিস্তান। যদিও এখনও সুযোগ রয়েছে তাদের।

টস জিতে ব্যাট করতে নেমে আফগানিস্তানের ব্যাটিংকে টানলেন ইব্রাহিম জাদরান। এ বারের বিশ্বকাপে দলের সব থেকে ধারাবাহিক ব্যাটার এই ম্যাচেও রান করলেন। রহমানুল্লা গুরবাজ ২১ রান করে আউট হন। দলের মিডল অর্ডারের ব্যাটারদের সঙ্গে একের পর এক জুটি গড়লেন ইব্রাহিম। রহমত শাহ (৩০), শাহিদি (২৬), আজমাতুল্লা ওমরজাই (২২) প্রত্যেকে শুরু করলেও বড় রান করতে পারেননি। কিন্তু এক দিকে টিকেছিলেন ইব্রাহিম। ওপেন করতে নেমে শেষ পর্যন্ত টিকে থাকলেন। আফগানিস্তানের প্রথম ব্যাটার হিসাবে বিশ্বকাপে শতরান করলেন। শেষ ১০ ওভারে ৯৬ রান তুলল আফগানিস্তান। ইব্রাহিমকে সঙ্গ দিলেন রশিদ। প্যাট কামিন্স, মিচেল স্টার্কদের বল উড়ে গিয়ে পড়ে গ্যালারিতে। শেষ পর্যন্ত ৫০ ওভারে ৫ উইকেটে ২৯১ রান করে আফগানিস্তান। ইব্রাহিম ১২৯ ও রশিদ ৩৫ রান করে অপরাজিত থাকেন।

জবাবে ব্যাট করতে নেমে শুরুটা ভালো হয়নি অস্ট্রেলিয়ার। দ্বিতীয় ওভারেই নবীন উল হকের বলে শূন্য রানে আউট হন ট্রাভিস হেড। সেই শুরু। পাওয়ার প্লেতে মিচেল মার্শকেও আউট করেন নবীন। ডেভিড ওয়ার্নার শুরু থেকেই সমস্যায় ছিলেন। তাকে ফেরান আজমাতুল্লা। পরের বলেই শূন্য রানে আউট হন জশ ইংলিশ। লাবুশেন ভুল বোঝাবুঝিতে রান আউট হন। তাতে বড় ধাক্কা খায় অস্ট্রেলিয়া। রশিদ বল করতে এসেই আউট করেন মার্কাস স্টোইনিসকে। ৮৭ রানে ৬ উইকেট পড়ে যায় অস্ট্রেলিয়ার।

এই পরিস্থিতি থেকে ম্যাচ জেতা প্রায় অসম্ভব ছিল। কিন্তু সেখান থেকেই শুরু হল ম্যাক্সওয়েল রূপকথা। ভয়ডরহীন ক্রিকেট খেললেন তিনি। ম্যাক্সওয়েলকে ভাগ্যও সঙ্গ দিল। তার সহজ ক্যাচ পড়ল। কামিন্সকে সঙ্গে নিয়ে দলকে টানছিলেন ম্যাক্সওয়েল। যতক্ষণ তিনি ছিলেন ততক্ষণ সামান্য আশা টিকে ছিল অস্ট্রেলিয়ার। ক্রমশ ক্লান্ত হয়ে পড়ছিলেন তিনি। ফলে বড় শট খেলা শুরু করেন। মুম্বইয়ের ছোট মাঠ তার কাজ কিছুটা সহজ করছিল। ৭৬ বলে শতরান করেন তিনি। শেষ দিকে নড়তেও পারছিলেন না ম্যাক্সওয়েল। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে খেলছিলেন। তার পরেও প্রতি ওভারে চারছক্কা মারছিলেন। ম্যাক্সওয়েলকে দেখে বোঝা যাচ্ছিল, কতটা যন্ত্রণা হচ্ছে তার। কিন্তু লড়াই ছাড়েননি। যোদ্ধার মতো বুক চিতিয়ে লড়ছিলেন। লক্ষ্য যত কাছে আসছিল তত চাপ বাড়ছিল আফগানিস্তানের উপর। ফিল্ডিংয়েও ভুল করছিলেন তারা। শেষ পর্যন্ত ছক্কা মেরে দলকে জেতান ম্যাক্সওয়েল। ছক্কা মেরেই করলেন নিজের দ্বিশতরান। ১৯ বল বাকি থাকতে ম্যাচ জিতে নেয় অস্ট্রেলিয়া। আর ম্যাচ সেরা? ২০১ রানের অপরাজিত ইনিংস এবং ৫৫ রানে ১টি উইকেট শিকার করা ম্যাক্সওয়েল ছাড়া আর কেউ বা হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআজ থেকে আবার ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ বিএনপির
পরবর্তী নিবন্ধট্রাক চাপায় প্রাণ গেল হেলপারের