প্রায় মাসব্যাপী দাবদাহে চট্টগ্রামের পোল্ট্রি খামারগুলোতে প্রতিদিনই শত শত মুরগি মারা যাচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে নানামুখি সংকটে থাকা পোল্ট্রি শিল্পে এই তাপদাহ বড় ধরনের বিপর্যয়ের সৃষ্টি করছে। ইতোমধ্যে বহু খামার বন্ধ হয়ে গেছে। গরমের দাপট অব্যাহত থাকলে এই শিল্প আরো বড় ধরনের ক্ষতির শিকার হবে বলেও সূত্র জানিয়েছে।
বৃহত্তর চট্টগ্রামে ত্রিশ হাজারেরও বেশি মুরগির খামার রয়েছে। বাসা বাড়ির ছাদ থেকে শুরু করে ঘরের আঙ্গিনায় খামার গড়ে তুলে বহু শিক্ষিত বেকার যুবক নিজের কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি স্থানীয় বহু শ্রমিকের কাজের ব্যবস্থা করেছেন। বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে গড়ে তোলা এই শিল্পে চট্টগ্রামে অন্তত দুই হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে। হ্যাচারি থেকে বাচ্চা কিনে নিয়ে খামারে লালন পালন করে বিক্রি করাই অধিকাংশ খামারের ব্যবসা। আবার কোনো কোনো খামারে মুরগির ডিম উৎপাদন করেও বিক্রি করা হয়ে থাকে। মুরগির খামারগুলোতে একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রা রাখতে হয়। ফার্মের মুরগিগুলো কোনোমতেই গরম সহ্য করতে পারে না। এজন্য খামারগুলোতে বড় বড় ফ্যান লাগিয়ে সারাক্ষণ মুরগির গায়ে বাতাস দেয়া হয়। কিন্তু গত ৩১ মার্চ থেকে দেশব্যাপী শুরু হওয়া দাবদাহের মাঝে মুরগির খামারগুলোতে তাপমাত্রা
নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব হয়ে উঠে। বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের কারণে গ্রামগঞ্জে গড়ে উঠা খামারগুলোতেও মুরগি মরতে শুরু করেছে। এ কারণে খামারগুলো বন্ধ হওয়া শুরু হয়েছে। চড়া দামে বাচ্চা কেনা এবং খাবার কিনে তিল তিল করে বড় করা মুরগির বাচ্চাগুলো গরম সহ্য করতে না পেরে মরতে থাকে। শুধু বাচ্চাই নয়, ১৫/২০ দিন থেকে শুরু করে এক মাস বয়সী মুরগিও মরছে। খামারগুলোতে এক মাস থেকে এক মাস ৫/৭দিন পর্যন্ত মুরগি বড় করে বিক্রি করা হয়। গরমে এখন ছোটবড় সব মুরগি মরতে শুরু করেছে। এতে খামারিদের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ছে। গতকাল সীতাকুণ্ডের হারুনুর রশীদ নামের একজন খামারি বলেন, আমার দুই হাজার মুরগির একটি খামার রয়েছে। আমি গরমের শুরুতে দুই হাজার মুরগির বাচ্চা দিয়েছি। কিন্তু পরদিন থেকে বাচ্চা মরা শুরু হয়েছে। এখন সবমিলে শ’ পাঁচেক মুরগি রয়েছে। এগুলোও ৩০দিন পর্যন্ত বাঁচে কিনা তা বলতে পারছি না। তিনি বলেন, আমি শেষ হয়ে গেছি। এক একটি মুরগির পেছনে আমার দুইশ’ টাকার উপরে খরচ পড়ে গেছে।
আমার চার কক্ষের খামারটিতে ১৬টি স্ট্যান্ড ফ্যান রয়েছে। আমি বেশ কয়েকটি সিলিং ফ্যানও লাগিয়েছি। কিন্তু কোনো কিছুতেই গরমের দাপট থেকে মুরগিগুলোকে রক্ষা করতে পারিনি। গরমের পাশাপাশি লোডশেডিং খামারের জন্য কাল হয়ে দেখা দিয়েছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন। কি করে আবার বাচ্চা দেবেন, কি করে দেনা শোধ করবেন, দোকান থেকে বাকিতে আনা খাবারের দাম কোত্থেকে দেবেন তা নিয়ে তার রাতে ঘুম হয় না বলেও উল্লেখ করেন।
অপর একজন খামারি বলেন, আমি শেষ হয়ে গেছি। গরমের দাপট কমাতে মুরগির গায়ে ক্রমাগত পানি স্প্রে করার জন্য লোক নিয়োগ করেছি। রাতে দিনে পানি স্প্রে করা হয়েছে। কিন্তু আমার খামারে কয়েকশ’ মুরগি মরে গেছে। তিনি বলেন, প্রচণ্ড গরমের মাঝে মুরগিগুলো ছটফট করে করে মারা যাচ্ছে। স্ট্রোক করে মারা যাচ্ছে।
আনোয়ারা এলাকার একজন খামারি বলেন, গরমের কারণে অস্থির হয়ে পড়েছে খামারের সব মুরগি। নানাভাবে চেষ্টা করেও কোনোভাবেই খামারের গরম নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছে না। মুরগির বেঁচে থাকার উপযোগী পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে না। গরম শুরুর পর থেকে মুরগিকে ওষুধ ও স্যালাইন দেয়া হচ্ছে। উপজেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগের পরামর্শ অনুযায়ী খাবারও কম দেয়া হচ্ছে। কিন্তু কোনো কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। খাবার কম দেয়ার কারণে যে কটি মুরগী বেঁচে আছে সেগুলোতেও ওজন আসেনি। তিনি বলেন, পোল্ট্রি খামারে মুরগি বাড়ে খাবার খেয়ে। একদিন বয়সী একটি মুরগি ৩০দিনে ২ কেজি খাবার খায়। এতে মুরগিটি এক কেজি কিংবা সামান্য বেশি ওজন হয়। কিন্তু খাবার কমিয়ে দেয়ায় মুরগি আর বাড়ছে না। তিনি বলেন, যে হারে খামারে মুরগি মরেছে তাতে এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখাই দায় হয়ে পড়বে।
জেলা প্রাণী সম্পদ বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, আমরা খামারিদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলেছি। কিন্তু এমন টানা অসহনীয় গরমের মাঝে মুরগি বাঁচিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, আসলে খামারিদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে উঠেছে। তিনি খামারিদের টিনের চালের উপর বস্তা বিছিয়ে তাতে পানি দেয়া, মুরগির শরীরের উপর সরাসরি স্প্রে করা এবং মুরগিগুলোকে স্যালাইনসহ ভিটামিন সি জাতীয় খাবার বেশি খাওয়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন।