কি ছিল ওখানে? বিশ্ববিদ্যালয় নাকি বন্দিশালা? এসব প্রশ্ন বার বার ঘুরে ফিরে আসছে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ সংশ্লিষ্ট ও স্থানীয়দের মাঝে। এ প্রশ্নের সূত্র ধরেই গত ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে কর্ণফুলীর দেয়াঙ পাহাড়ে মাটি খনন কাজ শুরু করে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর চট্টগ্রাম। কিন্তু ২৭ দিন ধরে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের মাটি খননে সেই প্রাচীন নিদর্শনের রহস্য উন্মোচন করা যায়নি। তবে মাটি খুঁড়তেই বেরিয়ে আসছে হাজার বছরের পুরানো চওড়া ইটের দেয়াল ও মেঝেসহ বিভিন্ন স্থাপনার আলামত।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর জানিয়েছে, গত ১৬ সেপ্টেম্বর শনিবার থেকে কর্ণফুলী উপজেলার দেয়াঙ পাহাড়ে চলছে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের কাজ। এই খনন কাজ করার জন্য স্থানীয় ও মহাস্থানগড়ের অভিজ্ঞ ২০–২৫ জন শ্রমিক নিয়োজিত আছে। তাদের মধ্যে ১০ জন বগুড়া থেকে আনা। চলতি মাস পর্যন্ত চলবে খনন কাজ।
জানা যায়, ১৫১৮ সালে পর্তুগিজ বণিকরা চট্টগ্রামে এসে দেয়াঙয়ে বসতি স্থাপন করেন। একসময় আরাকান রাজাদের রাজধানী ছিল এ দেয়াঙ। এখানে তারা একটি কারাগারও তৈরী করেছিলেন। ইতিহাস থেকে আরও জানা যায়, সেই কারাগারে কবি আলাওলকে বন্দি করে রেখে ছিলেন তারা। সুলতান গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহ সামরিক সাহায্যের বিনিময়ে ১৫৩৭ সালে পর্তুগিজ বণিকদের দেয়াঙ পাহাড়ে কুঠি ও গির্জা নির্মাণের অনুমতি দেন। মোগল আমলে আরাকানি সৈন্যরা ফিরিঙ্গি বন্দর ও ফিরিঙ্গি পল্লীর কাছে তিনটি ঘর তৈরি করে। ১৬৬৬ সালের দিকে মোগল সেনারা আরাকানিদের পরাজিত করে দেয়াঙয়ে বিভিন্ন স্থাপনায় আগুন ধরিয়ে দেয়। ধারণা করা হয়, তখন এখানকার রাজাদের পতন ঘটে এবং তারা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। জায়গাটা এখন স্থানীয়দের মাঝে ‘দেয়াঙ পাহাড় বিশ্বমুড়া’ নামে পরিচিত। ফলে এখানে থাকতে পারে মহাস্থানগড়ের মত বৌদ্ধ পুরাকীর্তি।
প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ সূত্র জানায়, জনশ্রুতি মতে কর্ণফুলীর এ দেয়াঙ পাহাড়ে আরাকান রাজাদের বসতি ছিল। এসময় সেখানে বিভিন্ন স্থাপনা ও অবকাঠামো ছিল। ষোড়শ শতকের দিকে আরাকান রাজার পরাজয়ের পর এসব বিলুপ্ত হয়ে যায়। বর্তমানে সেখানে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ও অনুসন্ধানের কাজ চলছে। খনন ও অনুসন্ধান শেষে বুঝা যাবে আসলে কি ছিল। কর্ণফুলীসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামে এটিই প্রথম প্রত্নতাত্ত্বিক খননকাজ। দুইজন কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে বগুড়ার মহাস্থানগড় থেকে আনা অভিজ্ঞ ব্যক্তি ও শ্রমিকদের। শ্রমিকরা অতি সতর্কতার সঙ্গে কাজটি করছেন। কাজ শুরুর এক সপ্তাহের মধ্যে কয়েকটি চওড়া দেওয়াল আর মেঝের অস্তিত্ব পাওয়া যায়।
স্থানীয়রা বলছেন, আমরা এখনও বুঝতে পারছি না এখানে কি ছিল সেটা। তবে পূর্ব পুরুষদের কাছ থেকে জানা মতে, আরাকান রাজাদের রাজধানী ছিল এ দেয়াঙ। তাদের বসতি ছিল এখানে। খননকাজে নিয়োজিত শ্রমিকরা বলছেন, সতর্ক ও সাবধানতার মধ্যে খনন কাজটি করতে হচ্ছে। নিজেদের মধ্যে একটা অন্যরকম অনুভূতি কাজ করছে। কিছু সন্ধান পেলে আনন্দ লাগে। ধ্বংসপ্রাপ্ত ভবনের কাঠামো দেখতে পেলাম। এগুলো হাজার বছরের পুরানো।
স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মো. দিদারুল আলম বলেন, বড়উঠান এলাকায় প্রাচীনকালের কিছু নিদর্শন আমরা দেখে আসছি। এসব নিদর্শন সংগ্রহ করলে হয়তো কোনো অজানা তথ্য বেরিয়ে আসবে। আর আমারও ইতিহাসের সাক্ষী হব। এটা আমাদের জন্য গৌরবের। তবে কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করব, খনন কাজ ও অনুসন্ধানে যে স্থানীয়দের কোনো ধরনের ক্ষতিসম্মুখীন হতে না হয়।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক একেএম সাইফুর রহমান দৈনিক আজাদীকে জানান, কর্ণফুলীর দেয়াঙ পাহাড়ে প্রত্নতত্ত্বের খোঁজে গত ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে খনন শুরু হয়। খননের পর এ পর্যন্ত প্রাচীনকালের কিছু স্থাপনার দেয়াল ও মেঝে পাওয়া গেছে। কাজের প্রাথমিক অবস্থায় আছি। খনন শেষ করে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে ওখানে কি করা যায় তা সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তবে এখনো পর্যন্ত ওখানে কি স্থাপনা ছিল তা বুঝা যাচ্ছে না। বৃষ্টির কারণে কাজের কিছু প্রতিবন্ধকতাও সৃষ্টি হয়। চলতি মাস পর্যন্ত খনন কাজ চলবে। এরপর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে এর প্রতিবেদন তৈরী করা হবে। এ পর্যন্ত যা বুঝা গেছে সেখানে প্রাচীন কালের কোনো বসতি ছিল। তবে এটা কী এখনো বুঝা যাচ্ছে না। হাজার বছরের পুরনো কোনো স্থাপনা হবে হয়ত। সম্পূর্ণ কাজ শেষ করার পর বুঝা যাবে এখানে কি ছিল এবং পরবর্তীতে কি করা যাবে।