এক গবেষণায় বলা হয়েছে, করোনা মহামারির পর দেশে সার্বিক দারিদ্র্যের হার কমে ২০ দশমিক ৭ শতাংশে নেমেছে। তবে পাঁচ বছরের ব্যবধানে গ্রামীণ এলাকায় দরিদ্র কমলেও শহরে বেড়েছে। এতে আরো বলা হয়, ২০২৩ সালে দারিদ্র্যের হার দেশের গ্রামীণ এলাকায় ২১ দশমিক ৬ শতাংশ এবং শহরাঞ্চলে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ। পাঁচ বছর আগে গ্রামীণ এলাকায় দারিদ্র্য ছিল ২৪ দশমিক ৫ শতাংশ ও শহরে ছিল ১৬ দশমিক ৩ শতাংশ।
‘করোনা মহামারি ও পরবর্তী প্রতিবন্ধকতা কীভাবে বাংলাদেশের দারিদ্র্য, আয়বৈষম্য, শিক্ষা এবং খাদ্য সুরক্ষার ওপর প্রভাব ফেলছে’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) ও যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট যৌথভাবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৩ সাল শেষে মূল্যস্ফীতির কারণে বাংলাদেশের ৭০ শতাংশ পরিবার তাদের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনতে বাধ্য হয়েছে। জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে ২৮ শতাংশ পরিবার ঋণ করেছে। দারিদ্র্য বৃদ্ধি ও উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাবে দেশের সাধারণ মানুষ পুষ্টিকর খাবার কম খাচ্ছে। আর রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে চিকিৎসা ব্যয় ও ওষুধের দাম ব্যাপক হারে বাড়ায় দেশের স্বাস্থ্যসেবায় ব্যয় বেড়েছে তিন গুণ।
এখানে উল্লেখ করতে পারি, ১৯৭৩–৭৪ অর্থবছরে দেশে প্রথম খানা ব্যয় জরিপ পরিচালিত হয়। এভাবে ১৯৯১–৯২ সাল পর্যন্ত আরও কয়েকটি জরিপ করা হয়। তখন খাদ্য ও ক্যালরি গ্রহণ বিবেচনায় দারিদ্র্য পরিমাপ করা হতো। ১৯৯৫–৯৬ সালের জরিপ থেকে মৌলিক চাহিদা ব্যয়পদ্ধতি ব্যবহার শুরু হয় এবং ‘খানা আয় ও ব্যয় জরিপ’ নামকরণ করা হয়। এ পদ্ধতিতে খাদ্যের পাশাপাশি খাদ্যবহির্ভূত ভোগ্যপণ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়। মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ করে–এমন ভোগ্যপণ্যের একটি তালিকার ভিত্তিতে বিবিএস জরিপ পরিচালনা করে। মৌলিক চাহিদা পূরণ করার মতো আয় যারা করতে পারে না, তারা দরিদ্র হিসেবে চিহ্নিত হয়।
অর্থনীতি বিশ্লেষক মামুন রশীদ তাঁর এক লেখায় বলেছেন, আমরা দেখেছি, করোনার মধ্যে ঝুঁকি নিয়েই সীমিত ও শিথিল বিধিনিষেধ দেওয়া হয়েছে। কলকারখানা বন্ধ করা হয়নি। খেটে খাওয়া মানুষের যোগাযোগ ও যাতায়াতে বাধা দেওয়া হয়নি। ১০০ কোটি ডলারের মতো প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। এ ছাড়া দরিদ্রদের জন্য নগদ সহায়তাসহ বিভিন্ন ধরনের সহায়তা কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। হয়তো এসবের ফল হিসেবে করোনার মধ্যেই দারিদ্র্য কমেছে। গ্রামাঞ্চলে প্রবাসী আয় বৃদ্ধি, প্রবাসী আয়ে প্রণোদনাও এ ক্ষেত্রেও কাজ করেছে। এ ছাড়া সামপ্রতিক কালে যোগাযোগ উন্নত হওয়ায় গ্রামে অকৃষি কার্যক্রমও বেড়েছে। হাটবাজারে বিভিন্ন ধরনের কাজের সুযোগও তৈরি হয়েছে। ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা বা এনজিওগুলোরও এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রয়েছে। ভূমিকা রয়েছে মাঠপর্যায়ের প্রশাসনেরও। অর্থনীতিবিদেরা যথার্থই বলেন, মানুষের আয় বাড়লে দারিদ্র্য কমবে, এটাই স্বাভাবিক।
কোভিডের প্রভাব থেকে আমাদের অর্থনীতি পুনরুদ্ধার হচ্ছিল আমরা দেখেছি। কিন্তু সবাই আবার বলছেন, রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাবও রয়েছে। এর পাশাপাশি সরকার প্রত্যাশা অনুযায়ী আয় ও ব্যয়ও করতে পারছে না। সামাজিক নিরাপত্তাও জিডিপির তুলনায় খুব বেশি নয়। এ অবস্থায় অতি দারিদ্র্যের হার এত কমে আসা অনেকের কাছেই বৈসাদৃশ্য মনে হয়েছে। প্রবৃদ্ধির প্রথম দিকে আমরা যেমন অনেক দেশেই আয়বৈষম্য দেখি বা দেখেছি, অন্যদিকে এটাও সত্যি যে দীর্ঘদিনের আয়বৈষম্য অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের অন্তরায়। আমরা আবার পত্রিকান্তরে দেখেছি, আমাদের সম্পদের বৈষম্যও বেড়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চাহিদাকেন্দ্রিক প্রবৃদ্ধিই যেহেতু মূল নিয়ামক, তাই ক্রমবর্ধমান বৈষম্য অর্থনীতির সম্ভাবনাকেও সংকুচিত করবে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, মাদকাসক্তির সাথে দারিদ্র্যের রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। এর ফলে জনগণের একটি বিরাট অংশ অর্থনীতিকে এগিয়ে নেয়ার পরিবর্তে পিছনের দিকে টেনে ধরছে। এতে দরিদ্রের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। মাদকাসক্তি ব্যক্তির শারীরিক ও মানসিক দিককে ক্রমঅবনতির দিকে নিয়ে যায় এবং অর্থনৈতিক দিক দিয়েও পঙ্গু করে দেয়। মাদকাসক্তরা যখন সব সম্পত্তি হারিয়ে ফেলে, তখন তার জীবন পর্যুদস্ত দরিদ্র ও রাস্তায় পড়ে থাকা ভিক্ষুকের ন্যায় হয়ে যায়। তার পারিবারিক প্রয়োজন মেটাতে কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। সে একেবারে নিঃস্ব হয়ে পড়ে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, প্রতিজন মাদকাসক্ত গড়ে মাসে প্রায় ৪,০০০ টাকা খরচ করে।
ভাগ্যবিড়ম্বিত, বঞ্চিত ও দরিদ্র জনগোষ্ঠী যেন তাদের মৌলিক প্রয়োজন পূরণ এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে পারে তার নিশ্চয়তা বিধান করা দেশের শাসক তথা সরকারেরই অপরিহার্য দায়িত্ব ও কর্তব্য। কেননা দারিদ্র্যের মূলোৎপাটন, সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার এবং প্রবৃদ্ধির কাম্য হার অর্জনের লক্ষ্য কেবল সরকারের কার্যকর ও সক্রিয় অংশ গ্রহণের মাধ্যমেই অর্জিত হ’তে পারে। মোটকথা, সরকারের দায়িত্বসচেতনতাই দারিদ্র্য বিমোচনের কার্যকর হাতিয়ার।