বিশ্বের সব ক্যানসার নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলোর অন্যতম UICC (Union against International Cancer Care)-এর তত্ত্বাবধানে প্রতিবছর ৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাপী পালিত হয় ক্যানসার দিবস। এবারও দিবসটি পালিত হয়েছে। এবারের প্রতিপাদ্য ছিল-‘Close the care gap’। সারা বিশ্বেই ক্যানসার রোগীর সংখ্যা প্রতিনিয়ত বেড়ে চলছে। ২০২০ সালের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বিশ্বে ১৭.১ মিলিয়ন রোগী ক্যানসার আক্রান্ত। এর মধ্যে পুরুষ ৯.৩ মিলিয়ন ও মহিলা ৮.৮ মিলিয়ন। ১৯৯০ থেকে আজ পর্যন্ত ক্যানসার রোগের প্রাদুর্ভাব ০.৫৪ থেকে ০.৬৪ শতাংশ বেড়েছে। আমাদের দেশে পুরুষদের মধ্যে ফুসফুস ক্যানসার সবচেয়ে বেশি, তারপর হেড–নেক ও কোলোরেক্টাল ক্যানসার। কিন্তু পৃথিবীতে পুরুষদের ক্যানসারের দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে প্রস্টেট ক্যানসার। বাংলাদেশে মহিলাদের প্রধান ক্যানসার হচ্ছে ব্রেস্ট ক্যানসার। তারপর জরায়ু মুখ ও হেড–নেক ক্যানসার। কিন্তু পৃথিবীতে মহিলাদের ক্যানসারের দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে কোলোরেক্টাল ক্যানসার, তারপর ফুসফুস ক্যানসার। দেশে দেশে পুরুষ ও মহিলাদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন ক্যানসার আক্রান্ত হওয়ার কারণ সে দেশের পরিবেশ, খাদ্যাভাস ইত্যাদি। ক্যানসার বেড়ে যাওয়ার কারণ ক্যানসার হওয়ার প্রধান কারণ ধূমপান ও বিভিন্ন তামাক সেবন বা চর্বন করা। খাদ্যে ভেজাল দ্বিতীয় কারণ। আম–কলা পাকানোর জন্য রাসায়নিক পদার্থ মেশানো হচ্ছে। দুধকে ভালো রাখার জন্যও কেমিক্যাল মেশানো হচ্ছে। মাছকে সংরক্ষণ করার জন্য ফরমালডিহাইডে রাখা হচ্ছে। ট্যানারিতে বর্জ্য বের হচ্ছে যাতে ক্রোমিয়াম থাকে, যা পোলট্রিতে হাস–মুরগির খাদ্য, গরুকে খাওয়ানো হচ্ছে। এমনকি পুকুরের মাছ চাষেও এ বর্জ্য পদার্থ খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এ ফুড সাইকেলে ফাস্ট ফুড, প্রসেসড ফুডেও ক্রোমিয়াম চলে আসছে যা কার্সিনোজেনিক অর্থাৎ ক্যানসার সৃষ্টিতে সহায়ক। পানিতে আর্সেনিক থাকে, যা পানেও ত্বকে ও শরীরে ক্যানসার হয়। ফসলি জমিতে লেড, ক্রোমিয়ামের মতো ভারি ধাতু থাকলে তা ফসলেও ছড়িয়ে পড়ে এবং এ ধাতু ক্যানসার সৃষ্টি করে। জমিতে যে কীটনাশক বা এনড্রেইন ব্যবহৃত হচ্ছে তাও ফসলের মাধ্যমে সাইকেলে মানবদেহে ক্যানসার সৃষ্টি করে। মুড়ি সাদা করার জন্য ব্যবহৃত ইউরিয়া, জিলাপি ও অন্যান্য ফাস্টফুড ভাজার জন্য তেলের সঙ্গে মেশানো পুরনো মবিল, ফুড কালার করার জন্য টেক্সাইল ডাই– এসব কিছু ক্যানসার সৃষ্টিতে সহায়ক। প্লাস্টিকের পাত্রে গরম পানি বা খাবার থাকলে তাও ক্যানসার সৃষ্টিতে সহায়ক। খাদ্যের এই নিরাপত্তা উন্নত দেশে আইনের মাধ্যমে বন্ধ করা হয়েছে। আমাদের দেশেও খাদ্যে ভেজাল সংক্রান্ত অধিদপ্তর ও আইন রয়েছে। কিন্তু সেটার যথোপযুক্ত প্রয়োগ সর্বক্ষেত্রে হচ্ছে না। ঢাকা বিশ্বের দূষিত শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম। এ শহরের বাতাসে গাড়ির পেট্রোলিয়াম বা তেল থেকে নির্গত লেড, সালফাইড, কার্বন মনো অঙাইড, নাইট্রোজেন অঙাইড রয়েছে। যা গ্রহণে আমাদের ফুসফুসসহ অন্যান্য অঙ্গের ক্যানসার হচ্ছে। শিপ ব্রেকিং ইন্ডাস্ট্রিতে কেবিনগুলোতেও অ্যাসবেসটস থাকে, যা অতি বিষাক্ত এবং এগুলো শ্বাস–প্রশ্বাসের মাধ্যমে ফুসফুসে ক্যানসার বা মেসোথেলেমিয়া হয়। গ্রামের মহিলারা যে মাটির চুলা ব্যবহার করে তাতে যে ফোমাইট তৈরি হয় তা থেকেও ফুসফুসে ক্যানসার হয়। ক্যানসারের সাধারণ প্রাথমিক লক্ষণ: ১. শরীরের যে কোনো স্থানে হঠাৎ চাকা বা পিণ্ড যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২. শরীরের ঘা, যা সহজে সারছে না। ৩. মাসের অধিক সময় ধরে কণ্ঠস্বর ভেঙে যাওয়া। ৪. কাশি সহজে ভালো না হওয়া। ৫. কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়াই শরীরের ওজন কমে যাওয়া। ৬. মল–মূত্রের অভ্যাসের পরিবর্তন বা এর সঙ্গে রক্ত পড়া। কখনো ডায়রিয়া কখনো কোষ্ঠকাঠিন্য হওয়া। ৭. যে জ্বর সহজে সারছে না। এ লক্ষণগুলো দেখা দিলে ক্যানসার বিশেষজ্ঞ বা বিষয়ভিত্তিক ডাক্তারের কাছে যেতে পারে। যেমন– গলা ভেঙে গেলে, নাক–কান–গলা বিশেষজ্ঞ, কাশির জন্য ফুসফুস বিশেষজ্ঞ, বমির সঙ্গে রক্ত গেলে গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজিস্টের কাছে যাওয়া ভালো। পরবর্তীতে এ রোগীদের কারও কারও ক্ষেত্রে সার্জনের পরামর্শ লাগতে পারে। ক্যানসার কীভাবে নির্ণয় করা হয় ক্যানসার নির্ণয়ের প্রধান ও প্রথম পরীক্ষা কোর বায়োপসি, অর্থাৎ নির্দিষ্ট অল্প কিছুসংখ্যক মাংসপেশি কেটে পরীক্ষা করা হয়। কিছু ক্ষেত্রে ‘এফএনএসি’ও করা হয়। এছাড়া ইমেজিং পরীক্ষা, যেমন– সিটি স্ক্যান, এমআরআই, পেট সিটি, এন্ডোসকপি, কোলনোসকপি ও ফাইবারঅপটিক ব্রংকোসকপিও করা হয়। চিকিৎসা ক্যানসার চিকিৎসার মূল হচ্ছে– শল্যচিকিৎসা বা সার্জারি, বিকিরণ বা রেডিওথেরাপি এবং ওষুধ বা কেমোথেরাপি। স্তন, পাকস্থলীর ক্যানসারে সার্জনরা প্রথমে চিকিৎসা দেন। জরায়ু বা বিভিন্ন গাইনোকোলজিক্যাল ক্যানসার গাইনি বিশেষজ্ঞরা প্রথমে সার্জারি করেন। স্বরযন্ত্রের ক্যানসার হলে হেড–নেক সার্জন প্রথমে অপারেশন করেন। প্রাথমিক অবস্থায় ক্যানসার ধরা পড়লে সার্জনের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তবে সার্জারির সঙ্গে রেডিও এবং কেমোথেরাপি দুটিই বা যে কোনো একটি অবশ্যই দরকার হয়। রেডিওথেরাপির চিকিৎসার মধ্যে রয়েছে দ্বিমাত্রিক ও ত্রিমাত্রিক লিনিয়র এক্সিলেটর, ত্রিমাত্রিক কনফরমাল রেডিওথেরাপি আইএমআরটি, আইজিআরটি, র্যাপিড–আর ও এসবিআইটি। কেমোথেরাপির মধ্যে রয়েছে টার্গেটেড থেরাপি, হরমোন থেরাপি, ইমিউনোথেরাপি। এসব থেরাপিতে ব্যবহৃত ওষুধগুলো বাংলাদেশে তৈরি হচ্ছে ও সহজলভ্য। বিকিরণ চিকিৎসার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই বললেই চলে। হলেও সেটি সাময়িক। কেমোথেরাপিতে চুল পড়ে যাওয়া, বমি হওয়ার আংশকা রয়েছে। তবে বমি না হওয়ারও আধুনিক ওষুধ আমাদের দেশে আছে। দেশে ক্যানসার চিকিৎসার দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবল রয়েছে, তবে তা অপ্রতুল। তবে দেশের বিভিন্ন ল্যাবে ভিন্ন ভিন্ন রিপোর্টের কারণে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগে রোগীদের অনেকেই বিদেশে যান চিকিৎসা নিতে। পৃথিবীর সব দেশেই ক্যানসার চিকিৎসায় নির্দিষ্ট প্রটোকল রয়েছে। সবাই সেটি অনুসরণ করে চিকিৎসা দেন। দেশের অনেক চিকিৎসক এনসিসিএন গাইডলাইন ফলো করেন। ক্যানসার চিকিৎসার প্রান্তিক বা প্যালিয়েটিভ কেয়ার বা হসপিস চিকিৎসা দেওয়া হয়। যাতে রোগীর আরাম বোধ হয়। করণীয়: ক্যানসার নির্ণয়ের জন্য দেশে স্ক্রিনিং ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। যেমন– ১. ব্রেস্ট ক্যানসার নির্ণয়ে সেল্ফব্রেস্ট এক্সামিনেশন, ম্যামোগ্রাম করা হয়। ২. জরায়ু মুখের ক্যানসার নির্ণয়ে ভায়া, প্যাপস স্মেয়ার টেস্ট, কলপোসকপি, এইচপিপি ডিএন টেস্ট করা হয়। ৩. ৫০ বছরের পর কোলন ক্যানসার নির্ণয়ে কোলনস্কোপি করা হয়। ৪.স্বরযন্ত্রের সমস্যার ফাইবার অপটিক ব্রংকোসকপি বা আইএল করা হয়। ৫. যারা ধূমপায়ী তাদের লো–ডোজ সিটিস্ক্যান করা হয়। ৬. ৫০ বছরের ওপরের রোগীদের প্রোস্টেট ক্যানসার নির্ণয়ের জন্য রক্তের পিএসএ বা পাররেক্টাল পরীক্ষা করা হয়। প্রাথমিক অবস্থায় যে কোনো ক্যানসার নির্ণয় করে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রোগীকে সুস্থ করা সম্ভব। যেমন–স্তন, কোলন, ফুসফুস, জরায়ু মুখ ও প্রস্টেট ক্যানসার শুরুতে নির্ণিত হলে সুস্থ হয়ে যাওয়ার সুযোগ আছে। জরায়ু মুখের ক্যানসার প্রতিরোধে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়। হেপাটাইটিস বি প্রতিরোধেরও ভ্যাকসিন রয়েছে। হেলিকোব্যাক্টর পাইলোরি ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধ করতে পারলে পাকস্থলীর ক্যানসার প্রতিরোধ সম্ভব। বাংলাদেশে রোগ নির্ণয়ের সমন্বিত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য শুরুতেই ক্যানসার ডিটেকশন সেন্টার তৈরি করা অপরিহার্য। সরকারি, বেসরকারি, জেলা পর্যায়ের মেডিকেল সেন্টারে এ ডিটেকশন সেন্টার তৈরি করা প্রয়োজন। ক্যানসার চিকিৎসা ব্যয়বহুল। এ জন্য দেশব্যাপী ক্যানসারের মতো ক্রনিক অসুখগুলোর চিকিৎসার জন্য স্বাস্থ্যবীমা চালু করা অপরিহার্য। সরকারি পর্যায়ে বিকিরণ মেশিনগুলো বছরব্যাপী সচল থাকা প্রয়োজন। ওষুধের উৎপাদন খরচ ও বিক্রয়মূল্য সহনীয় পর্যায়ে থাকা উচিত।
লেখক : সিনিয়র কনসালটেন্ট, ক্লিনিক্যাল অনকোলজি ও রেডিওথেরাপি এবং কো–অর্ডিনেটর, স্কয়ার হাসপাতাল অনকোলজি সেন্টার, ঢাকা। চট্টগ্রামে আয়োজিত অনকোকন ক্যান্সার সম্মেলনের একজন পৃষ্ঠপোষক।