আমরা এখানে সম্পাদকীয়তে লিখেছিলাম, খেলা যেমন মানুষের পছন্দের মাধ্যম, তেমনি মেলাও। খেলা যেমন স্বাস্থ্যের জন্য বড় গুরুত্বপূর্ণ, মেলা তেমন বিনোদনের জন্য। খেলা মানসিক ও শারীরিক বিকাশ ঘটায়। এ জন্য মাঠের গুরুত্ব অপরিসীম। খেলা বন্ধ করলে শিশু ও যুবকদের শারীরিক বিকাশে আঘাত আসে। তেমনি মেলা আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ। এটি বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম। এজন্য খেলার মাঠের প্রতিবন্ধকতা যেমন প্রত্যাশিত নয়, তেমনি মেলার জন্যও নির্ধারিত স্থান থাকা দরকার।
নগরীর আউটার স্টেডিয়াম খেলার বদলে পরিণত হয়েছে মেলার মাঠে। কিন্তু দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের ফলে কর্তৃপক্ষ সেখানে মেলা বন্ধ করে দিয়েছিল। প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ‘আউটার স্টেডিয়াম একদিকে যেমন ঐতিহ্যের সাক্ষী তেমনি অপরদিকে অবহেলারও সাক্ষী। যে আউটার স্টেডিয়াম এক সময় মুখর থাকতো ক্রীড়াবিদদের পদচারণায় সেই আউটার স্টেডিয়াম গত দুই দশক ধরে যেন ক্রীড়াবিদদের জন্য নিষিদ্ধ এক জনপদ। কারণ গত দুই দশক ধরে আউটার স্টেডিয়ামে যত খেলা হয়েছে তার চাইতে বহুগুণ বেশি হয়েছে মেলা। যে আউটার স্টেডিয়ামে এক সময় স্টার সামার কিংবা স্টার যুব টুর্নামেন্টের মত বড় এবং দেশের ক্রিকেটারদের বহু কাঙ্ক্ষিত টুর্নামেন্ট হতো সে আউটার স্টেডিয়ামে গত দুই দশকে কোনও খেলাধুলার আয়োজনই হয়নি। অথচ এই আউটার স্টেডিয়ামকে রক্ষা করার জন্য কত আন্দোলন–ই না হয়েছে। একাধিকবার সংস্কার করা হয়েছে। কিন্তু দিন শেষে যেই কদু সেই লাউ। বরাবরই নানা মেলার দখলে চলে গেছে আউটার স্টেডিয়াম। কোনও পরিকল্পনাই দেখেনি আলোর মুখ। মেলা আয়োজনের পাশাপাশি, নানা গাড়ি, ডেকোরেশন কোম্পানির সামগ্রী রাখার নিরাপদ স্থানেও যেন পরিণত হয় আউটার স্টেডিয়াম। এরই মধ্যে আউটার স্টেডিয়ামের ভেতরেই নির্মাণ করা হয়েছে পাবলিক টয়লেট। চারদিকে গড়ে উঠেছে নানা স্থাপনা।’ এই প্রতিবেদনের পরে মেলা আয়োজন বন্ধ হয়ে যায়। পরে মেলা আয়োজন থেমে থাকেনি রেলওয়ে পলোগ্রাউন্ড মাঠে। গত ১৭ আগস্ট দৈনিক আজাদীতে আরেক প্রতিবেদনে আমরা জানতে পারি, সেখানে মেলা নয়, এখন শুধু খেলা হবে। এতে বলা হয়েছে, গত ৫ আগস্ট ছাত্র–জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটলে হঠাৎ করেই সুর পাল্টে ফেলে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। গত কয়দিন থেকে এই মাঠের প্রবেশ পথে একটা সাইনবোর্ড টানিয়ে দেওয়া হয়েছে। যাতে লেখা রয়েছে ‘রেলওয়ে পলোগ্রাউন্ড মাঠ কেবলই খেলার জন্য সংরক্ষিত’। এই সাইনবোর্ডটি দেখে অনেকে বিদ্রুপ করেছেন। গত বৃহস্পতিবার পলোগ্রাউন্ড মাঠে গিয়ে দেখা যায় এই সাইনবোর্ড দেখে অনেকেই নানা ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য করছেন। আবার অনেকেই প্রশংসা করছেন। তাঁরা বলেন, যাক পট পরিবর্তনে রেলওয়ে কর্মকর্তারা নিজেদের মত পরিবর্তন করেছেন যা খেলাধুলার জন্য লাভ হবে। যদিও মাঠটি এখনো খেলাধুলার উপযোগী নয়। সেই যে কবে একটি মেলা শেষ হয়েছে, অথচ এখনো মাঠে রয়ে গেছে ইট, পাথর সহ নানা সামগ্রী। মাঠের বিভিন্ন স্থানে রয়ে গেছে বালির স্তূপ। তারপরও মাঠে রেলওয়ের টানানো এমন সাইনবোর্ড দেখে উচ্ছ্বসিত শিশু–কিশোররা। কিছুদিন আগেও যারা এই মাঠে নামতে পারতো না এখন তারা অনায়াসেই খেলতে পারবে। তবে তার আগে মাঠটা সংস্কার চায় শিশু–কিশোর থেকে শুরু করে এলাকার তরুণ–যুবকরা। এ ব্যাপারে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) মোহাম্মদ নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘রেলওয়ে পলোগ্রাউন্ড মাঠ এখন শুধু খেলার জন্য সংরক্ষিত থাকবে। আপাতত এখানে কোনো মেলা চলবে না। শুধু খেলার জন্য সংরক্ষিত থাকবে এমন সিদ্ধান্ত হয়েছে।’
‘খেলার মাঠ‘ মানবসভ্যতার বিবর্তন ও ক্রমবিকাশের সাক্ষী। এক একটি খেলার মাঠ এক এক অঞ্চলের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও পরিবেশগত ইতিহাস। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সবাই খেলার মাঠের গুরুত্ব বুঝলেও কিছু মানুষ বাংলাদেশের সব খেলার মাঠ চুরমার করে দিচ্ছে। নগরায়ণ, শিল্পায়ন, দখল কিংবা অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে আমাদের স্মৃতিময় খেলার মাঠগুলো আজ বিপদে। খেলার মাঠ বাঁচাতে দেশজুড়ে আজ লড়ছে মানুষ। যদিও খেলার মাঠ রক্ষায় জনআন্দোলন নতুন ঘটনা নয়। খেলার মাঠে মেলা না হওয়ার সিদ্ধান্তে নগরবাসী অভিনন্দন জানাচ্ছে রেলওয়েকে। চট্টগ্রামে অন্যান্য মাঠে যেখানে খেলা বন্ধ হয়েছে, সেখানে রেলওয়ে পলোগ্রাউন্ড মাঠে মেলার আয়োজনে কমবেশি সবাই ক্ষুব্ধ ছিলেন। তাঁরা প্রত্যাশা করছেন যে এবার অন্তত মাঠটাকে খেলাধুলার উপযোগী করা হবে। আমরা চাই, শিশু কিশোর যুবক খেলোয়াড়দের পদভারে মুখরিত হোক এই মাঠ।