‘পৃথিবী- তবে বিদায় দাও এবার’ উচ্চারণ করা কবিকে বিদায় জানালো এ-শহর। বিদায় জানালাম কবিতার মতন এক কবিকে। জনারণ্যে নিজস্ব বৃক্ষতল খুঁজে নিয়ে নিজের মধ্যে বিরাম নিতে পারা এক কবিকে। রুচিস্নিগ্ধ এক কবিকে। নিখুঁত হওয়াটা বড়ো কথা নয়। তার চেয়েও বড়ো আবশ্যক হলো সুচারু হতে পারা; ইংরেজিতে যাকে বলি ‘ফাইননেস’। খালিদ আহসানের কবিতা আমার প্রিয়, এটা বলতে পারার এটাই সবচেয়ে বড়ো কারণ, অন্তত আমার মতো পাঠকের কাছে। ওঁর কবিতাগুলো কবিতার গন্ধমাখা, বোধের অক্ষরগুলোর সুতীক্ষ্ম সৌন্দর্য আভা ছড়াতে থাকে একইসঙ্গে সুতীব্রভাবে এবং অতি মোলায়েমভাবে। ছোঁ মেরে নিতে হয় না, এমনিতেই গায়ে এসে পড়ে কবিতার অভয়ারণ্য। আমার কাছে ভালো কবিতা, প্রিয় কবিতা সেটাই, যে-কবিতার সাথে নিজের অনুভবের সংযোগ খুঁজে পাই অনায়াসে। আর সেই মুহূর্তে সেই কবিতার কবিও হয়ে ওঠেন প্রিয় কবি।
“ঈশ্বরের স্বপ্নের গভীরতা আমি জানি না। আমি তোমার গভীরতা মাপতে কুয়োর ভেতর রশি নামিয়েছি, শেষ হয় না… চোখে ধোঁয়াশা লাগে, পৌঁছে যাই হাজার বছর আগে যেখানে পৃথিবীর কোনো এক মানব-মানবী যূথবদ্ধ হয়েছিল, প্রণয় হয়েছিল… আমি সেই সন্তর্পণ স্থবির পাথরের উপর বসেছি- তুমি এসো।” পড়লেই মনে হয়, এ-তো আমার লিখবার কথা ছিল! যেন খালিদ আহসানের কলম লিখেছে আমারই কবিতা! এটুকু পড়ে আমি যেন সেই পাথরের ওপরেই বসে থাকি, বসে আছি আদি-অন্তহারা এক সময়কাল। এই কবিকে নিয়ে পাতার পর পাতা লেখার মতো ব্যক্তিগত সান্নিধ্য বা অতখানি স্মৃতি আমার নেই। স্মৃতি বলতে যা, তা হলো, কবিতাপাঠের আয়োজনে দেখাসাক্ষাৎ কিংবা সদলে নেমন্তন্ন খাওয়ার দুপুর-সন্ধ্যে। এতে কবির সঙ্গে চেনাশোনা হয়, জানাশোনা ততটা হয় না। চেনার পথ তো চেনাপথ, জানাটা হলো অগমযাত্রা। কবিকে তাই অতটা কাছ থেকে জানা হয়নি। অবশ্য তাতে কী এসে যায়! এই যে কল্পনায় ওঁর কবিতা-পাথরের পাশে বসে থাকা, এ-ও তো কম কিছু প্রাপ্তি নয়। এইটুকু সান্নিধ্যের জেরে সারাদিন ধরে বেদনার মতো হৃদয়তন্ত্রীতে বেজে চলেছেন, বিদায়-বিষাদ একবিন্দু কম অনুভব করিনি। কবিতার জয় এখানেই। কবির অমরত্ব এখানেই।
খালিদ আহসানের কবিতার মতোই ওঁর কবিতাপাঠ আমাকে টানতো। কেমন ধীর, শান্ত, স্থির। কত কত কবিতাপাঠের আয়োজনে অনেক রাত পর্যন্ত বসে থেকেছি শুধু তাঁর কণ্ঠে কবিতাপাঠটি শুনে তারপর ফেরবার জন্য। ২০১৯ এর নভেম্বরে কবির জন্মদিনে খড়িমাটি আয়োজন করেছিল এক ঘরোয়া আড্ডা। শুভেচ্ছা জানাবার চেয়েও বেশি টেনেছিল কবির কণ্ঠে কবিতাপাঠ! জন্মদিনের আয়োজন, আনন্দে ভরপুর থাকবার কথা। অথচ কবির কণ্ঠে বইছিল এক বিষাদনদী! আর আমিও কেমন ভেসে ভেসে যাচ্ছিলাম সেই নদীভ্রমণে… “ভ্রমণের জন্য একটি বিশ্বস্ত আত্মার প্রয়োজন- যে টেনে শরীর থেকে বের করে নেবে এবং পরিচর্যার পর ফিরিয়ে দেবে। অতঃপর ঘুম অথবা বিশ্রাম।” আহা!
সকালেই কবি ছিল একটি নাম। দুপুর না গড়াতেই হয়ে গেল ‘মরদেহ’! কুৎসিত! মৃত্যু এতটাই কুৎসিত! অথচ তিনিই তো লিখেছিলেন, “মৃত্যু এক অনিবার্য বিমূর্ত শিল্প!” কবিরা মৃত্যুকে এত সুন্দর কল্পনার পোশাক পরাতে পারেন ব’লেই বোধহয় কবিরা মরে না। মানুষ মরে যায়। আর কবিরা মরে না ব’লেই শরীরে বিষম টান লাগার পরেও কলমের নিচে অন্ধকারকে ঘোচাতে পারেন।
কবি, আপনার শান্তি হোক। চিরশান্তিতে থাকুন আপনার লেখা কবিতায়, আপনার আঁকা ছবিতে। শক্তির একটি কবিতায় পড়েছিলাম, “তোমার মুখ দেখলে মনে হতো কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে। কপালের সন্ন্যাসের নিচে কেমন দিঘির মতন চোখ ছিল তোমার। দিঘির পাড়ে তালপাতার বাড়িটি বড় খেটেখুটে তৈরি করা। অদূরে বিলাসী অথচ সুকুমার তালধ্বজ… এই ঠুনকো জীবনচারিতায় কোনো যোগ ছিল না তোমার”। আজ চৈত্রের এই অকরুণ দুপুরে, আপনার বিদায় অপরাহ্ণে মনে হলো, কবি কি আপনাকে ভেবেই লিখেছিলেন!