খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধে ভূমিকা পালন করতে হবে

তরুণ কান্তি বড়ুয়া | রবিবার , ২৮ জানুয়ারি, ২০২৪ at ৬:০৩ পূর্বাহ্ণ

আজকালকার দিনে খাদ্যে ভেজাল প্রসঙ্গটা সর্বস্তরের জনগণের মাঝে একটি মারাত্মক ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিবেশ দূষণ, বায়ু দূষণ, পানি দূষণ ও শব্দ দূষণ যেমন জনজীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে তেমনি খাদ্যে ভেজাল অপকর্মটি জনজীবনে এক নীরব ঘাতক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। শহর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে এ সমস্যাটা প্রকটভাবে বিস্তৃতি লাভ করেছে। লোভী মুনাফাখোর অসাধু ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফা লাভের আশায় খাদ্যদ্রব্যের সাথে নিম্ন মানের উপাদান মেশানোর মাধ্যমে খাদ্যে ভেজাল করে থাকে। কাজটি নিন্দনীয় ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ জেনেও অসাধু ব্যবসায়ীরা খাদ্যদ্রব্যের সাথে ভেজাল দ্রব্যাদি মিশিয়ে এ জঘন্য কাজটি করে থাকে। অসাবধানতা বশত অনেকসময় অনেককিছু খাদ্যদ্রব্যের সাথে মিশে খাদ্যে ভেজাল ঘটিয়ে থাকে। কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ী ও মুনাফাখোর ব্যক্তিরা ইচ্ছাকৃত ভাবে খাদ্যে ভেজাল মিশিয়ে মারাত্মক বিপদ ঘটিয়ে থাকে। সাধারণত খাবারের ঔজ্জ্বল্য বাড়াতে এবং ওজন বাড়াতে খাদ্যদ্রব্যের সাথে কৃত্রিম রং, চাল ডালের সাথে কাঁকর বালি, দুধের সাথে নিম্ন মানের পাউডার মেশানো হয়। ফলমূল, মাছ, সবজি ইত্যাদি দীর্ঘসময় ধরে সতেজ রাখার জন্য ফরমালিন ও অন্যান্য রাসায়নিক ব্যবহার করা হয় যা মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে থাকে। তাছাড়া ওজন ও ঔজ্জল্য বাড়াতে মরিচের গুঁড়ো, হলুদের গুড়োতে ইটের গুড়ো এবং নানান পাউডার মেশানো হয়। খাদ্যদ্রব্যে সাধারণত এমাইলাম, ইউরিয়া, ফরমালিন, ক্যালসিয়াম, কার্বডাই মেশানো হয় যা মানবদেহের জন্য ভীষণ ক্ষতিকর। এসব ক্যামিকেল মেশানোর পর খাবারের গুণগত মানও নষ্ট হয়ে যায়।

খাদ্যে ভেজাল এখন আমাদের দেশে একটি জাতীয় সমস্যায় পরিণত হয়েছে। অত্যধিক লোভের বশবর্তী হয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা খাদ্যে ভেজাল দিয়ে মানুষের জীবনকে সংকটের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। বেকারির পণ্য এবং খাবার কেবল ভেজাল উপকরণ দিয়ে তৈরি হয়না, নানান বিষাক্ত রাসায়নিকও এতে মেশানো হয়। এসব ভেজাল খাবার মানুষের শরীরের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। ক্যামিকেল মিশ্রিত ভেজাল খাবার মানুষের কিডনি ও লিভারের যথেষ্ট ক্ষতি করে। কাজেই ভেজাল খাদ্য মানুষের শরীরের জন্য ক্ষতিকর বিধায় মানুষ ক্যান্সারসহ নানারকম দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত হয়। তাছাড়া অনিদ্রা, কোষ্ঠকাঠিন্য, রক্তস্বল্পতা ও মানসিক প্রতিবন্ধকতার কারণও ভেজাল খাদ্যে নিহিত। সামপ্রতিক এক গবেষণায় দেখা যায় ভেজাল খাদ্য শিশুর মানসিক বিকাশ ব্যহত করে থাকে। এ সমস্যা হৃদরোগ ও উচ্চ রক্তচাপেরও কারণ হতে পারে। আমাদের জনজীবনে বহুবিধ সমস্যার মাঝে অন্যতম সমস্যা হলো খাদ্যে ভেজাল প্রক্রিয়ার বিরূপ প্রতিক্রিয়া। নিত্য ব্যবহার্য খাদ্যদ্রব্যে নির্বিচারে ভেজাল মিশ্রণের কারণে মানুষের জীবনযাপন প্রণালি আজ চরম হুমকির মুখোমুখি। খাদ্য, পানীয় ও নানারকম ক্ষতিকর খাদ্যদ্রব্য খেয়ে মানুষ অসুস্থ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। স্বার্থপর মানুষের কাছে অন্যের মঙ্গলের বিষয়ে ভাবার কোনো সুযোগ নেই। সততা ও মানবিকতা বোধের স্থান অসাধু ব্যক্তির স্বার্থ চিন্তায় ঢাকা পড়ে গেছে। বিবেকবুদ্ধি বিসর্জন দিয়ে এসব লোক শিশুখাদ্য ও রোগীর ওষুধেও ভেজাল মেশাতে কুন্ঠা বোধ করে না।

খাদ্যে ভেজাল সমস্যাটি আমাদের দেশে দিনদিন বেড়েই চলেছে। একশ্রেণির স্বার্থান্ধ ও অর্থ লোলুপ মানুষেরা খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল মিশিয়ে সচেতন মহলকে কোণঠাসা করে ফেলেছে। বাজার থেকে ক্রয় করা প্রতিটি খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল মেশানো থাকে। এমন কোনো খাদ্যদ্রব্য পাওয়া যাবে না যা কোনোভাবে ভেজালমুক্ত বলে নিশ্চিত হওয়া যাবে। জনজীবনে ভেজাল খাদ্যের অনেক খারাপ প্রভাব রয়েছে। সাধারণত এসব ভেজাল খাবার স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর যার ফলে জটিল স্বাস্থ্যসমস্যা যেমন হজম সমস্যা, ডায়রিয়া, আমাশয়সহ নানান দুরারোগ্য ব্যাধির জন্ম দেয়। এসব ভেজাল খাদ্যের নীরব বিষক্রিয়া ধীরে ধীরে মানুষকে মৃত্যুর কোলে পৌঁছিয়ে দেয়। খাদ্য ভেজাল ভীতির কারণে কোনো খাদ্য আমাদের জন্য নিরাপদ নয়। ঢাকা নগরীর কিছু এলাকায় দুধ, মাছ, শাকসবজী ও ফলমূলের উপর পরিচালিত সামপ্রতিক এক জরীপে দেখা যায় ৪০%-৮২% সংগৃহীত নমুনায় ডিডিটি, এলড্রিন ও অন্যান্য বিষাক্ত রাসায়নিক খুঁজে পাওয়া যায়।

খাদ্য মানব জীবনের মৌলিক চাহিদা। কাজেই স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন, সর্বোপরি নিরাপদ জীবন রক্ষার জন্য বিশুদ্ধ, পুষ্টিকর ও ভেজালমুক্ত খাবার খাওয়া প্রয়োজন। জনস্বাস্থ্য রক্ষার স্বার্থে খাদ্যদ্রব্য কে ভেজালমুক্ত রাখার লক্ষ্যে সরকার, সচেতন নাগরিক এবং সর্বস্তরের জনগণকে শক্ত প্রতিরোধী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ভেজাল প্রতিরোধ কার্যক্রমের সফল বাস্তবায়নে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাকে আরো কঠোর ভূমিকা পালন করতে হবে। খাদ্যে ভেজাল অপকর্মটি প্রতিহত করার লক্ষ্যে জনগণের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে এবং সকলের সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে ভেজাল বিরোধী আন্দোলনকে সামাজিক আন্দোলনে পরিনত করতে হবে। এটি স্পষ্টত প্রতীয়মান যে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় কঠোর নজরদারি এবং সতর্কতা খাদ্যে ভেজাল সমস্যাটি অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। জীবন রক্ষার্থে আমাদেরকে খাবারের মান বিচারপূর্বক খাঁটি ও সতেজ খাবার বেছে নিতে হবে এবং ভেজাল খাবার বর্জন করে নিজের জীবনসহ পরিবার ও সমাজের সকল শ্রেণির জনগণের জীবন রক্ষার জন্য সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।

ভেজালের পরিধি যেভাবে লাগামহীন ভাবে বেড়ে চলেছে তা থেকে সমাজ তথা জাতিকে বাঁচাতে ইতিবাচক সমন্বিত প্রচেষ্টার কোনো বিকল্প নেই। প্রতিরোধের লক্ষ্যে ক্রেতা সাধারণকেও যথাযথ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। সাথে সাথে সরকারকে কঠোর কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। খাদ্যের গুণগত মান নিরুপণে নমুনা পরীক্ষা করার জন্য প্রত্যেক উপজেলা ও জেলায় ভেজাল নিরীক্ষণ পরীক্ষাগার স্থাপন করা প্রয়োজন। প্রশাসন এবং ক্রেতাদের সমন্বিত প্রচেষ্টাই পারবে ভেজাল বিরোধী কর্মসূচি সফল করতে। অতএব জনস্বাস্থ্য রক্ষার স্বার্থে যেকোনো মূল্যে ভেজাল বিরোধী প্রতিরোধ সৃষ্টি করে ভেজাল খাদ্যদ্রব্যের বিপনণ প্রতিহত করতে হবে। খাদ্যে ভেজাল সমস্যাটি বন্ধ করণে খোলা বাজারে অধিক সংখ্যক ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা প্রয়োজন এবং খাদ্যে ভেজাল প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে বড় অঙ্কের জেল জরিমানাসহ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এ ধরনের কঠোর শাস্তির বিধান নিশ্চিত করা গেলে ভেজাল কারী খাদ্যে ভেজাল মেশানোর দুঃসাহস দেখাতে পারবেনা। এমনটা করা হলে এ ঘৃণিত অপকর্মটি ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাবে এবং জনগণ বিষ মুক্ত খাবার খেয়ে স্বাস্থ্যসম্মত জীবন যাপন করতে সমর্থ হবে।

খাদ্যে ভেজাল সমস্যাটি একটি অসহনীয় ভীতিকর বিষয় যা অসহায় ক্রেতাদেরকে প্রতিনিয়ত প্রতারিত করে চলছে। অনেক গভীরে প্রোথিত খাদ্যে ভেজাল সমস্যাটি সরকারের একার পক্ষে সমাধান করা মোটেও সম্ভব নয়। সরকারের পাশাপাশি সাধারণ জনগণকে সচেতন হতে হবে। খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধ করা আমাদের সর্বোত্তম প্রচেষ্টা হওয়া প্রয়োজন। লোভী মুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের অশুভ কর্মকাণ্ড থেকে বিরত রাখতে সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সময়োচিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সতেজ স্বাভাবিক খাদ্য সম্পর্কে ক্রেতাদের সঠিক ধারণা থাকতে হবে। উজ্জ্বল অস্বাভাবিক দৃশ্যনীয় ভেজাল দ্রব্যাদি ক্রয়ে ক্রেতাদের সতর্ক থাকতে হবে। এসব বিষয়ে স্বস্তিবোধ ফিরে পেলে আমাদের নিজেদের এবং সমগ্র জাতিকে খাদ্যে ভেজাল সংকটের ক্ষতিকর থাবা থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে। কাজেই খাদ্যে ভেজাল সমস্যাটির বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামা আমাদের সকলের কাছে সময়ের দাবি। সমন্বিত প্রচেষ্টা এবং শ্রমের মাধ্যমে জীবন বিধ্বংসী খাদ্যে ভেজাল সমস্যাটির অভিশপ্ত ধ্বংসযজ্ঞ থেকে সহসাই রক্ষা পাই, এটিই হোক সকলের আন্তরিক প্রত্যাশা।

লেখক : শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক; প্রাক্তন অধ্যক্ষ,

রাংগুনিয়া সরকারি কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধসমকালের দর্পণ