চলচ্চিত্রকার মৃণাল সেন নিয়ে যে–কোনো ভূমিকা ইতোমধ্যে লেখা হয়ে গেছে। তাঁর সম্পর্কে জানবে না এমন মানুষ বিরল দুই বাংলার শিল্প, সংস্কৃতি আর চলচ্চিত্র জগতে। একইসাথে তিনি সর্বভারত বা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সমানভাবে সুপরিচিত। ইতিমধ্যে ভারতীয় সংস্থা রিলায়েন্স মিডিয়া ওয়র্ঙ ভারতের ন্যাশনাল ফিল্ম আর্কাইভ এর সহযোগিতায় মৃণাল সেনের গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্রগুলোকে আধুনিক ব্যবস্থাপনায় সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছেন। সমপ্রতি যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতিমান নির্মাতা মার্টিন স্করসেস তাঁর ওয়ার্ল্ড সিনেমা ফাউন্ডেশন থেকেও সংরক্ষণের ব্যাপারে ঘোষণা দিয়েছেন। আগামী ১৪ মে, ২০২৩ এই বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্রকারের জন্মশত বার্ষিকী।
যে তিনজন মহীয়ান চলচ্চিত্রকার ভারতীয় চলচ্চিত্রকে আন্তর্জাতিক করে তুলতে পেরেছেন; বাংলা চলচ্চিত্রের হোলি ট্রিনিটি বলে পরিচিত– সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটকের সমসাময়িক সেই নাম মৃণাল সেন। বিষয়, আঙ্গিক, প্রেক্ষাপট, চরিত্র, ক্যামেরা মুভমেন্ট, ব্রেখটীয় স্টাইল, মার্ঙীয় দর্শন– যে কোন বিচারে মৃণাল সেন ছিলেন সবার চেয়ে আলাদা৷ তিনি ভারতীয় তথা বিশ্ববাসীর কাছে ভিন্ন মেজাজের চলচ্চিত্র উপহার দিয়েছেন। বাণিজ্যিক, বিশুদ্ধ আর্টহাউস বা ইন্টেলেকচুয়াল সিনেমার বাইরে গিয়ে তিনি শুরু থেকেই প্রথাবিরোধী এবং প্রতিবাদী চলচ্চিত্রের দিকে ঝুঁকে ছিলেন। ১৯৬০–৭০ এর দশকে তখন সারা পৃথিবীতে চলচ্চিত্র নিয়ে চলছে নিত্যনতুন পরীক্ষা–নিরীক্ষা। লাতিন আমেরিকায় ঔপনিবেশিক লিগাসীর বিরুদ্ধে তরুণ নির্মাতারা বাণিজ্যিক বা আর্ট ঘরানার চলচ্চিত্রকে খারিজ করে ‘তৃতীয় চলচ্চিত্র’ নিয়ে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। এই সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ভাবাদর্শ আফ্রিকা, এশিয়া এমন ইউরোপীয় অনেক দেশে গিয়ে ধাক্কা দেয়। তার সাথে যুক্ত হয় বামপন্থী মার্ঙিস্ট চিন্তা। মৃণাল সেনের সর্বালোচিত ‘কলকাতা ট্রিলজি’ [ কলকাতা ৭১, ইন্টারভিউ , পদাতিক ] দেখে অনেকে মনে করেন তিনি ভারতীয় উপমহাদেশে তৃতীয় চলচ্চিত্রের পুরোধা ব্যাক্তি। অথচ মৃণাল বাবু তার আগে থেকেই যেন সমাজ, শ্রেণী, মার্ঙবাদী আদর্শ, অবক্ষয়, সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। চলচ্চিত্রে রাজনীতি বা রাজনৈতিক ভাবনা থেকে তিনি কোনদিন সরে যাননি। এমনকি ব্যাক্তি, গোষ্ঠী, সামাজিক বা পারিবারিক কাহিনীগুলোর মধ্যেও তিনি সূক্ষ্মভাবে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে দেয়ালের ফ্রেমে রেখে দিয়েছেন। তার প্রমাণ ‘মহাপৃথিবী’– ১৯৯০ দশকের বিশ্বে সমাজতান্ত্রিক পতনের সাথে মায়ের আত্মহত্যার কোন সরাসরি সম্পর্ক হয়তো নেই, কিন্তু প্রেক্ষাপটটি যেন অনেক ভাবনার অবকাশ তৈরি করে দেয়। আবার ‘খারিজ’ চলচ্চিত্রে উঠে আসে খুব কাছাকাছি দুইটি শ্রেণী– সাধারণ সুবিধাবাদী মধ্যবিত্ত আর সর্বহারা শ্রমিক শ্রেণী। প্রতিদিন যারা একে অপরের উপর সামাজিক–অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল, অথচ ঘটনা বা পরিস্থিতি বিশেষে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শ্রেনী সার্বিকভাবে নিজের সুবিধা আর স্বার্থ সচেতন। এভাবেই ‘একদিন প্রতিদিন’ চলচ্চিত্রে পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী নারী ব্যক্তিটির অকস্মাৎ নিরুদ্দেশ নিয়ে মধ্যবিত্ত পরিবার বা প্রতিবেশীদের উদ্বেগ, উৎকণ্ঠার নিমিত্তে অন্তর্জগতের স্বরূপ, হীনতা, হঠকারিতার সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয়। ‘আকালের সন্ধানে’ উঠে আসে সমাজের প্রান্তিক মানুষও সহজ সরলভাবে অবস্থান করেন না৷ ক্ষুধা, দারিদ্র্যতা, অনাচার, অসততা– তাদের মাঝেও এক সর্বগ্রাসী মনস্তত্ত্ব নির্মাণ করে। মূলত সমাজের নানা স্তরের আর্থসামাজিক সংকট সংগ্রাম বা বাস্তবতা মৃণাল সেনের চলচ্চিত্র থেকে কখনো হারিয়ে যায় না।
এটি ঠিক তিনি যে সময়ে চলচ্চিত্রের সাথে যুক্ত হলেন, সদ্য স্বাধীন হলেও ভারতীয় উপমহাদেশ তখন উপনিবেশিক ট্রমায় নিমজ্জিত। ফলে মৃণাল সেনের চলচ্চিত্রে এই রাজনৈতিক অস্থিরতা, কলকাতার নাগরিকদের আর্থসামাজিক সংকট, মধ্যবিত্ত আর সর্বহারার শ্রেনীসংগ্রাম, শোষণের নয়া সাম্রাজ্যবাদী কৌশল, স্বাধীনতা পরবর্তী সমাজের প্রতিটি স্তরে কলোনিয়াল মনস্তত্ত্ব আর লিগাসি, নকশাল আন্দোলন– বিষয় বা প্রেক্ষাপটগুলো চরমভাবেই উপস্থিত। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পরিচিতি বা ধ্রুপদী স্তরে নিয়ে যেতে মৃণাল সেনের চলচ্চিত্রের উঠে আসা তৎকালীন সমাজ, অবক্ষয়, বাস্তবতা, সংগ্রাম উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে– একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
বামপন্থী– যুক্তিবাদী নির্মাতা মৃণাল সেন রাজনীতি, শ্রেণী, তত্ত্ব, সংগ্রামের বাইরে গিয়ে তীব্র ব্যথাময় একান্ত মানবিক এক গল্প বেছে নিলেন ‘খণ্ডহর’ দর্শক বা চলচ্চিত্রপ্রেমী হিসেবে এটি আমাদের ব্যাতিক্রম অভিজ্ঞতা। প্রেমেন্দ্র মিত্রের মূল গল্প ‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার’ থেকে পুরো প্রেক্ষাপটটি তিনি নিজের মত করে সাজিয়ে নিয়েছেন। কেন্দ্রীয় চরিত্রে এক বিষণ্ন নারী যিনি অস্তিত্ববাদী দর্শনের অর্থহীন প্রতীক্ষা আর ‘নাথিংনেস’ এর মধ্যে আটকে গেছেন। তাঁর চারপাশে আছে অন্য এক চরিত্র মা, যিনি শারীরিকভাবে অক্ষম, অন্যের উপর নির্ভরশীল অথচ নিজের মেয়ের একাকীত্বকে তিনি আরও যেন প্রলম্বিত করছেন এক ভিত্তিহীন বিশ্বাসের উপর ভর করে। ফলে, কেন্দ্রীয় নারী চরিত্রটি না পারছে নিজেকে বাহ্যিকভাবে ক্ষয়ে যাওয়া বিপদজনক ইমারতের আবাস থেকে বের করতে, না পারছে অন্তর্জগতের আশা বা হতাশার বেড়াজাল থেকে ছিন্ন করে স্বাধীন হতে। এযেন নিয়তি নির্ধারিত এক চরম বাস্তবতা যা থেকে মানুষের অপেক্ষা বাদে আর কিছু করার নেই। ‘খণ্ডহর’ আমার কাছে ব্রিটিশ নাট্যনির্মাতা স্যামুয়েল বেকেটের ‘ওয়েটিং ফর গডো’র আরেকটি চিত্রায়ন মনে হয়। এরমধ্যে সেই নিরানন্দ জীবনে আবির্ভাব হয় তিন চরিত্রের, তথা তিন বন্ধু দীপু, সুভাষ আর অনিলের। যারা কয়েকদিন ছুটি কাটাতে এসেছে শহর ছেড়ে।
খণ্ডহর চলচ্চিত্রের গল্পটি যে স্থানটিকে ঘিরে, সেটা দিপু’র পূর্বপুরুষের বাড়ি। এতো বিশাল জমিদার দালান, সচরাচর দেখা যায় না। এখন তার সবটাই ভেঙ্গে পড়েছে, ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়েছে। বন্ধু সুভাষের ফটোগ্রাফির পেশা, তাই সে এখানে ভালো বিষয় পেয়ে যাবে ভাবছে। এই বিরাট ক্ষয়িষ্ণু অট্টালিকার মাঝে লুকিয়ে থাকবে হাজারো গল্প, দৃশ্য, চিহ্ন। প্রথম রাতেই ছাদ থেকে দূরের এক প্রান্তে দেখা যায় এক নারী, নির্জন একাকী দাঁড়িয়ে। পরদিন দিপু জানায়, এটি তার চাচাত বোন, বৃদ্ধা মা’কে নিয়ে সে এই দালানের অন্যপ্রান্তে থাকে। মেয়েটির নাম যামিনী। এখান থেকেই শুরু হয় যামিনী’র গল্প। আমরা বুঝতে পারি, খণ্ডহর আসলে জরাজীর্ণ অট্টালিকার ক্ষয়ে যাওয়া ইট পাথরের মাঝে নির্জন একাকী দাঁড়িয়ে থাকা যামিনীর গল্প। এমন একটি গল্পই হয়তো সুভাষ এসেছে আবিষ্কার করতে। আর তাই সুভাষ নিজেও জড়িয়ে পড়ে যামিনীর জীবনের গল্পের সাথে।
দিপু এসেছে শুনে যামিনী এসে দেখা করে। দিপুকে সে জানায়, মায়ের সাথে একবার দেখা করতে। দিপু জানায়, তাতে কি লাভ হবে ? তার সাথে যারা এসেছে তাদের কেউ তো নিরঞ্জন নয়। যামিনী বলে, কিন্তু মাকে সেটা কে বোঝাবে ? যে নিরঞ্জন চার বছর আগে যামিনীকে বিয়ে করবে বলে কথা দিয়ে চলে গেছে, সে তো আর ফিরেই আসেনি। সে নিজে সংসার করেছে বিয়ে করে বড় শহরে। আর এদিকে তার অপেক্ষায় আছে যামিনী আর তাঁর পক্ষাঘাতগ্রস্ত মা। দিপু জানতে পারে, আগে যা একটু চোখে দেখতে পেত এখন তাও পারেন না তিনি। চলৎশক্তি, দৃষ্টিশক্তি সবই হারিয়েছেন বৃদ্ধা। এখনো বেঁচে আছেন ছোট মেয়েটির বিয়ে দিয়ে যাবেন বলে। দিপুর কথায় জানা যায়, যামিনীর বড় বোন থাকে স্বামী সংসার নিয়ে শহরে, কিন্তু মা তাদের কাছে যাবেন না। দিপু বুঝতে পারে না, কি করবে এই অবস্থায়। যামিনী জানায়, শুধু দেখা করে আবার চলে গেলে মা এবারের মতো চুপ হয়ে যাবেন।
সুভাষ এই বিশাল ভগ্নাবশেষ, এর নানা দুস্থ, জীর্ণ, দরিদ্র, আর নিঃসঙ্গতার ছবি তুলতে থাকে। সাথে এর মাঝে বেঁচে থাকা নানা মানুষগুলোর। এরা প্রত্যেকেই কিভাবে যেন মিশে গেছে এই বিরান ল্যান্ডস্কেপের সাথে। কোথাও প্রাণ নেই, কোথাও স্নিগ্ধতা নেই। সবকিছুতেই কেমন যেন রুক্ষতা, বিষণ্নতা যেমনটা সারাক্ষণ দেখা যায় যামিনীর চোখে।
প্রতীক্ষার এই অনন্তকালেও সে জানে নিরঞ্জন নামের সেই যুবকটি আসবে না। সুভাষ ঘটনাচক্রে দিপুর সাথে যামিনীদের বাড়ি এলে বৃদ্ধা মা তাকে নিরঞ্জন ভেবে কথা নেয়– সে যামিনীকে বিয়ে করবেই। কিন্তু দিপু বা যামিনী দুজনই বুঝতে পারে, এটি নিছক একটি তাৎক্ষণিক ঘটে যাওয়া ঘটনা মাত্র, এর কোন অতীত বা ভবিষ্যৎ নেই। দিপু জানায়, যামিনীর দায়িত্ব নেয়া সহজ না। এক সময়কার বিশাল ইমারতের প্রাচুর্য বলে কিছু অবশিষ্ট নাই। সবই ধ্বংসপ্রাপ্ত । নিজস্ব রুটি রোজগারের সংগ্রামে কে এই নারীকে তাঁর অসুস্থ মা’কে সহ দায়দায়িত্ব নেবে। সুভাষ জিজ্ঞেস করে, তাহলে এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের কোন উপায় নেই ? একদিন হয়তো এর শেষ হবে। কিন্তু কবে সেই অপেক্ষার পালা শেষ হবে কে জানে!
তবুও মনে হয়, যামিনী শেষ পর্যন্ত আশা করেছিল সুভাষ কিছু ভাববে। মৃণাল বাবুর ইচ্ছে থাকলেও তিনি সে পথে যেতে পারে না। তিনি রোমান্টিক বা ফ্যান্টাসির দিকে গিয়ে যামিনীর জন্য কোন আশাবাদ তৈরি করতে চান না দর্শকের মাঝে। তাই সুভাষ আর দশজন পর্যটকের মতোই ভ্রমণ শেষে ফিরে আসে নিজ কাজে, নিজ বাস্তবতায়। সাথে শুধু সেই ফটোগ্রাফ, যা দিয়ে খণ্ডহর চলচ্চিত্রটি শুরু হয়েছিল। সেই ছবিটি দিয়ে আবার শেষ দৃশ্যে চলে আসা হয়। প্রাচীন ধ্বংসস্তূপের বিরান অট্টালিকার ক্ষয়ে যাওয়া খাঁজের মাঝে নির্জন একাকী দাঁড়িয়ে যামিনী। পেছনে তার মায়ের ঘর। যেখানে তারা নিরঞ্জনের প্রতীক্ষায় বসে দিন গুনছে। তারা জেনে গেছে, নিরঞ্জন আসবে না, বা তার আসার সুযোগ নেই। বিরান নিস্ফলা ভূমির মাঝে এ–যেন শূন্যতার দিকে চেয়ে অর্থহীন দাঁড়িয়ে থাকা।
মৃণাল সেনের অন্য অনেক চলচ্চিত্রের কেন্দ্রীয় চরিত্রদের মতোই এখানেও আমরা জানতে পারি না শেষপর্যন্ত যামিনীর কি হয়েছিল। সে কি মুক্তি লাভ করেছিল ? আমরা যামিনীর জীবনে আসলে সুভাষের মতোই বেড়াতে গিয়ে অন্ধকার এক রাতে দূর থেকে ঢুকে পড়েছিলাম। সব জানলাম, মন খারাপও করলাম। কিন্তু আবার ফিরে এলাম নিজেদের কোলাহলে। এরপরে কি হয়েছে তা আমাদের আর জানার দরকার নেই বলেই হয়তো নির্মাতা আমাদের বিদায় দিলেন। আমাদের কাছে কেবল একটুকরো ছবি রয়ে গেল যামিনী’র। একটি অভিজ্ঞতা থেকে গেল, একাকী নির্জন এক নারী যে আটকে পড়েছে খণ্ডহরের নিয়তিতে।