ক্রাশ প্রোগ্রাম কি আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ, প্রশ্ন নগরবাসীর

১০০ দিনের কর্মসূচির ১৪ দিন পেরিয়েছে, নিয়ন্ত্রণে আসছে না মশা ।। ডেঙ্গু প্রতিরোধে জনসচেতনতায় গুরুত্ব চসিক কর্মকর্তাদের

মোরশেদ তালুকদার | বৃহস্পতিবার , ৬ জুলাই, ২০২৩ at ৫:৫১ পূর্বাহ্ণ

মশক নিধনে গত মাসে (জুন) আনুষ্ঠানিকভাবে নগরে দুই দফা ‘ক্রাশ প্রোগ্রাম’ শুরু করে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)। এর মধ্যে সর্বশেষ শুরু হওয়া ১০০ দিনের কর্মসূচির ১৪দিন পেরিয়েছে। এরপরও নিয়ন্ত্রণে আসছে না মশা। বরং বেড়েইে চলেছে মশার উপদ্রব। এমনকি এ সময়ে ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশার উৎপাত বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। যা ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত ও মৃত্যুর হার বৃদ্ধি প্রমাণ করে। তাই চসিকের ‘ক্রাশ প্রোগ্রাম’ কেবল আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ কীনা সে প্রশ্ন তুলেছেন নগরবাসী। এছাড়া আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত ও জাতীয় গাইড লাইন মেনেও কীটনাশক না ছিটানোর অভিযোগ আছে চসিকের বিরুদ্ধে। অবশ্য চসিকের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, প্রতিদিন ৪২ থেকে ৫০ জন স্প্রেম্যান ক্রাশ প্রোগ্রামের আওতায় ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে কীটনাশক ছিটাচ্ছেন। এরপরও ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধির জন্য মানুষের অসচেতনতাকে দায়ী করে তারা বলছেন, কীটনাশক ছিটানো হয় বাইরে, বাসাবাড়ির ভেতর না। তাই এডিস মশার জন্মের জন্য উপযুক্ত স্থান বাসার ছাদবাগান ও আঙিনা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকেই পরিষ্কার করতে হবে।

ক্রাশ প্রোগ্রাম আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ? : গত ৪ জুন চকবাজার ওয়ার্ডের পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকার প্রেসিডেন্সি স্কুলের সামনে একটি ক্রাশ প্রোগ্রাম শুরু করে চসিক। এরপর ২২ জুন একই ওয়ার্ডের চট্টগ্রাম নার্সিং কলেজের সামনে ৪১ ওয়ার্ডে ১০০ দিনের আরেকটি ক্রাশ প্রোগ্রাম শুরু হয়।

এদিকে জুন মাস থেকেই নগরে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি পেতে থাকে। মাসটিতে ৩১৮ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়। আবার চলমান কর্মসূচির মধ্যেও শনাক্ত ও মৃত্যু বাড়তে থাকে। যেমন চলতি মাসের প্রথম পাঁচদিনে শনাক্ত হয় ১৬০ জন। এছাড়া ৪ ও ৫ জুলাই পর পর দুইদিন ডেঙ্গু রোগী মারা যান। অর্থাৎ চসিকের মশক নিধনে চলমান ক্রাশ প্রোগ্রামের মধ্যেই মশাবাহিত রোগ বাড়ছে। ৭ম পৃষ্ঠার ৪র্থ কলাম

ফলে স্বাভাবিকভাবে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করা কর্মসূচি মাঠে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে কীনা প্রশ্ন ওঠে।

কদমতলী এলাকার বাসিন্দা হাসিব, আসকার দীঘির পূর্ব পাড়ের বাসিন্দা জাকের, বহাদ্দারহাট কালারপোলের বাসিন্দা সাইফ, জামালখান মেথরপট্টির বাসিন্দা অভ্র বড়ুয়া, কাপাসগোলা আবদুল হাকিম সাওদাঘর লেইনের বাসিন্দা করিম এবং মুরাদপুরমোহাম্মদপুর এলাকার বাসিন্দা সিনান আজাদীকে জানান, সাম্প্রতিক সময়ে তারা নিজেদের এলাকায় মশার কীটনাশক ছিটাতে দেখেননি। এর মধ্যে গতবছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়া হাসিব বলেন, এবারও ভয়ে আছি।

মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনাও উপেক্ষিত : গত এপ্রিল মাসে অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নগরে ডেঙ্গু রোগীর তথ্য পাওয়ার সাথে সাথে সংশ্লিষ্ট এলাকায় চিরুনি অভিযান চালাতে হবে চসিকে। এছাড়া ২০২১ সালে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় প্রণীত জাতীয় গাইড লাইন অনুযায়ী, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর হতে ডেঙ্গু রোগীর ঠিকানা সংগ্রহ করে রোগীদের বাড়িতে ও চারপাশের কমপক্ষে ৫০টি বাড়িতে এডিস মশা নিধনে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করতে হবে চসিককে। তবে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে আলাপকালে নির্দেশনা দুটি মানা হচ্ছে না বলে তারা অভিযোগ করেন।

এ বিষয়ে চসিকের ম্যালেরিয়া ও মশক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা মো. শরফুল ইসলাম মাহী আজাদীকে বলেন, ডেঙ্গু রোগী আক্রান্তের ভিত্তিতে ৫৭টি হট স্পট চিহ্নিত করা হয়েছে। সেখানে কীনাশক ছিটানোর উপর জোর দেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, যে ঘরে আক্রান্ত পাওয়া যায় তার আশেপাশে এক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে কীটনাশক ছিটানো হয়। অথচ ডেঙ্গু জীবাণুবাহী এডিস মশা ৬০০ মিটার পর্যন্ত যেতে পারে।

কর্পোরেশন কীটনাশক ছিটানোর দাবি করলেও সাধারণ মানুষ তা দেখে না বলে অভিযোগ আছে। এক্ষেত্রে মনিটরিং এর ঘাটতি আছে কীনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, মশক নিধন শাখায় জনবলের একটু ঘাটতি আছে। অতীতে এ শাখা নামে থাকলেও কাজই হতো না। আমি নতুন দায়িত্ব নিয়েছি। এখন অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে ভালো কাজ হচ্ছে। আমরা নানাভাবে চেষ্টা করছি। এরপরও সাধারণ মানুষের কিন্তু প্রত্যাশা বেশি। ওই জায়গা থেকেও তারা অভিযোগ করে থাকেন। আবার সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিও এক ধরনের নেগেটিভ ভাব থাকে।

সংকট কেটেছে কীটনাশকের : চসিক সূত্রে জানা গেছে, গত ৬ জুন ক্রাশ প্রোগ্রাম শুরু করলেও তখন কীটনাশকের সংকট ছিল। যা দূর হয়েছে ২০ জুন। এর আগে ১৫ হাজার লিটার পূর্ণাঙ্গ মশা ধ্বংসকারী এডাল্টিসাইড ও লিটার লার্ভিসাইডের কার্যাদেশ দেয়া হয়। প্রতি লিটার এডাল্টিসাইডের মূল্য ৭৩৫ টাকা, প্রতিলিটার লার্ভিসাইডের মূল্য ৩ হাজার ৮৮০ টাকা। এ কার্যাদেশের বিপরীতে জুন ১৫ হাজার লিটার এডাল্টিসাইড ও ৮০০ লিটার লার্ভিসাইড সরবরাহ করা হয়। লার্ভিসাইডের বাকি অংশ এ সপ্তাহের মধ্যে সরবরাহ করার কথা।

এদিকে প্রতি ওয়ার্ড অফিসের অনুকূলে ১০০ লিটার করে এডাল্টিসাইড ও ২ লিটার (ফর্মুলেশনের পর ৬৩৩ লিটার) করে লার্ভিসাইড বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। চসিকের প্রধান কার্যালয়ের শ্রমিকদের প্রতিদিন একটি ওয়ার্ডে অন্তত ৫ লিটার করে ওষুধ ছিটানোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ওয়ার্ডে বরাদ্দের পর ১০ হাজার ১০০ লিটার এডাল্টিসাইড ও ৬৫০ লিটারের মতো লার্ভিসাইড মজুদ আছে চসিকের স্টোরে।

এর আগে কীটনাশক সংকটের কারণে ওষুধ ছিটানো কার্যক্রম কিছুটা থমকে ছিল। এর কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলেন, অতীতে বিনা দরপত্রে গণখাতের ক্রয়বিধির ৭৬ () ধারা (পিপিআর) ব্যবহার করে একাধিকবার ওষুধ কিনেছে চসিক। এক প্রতিষ্ঠানকে বাড়তি সুবিধা দিতে এ ধারাটি কাজে লাগানোর প্রমাণ পায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এরপর দরপত্রের মাধ্যমে কীটনাশক কেনার উদ্যোগ নেয়া হয়। তবে গত মার্চ মাস পর্যন্ত সর্বশেষ চার মাসে প্রকিউরমেন্ট শাখা দুইবার চেষ্টা করেও ওষুধ কিনতে পারেনি।

জানা গেছে, ৭৩ টি ফগার মেশিন দিয়ে কীটনাশক ছিটানো হচ্ছে। এছাড়া ৫০ টি নতুন কেনা ফগার মেশিনের মধ্যে ৩৮ টি মজুদ আছে। এছাড়া ১৫০টির বেশি স্প্রে মেশিন সচল আছে। নতুন মজুদ আছে ২২ টি, প্রশিক্ষিত স্প্রেম্যান ১৭৫ জন। ক্রাশ প্রোগ্রামে ৩৫৪০ জনের একটা টিম কাজ করে।

চসিকের প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা মো. আবুল হাশেম আজাদীকে বলেন, ছাদবাগান এর বাইরেও মানুষের আঙিনা বা যে কোনো পরিত্যক্ত স্থান ও পাত্রে সামান্য পানি জমলেও সেখান থেকে এডিস মশা হতে পারে। তাই ব্যাপক জনসচেতনতা ছাড়া ডেঙ্গু প্রতিরোধ করা কোনোভাবেই সম্ভব না। তিনি বলেন, আমরা অতিরিক্ত ১০০ জন জনবল নিয়োগ করেছি। প্রতিদিন ওয়ার্ডের কার্যক্রমের বাইরে ১০ টা টিম ১০ টা এলাকা কাভার করছে। ৫০টা নতুন ফগার মেশিন নিয়েছি। আগামীকাল গণবিজ্ঞপ্তি আসবে পত্রিকায়। প্রতিদিন ড্রোন দিয়ে ছাদবাগান ও পরিত্যক্ত ছাদ ও জায়গা পর্যবেক্ষণ করে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ ছাড়া গতকাল পাঁচলাইশ এলাকায় মশার লার্ভা পাওয়ায় যাওয়ায় দুইজনকে সাত হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

চসিকের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ক স্থায়ী কমিটির সভাপতি কাউন্সিলর মোবারক আলী আজাদীকে বলেন, ক্রাশ প্রোগ্রাম বাইরে চলে। বাসাবাড়িতে কীটনাশক ছিটানো সম্ভব না। আবার এডিস মশা যেসব স্থানে জন্মে তার মধ্যে ছাদবাগান বা বেলকনিতে রাখা ফুলের টব ও বাড়ির আঙ্গিনায় জমা স্বচ্ছ পানি অন্যতম। এসব মানুষকেই পরিষ্কার করতে হবে। সেখানে সচেতনতার প্রয়োজন। এ জন্য আমরা মাইকিং করছি। লিপলেট বিতরণ করা হচ্ছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবৃষ্টির দাপট আর ব্যাটারদের ব্যর্থতায় হার বাংলাদেশের
পরবর্তী নিবন্ধখাদ্যপণ্যের অবৈধ মজুদে সাজা যাবজ্জীবন