খুলছে স্বপ্ন ও সম্ভাবনার টানেল

যোগাযোগ আবাসন শিল্পায়ন পর্যটনে হবে গতি সঞ্চার

হাসান আকবর | শনিবার , ২৮ অক্টোবর, ২০২৩ at ৮:২৬ অপরাহ্ণ

কর্ণফুলীর তলদেশে স্বপ্নের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের দুয়ার খুলছে আজ। এই টানেল উদ্বোধনের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ায় ইতিহাস গড়ছে চট্টগ্রাম। আফগানিস্তান থেকে মালদ্বীপ পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকায় নদীর তলদেশে এটিই প্রথম টানেল। আগামীকাল থেকে এই টানেল দিয়ে শুরু হবে পুরোদমে যান চলাচল। আজ সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পতেঙ্গা প্রান্তে টানেল উদ্বোধন করবেন। এর পরপরই তিনি গাড়ি যোগে টানেল পার হয়ে আনোয়ারা প্রান্তের কোরিয়ান ইপিজেড মাঠে আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসমাবেশে ভাষণ দেবেন।

কর্ণফুলীর তলদেশে একটি টানেল নির্মাণের জন্য বহু আগ থেকেই দাবি জানানো হচ্ছিল। আলাপ আলোচনাও চলছিল বহু বছর ধরে। কর্ণফুলীর দক্ষিণ পাড়কে চট্টগ্রাম মহানগরীর সাথে যুক্ত করে চীনের সাংহাই’র আদলে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ গড়ে তুলতে এই টানেল নির্মাণের দাবি জানানো হয়েছিল। অবশেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীন সফরকালে এই টানেলটি নির্মাণের ব্যাপারে চীনের প্রেসিডেন্টের সাথে আলোচনা করেন। এরই প্রেক্ষিতে ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং যৌথভাবে বঙ্গবন্ধু টানেলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এর আগে প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য চীনের এক্সিম ব্যাংকের সাথে চুক্তি করা হয়। টানেলের বোরিং শুরু হয় ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টিউবের বোরিং কাজ উদ্বোধন করেন। প্রথমে ১৭ মাসে একটি টিউব এবং পরবর্তী ১০ মাসে খনন সম্পন্ন হয় দ্বিতীয় টিউবের। চীনের এঙ্মি ব্যাংক ২ শতাংশ সুদে ২০ বছর মেয়াদে ৫ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা ঋণ সহায়তাসহ সর্বমোট ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়েছে বঙ্গবন্ধু টানেল। চীনা নির্মাতা প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশনস কনস্ট্রাকশন কোম্পানি (সিসিসিসি) টানেলটি নির্মাণ করেছে। দেশী বিদেশী প্রকৌশলী এবং শ্রমিক কর্মচারীদের অংশগ্রহণে নির্মিত টানেলটি দেশের প্রকৌশল খাতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার দীর্ঘ টানেলের সাথে মোট সড়ক নির্মিত হয়েছে ৯.৩৯ কিলোমিটার। মূল টিউবের দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার। টিউব দুইটি সমান্তরালভাবে নদীর তলদেশ থেকে ১৮ মিটার থেকে ৩১মিটার গভীর ( পানির লেভেল থেকে ৪১ মিটার) দিয়ে পতেঙ্গা এবং আনোয়ারাকে যুক্ত করেছে। একটি টিউব থেকে অপর টিউবের দূরত্ব ১২ মিটার। তবে টিউব দুইটিতে যাতায়াতের চারটি পথ রয়েছে। ৩৫.৪ ফুট চওড়া ও ১৬ ফুট উচ্চতার টানেলের একটি টিউবের দুই লেনে একমুখী গাড়ি চলাচল করবে। অর্থাৎ একটি টিউব দিয়ে পতেঙ্গা থেকে আনোয়ারার দিকে গাড়ি যাবে, অপরটি দিয়ে আনোয়ারা থেকে পতেঙ্গায় আসবে। টানেলের ভিতরে সর্বোচ্চ ৮০ কিলোমিটার বেগে গাড়ি চালানো যাবে। এতে তিন মিনিটেরও কম সময়ে টানেল পার হওয়া সম্ভব হবে। টানেলের এই দুইটি টিউবের সাথে পতেঙ্গা ও আনোয়ারায় ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটারের এ্যাপ্রোচ রোড নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া ৭২৭ মিটারের একটি ওভারপাসও রয়েছে আনোয়ারা প্রান্তে।

স্বপ্নের এই টানেল দক্ষিণ চট্টগ্রামকেই শুধু নয়, বাংলাদেশকে ভিন্ন এক উচ্চতায় নিয়ে যাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলেছে, কঙবাজারসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামের শিল্পায়ন, আবাসন এবং পর্যটনে এই টানেল প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি ভূমিকা রাখবে। কঙবাজার চট্টগ্রামের দূরত্ব ৪০ কিলোমিটার কমিয়ে দেয়া ছাড়াও বঙ্গবন্ধু টানেলের মাধ্যমে প্রস্তাবিত এশিয়ান হাইওয়েকে ঢাকাচট্টগ্রামকঙবাজার মহাসড়কের সঙ্গে সংযুক্ত করবে। এই টানেল চট্টগ্রামকে শুধু দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসেই নয়, দেশের বার্ষিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি ০.১৬৬ শতাংশ বাড়াবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে। প্রতিদিন ১৭ হাজার ২৬০টি যানবাহন এই টানেল ব্যবহার করতে পারবে। বছরে চলাচল করতে পারবে প্রায় ৭৬ লাখ যানবাহন।

নির্মাতা প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন ও কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড (সিসিসিসি) আগামী ৫ বছর টানেলের যাবতীয় বিষয় দেখভাল করবে। ১১০টি সর্বাধুনিক সিসি ক্যামেরা দিয়ে টানেলে মনিটরিং কার্যক্রম পরিচালিত হবে। টানেলের টিউবের ভিতরে বিশেষ ধরনের হিট সেন্সর স্থাপন করা হয়েছে। এতে অগ্নিকাণ্ডসহ কোনো কারণে তাপ উৎপন্ন হলে ক্যামেরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ওইদিকে ফোকাস করবে। যা কন্ট্রোল রুমের মনিটরে তাৎক্ষণিকভাবে দেখা যাবে। দিনরাত ২৪ ঘণ্টা তাদের কুইক রেসপন্স টিম টানেলে বহাল থাকবে। টানেলের ভেতরে কোনো সমস্যা হলে তা দ্রুত নিরসন করা হবে। এদের সাথে বাংলাদেশ নৌবাহিনী, পুলিশের টিম থাকবে। ট্রাফিক পুলিশ যানবাহন চলাচলের ক্ষেত্রে শৃংখলা নিশ্চিত করবে। অগ্নিকাণ্ডসহ যে কোনো দুর্ঘটনায় তাৎক্ষণিক সহায়তা নিশ্চিত করতে টানেলের দুই প্রান্তে স্থাপন করা হচ্ছে প্রথম শ্রেণির দুটি ফায়ার স্টেশন।

চট্টগ্রামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি কী পয়েন্ট ইনস্টলেশন (কেপিআই) স্থাপনা হিসেবে টানেলের সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপই নেয়া হয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআরও ১৭ প্রকল্পের উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন আজ
পরবর্তী নিবন্ধটানেল ঘিরে উৎসবের আমেজ