দেশে ক্যানসার আক্রান্ত রোগীর প্রকৃত সংখ্যা কত, তা জানা না গেলেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটা তথ্য অনেকের জানা আছে। ২০২০ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে দ্য গ্লোবাল ক্যানসার অবজারভেটরি ক্যানসার বিষয়ে এই তথ্যটি প্রকাশ করেছিল। তাতে বলা হয়েছিল, দেশে প্রতিবছর দেড় লাখ মানুষ নতুন করে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়। আর ক্যানসারে প্রতিবছর মারা যায় ১ লাখ ৮ হাজারের বেশি মানুষ। নিজস্ব কোনো পরিসংখ্যান না থাকায় জনস্বাস্থ্যবিদেরা এই তথ্যই ব্যবহার করছেন। অন্যদিকে গত বছর ঢাকায় অনুষ্ঠিত প্রথম অসংক্রামক ব্যাধিবিষয়ক জাতীয় সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছিলেন, দেশে ক্যানসারে ভুগছে প্রায় ২০ লাখ মানুষ। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, ‘দেশের ক্যানসার রোগীর তুলনায় চিকিৎসার আয়োজন অনেক সীমিত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, প্রতি ১০ লাখ মানুষের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ ক্যানসার কেন্দ্র বা হাসপাতাল থাকা প্রয়োজন। এসব কেন্দ্রে ক্যানসার শনাক্তসহ ক্যানসার চিকিৎসার তিন ধরনের (কেমোথেরাপি, সার্জারি ও বিকিরণ চিকিৎসা) পদ্ধতি থাকতে হবে। দেশে মানুষ ১৭ কোটি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড অনুযায়ী ১৭০টি ক্যানসার চিকিৎসা কেন্দ্র থাকা দরকার। সরকারি ও বেসরকারি সূত্র বলছে, দেশে ক্যানসার কেন্দ্র আছে ৩৩টি। এর মধ্যে বিকিরণ যন্ত্র আছে ১৯টিতে। ক্যানসার চিকিৎসকদের একটি সংগঠন জানিয়েছে, ক্যানসারের চিকিৎসায় দেশে কমপক্ষে ২২০টি বিকিরণ যন্ত্র দরকার। সরকারি–বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতালে আছে ৫৭টি যন্ত্র। এর মধ্যে চালু আছে ৪৩টি। বেসরকারি হাসপাতালগুলো এখন বেশি মানুষকে বিকিরণ চিকিৎসা দিচ্ছে।’ বলা যায়, ক্যানসার রোগের চিকিৎসা সেবা অত্যন্ত সীমিত। এ অবস্থায় ‘গুণগত মান’ নিয়ে সৃষ্ট জটিলতায় দুই অর্থবছর ক্যানসারের ওষুধ কিনতে পারেনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এতে দুই বছর ধরে বিনামূল্যের ওষুধ বঞ্চিত হাসপাতালের ক্যানসার (রেডিওথেরাপি) ওয়ার্ডের রোগীরা। এই সংকট নিয়ে গত ১ এপ্রিল আজাদীতে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তারই ধারাবাহিকতায় দুই বছর পর চমেক হাসপাতালে বিনামূল্যের ওষুধ পাবেন ক্যান্সার রোগীরা। ১৬ই জুন আজাদীতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সার্বিক ক্রয় প্রক্রিয়া সম্পন্নের পর দেড় মাসের মাথায় (প্রতিবেদন প্রকাশের) প্রায় ৭৩ লাখ টাকার ওষুধ এখন হাসপাতালে পৌঁছে গেছে। কয়েকদিনের মধ্যেই ক্যানসার ওয়ার্ডে ওষুধ সরবরাহ করার কথা জানিয়েছেন হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা। এর মাধ্যমে দুই বছর পর অবশেষে বিনামূল্যের ওষুধ পাচ্ছেন ক্যানসারের রোগীরা। ক্যানসারের ওষুধ ক্রয় প্রক্রিয়া এরইমাঝে সম্পন্ন হয়েছে নিশ্চিত করে চমেক হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান আজাদীকে বলেন, ওয়ার্ডের চিকিৎসকদের চাওয়া মতো মানসম্মত ওষুধই কেনা হয়েছে। আমরা দ্রুততার সাথে এই ওষুধ ক্রয় প্রক্রিয়া শেষ করেছি। সবমিলিয়ে প্রায় ৭৩ লাখ টাকার ওষুধ কেনা হয়েছে। কার্যাদেশ প্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান এরই মাঝে ওষুধ হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছে। এখন সার্ভে কমিটি কর্তৃক সার্ভে সম্পন্ন হলেই ওয়ার্ডে ওষুধ সরবরাহ শুরু হবে। কয়েকদিনের মধ্যেই ওয়ার্ডে ক্যান্সারের ওষুধ পৌঁছে যাবে বলে জানান হাসপাতাল পরিচালক।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, দেশে বছরে যত মানুষ মারা যান, তার ৬৭ শতাংশ ক্যানসার, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি রোগ, শ্বাসতন্ত্রের দীর্ঘস্থায়ী রোগের মতো অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত। কিন্তু এই ক্যানসারের চিকিৎসা ব্যয় এতো বেশি যে অনেকের পক্ষে তা জোগাড় করা কঠিন। চিকিৎসক দেখানো, পরীক্ষা–নিরীক্ষা, অস্ত্রোপচার, ওষুধ—প্রতিটি ক্ষেত্রে অনেক বেশি টাকা খরচ করতে হয়। মধ্যবিত্তরাই এই খরচ চালাতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে যায়। দরিদ্ররা খরচের ভয়ে এই চিকিৎসা নেওয়া থেকে দূরে থাকে। দরিদ্র রোগীদের নির্ভর করতে হয় সরকারি হাসপাতালের বিনামূল্যের ওষুধের ওপর। এ অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের ক্যানসার (রেডিওথেরাপি) ওয়ার্ডের অনেক রোগী বিনামূল্যের ওষুধ প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত ছিলেন বলে যে খবর আজাদীতে প্রকাশিত হয়েছে, তা অপ্রত্যাশিত। বলা বাহুল্য, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের ক্যানসার (রেডিওথেরাপি) ওয়ার্ডটি চট্টগ্রামসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের ক্যানসারের চিকিৎসায় একমাত্র ভরসাস্থল।
ক্যানসারের চিকিৎসায় ওষুধ–পত্রের দাম খুব বেশি উল্লেখ করে চিকিৎসকরা বলছেন, নিম্নবিত্ত মানুষের পক্ষে এ রোগের চিকিৎসা খুব বেশিদিন চালানো কঠিন। অনেকেই নিঃস্ব হয়ে পড়েন। চিকিৎসা খরচ বহন করতে না পারায় অধিকাংশ গরিব ক্যানসার রোগীকেই মৃত্যুর কাছে হার মানতে হয়। ব্যয়বহুল এ রোগের চিকিৎসায় সরকারি পর্যায়ে আরো জোরালো পদক্ষেপ নেয়া জরুরি মন্তব্য করেন চিকিৎসকরা। তাঁরা বলেন, ক্যানসার চিকিৎসায় এই বিশাল খরচ কমাতে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি সামাজিক সহযোগিতা প্রয়োজন।