চট্টগ্রামে ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত ৪ ফেব্রুয়ারি দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের ওয়ার্ড ও বহির্বিভাগ মিলে চিকিৎসা নিয়েছেন প্রায় ২০ হাজার রোগী। এর মধ্যে নতুন আক্রান্ত রোগী ছিল ৬ হাজারের অধিক। তবে রোগী বাড়ার সাথে সাথে চমেক হাসপাতালে ক্যান্সার ওয়ার্ডের সক্ষমতা অতীতের তুলনায় কয়েক গুণ বেড়েছে। বিশেষ করে বর্তমানে প্রতিদিন ওয়ার্ডে গড়ে ১৫০ জন রোগী রেডিওথেরাপি নিতে পারছেন। কেমোথেরাপি নিচ্ছেন প্রতিদিন গড়ে ৬০ জন রোগী। প্রতি সপ্তাহে গড়ে ১৫ জন নারী জরায়ু ক্যান্সারের চিকিৎসার ব্রেকিথেরাপি নিতে পারছেন।
অন্যদিকে, ৪ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত অন্য এক প্রতিবেদনে জানা যায়, বিশ্বব্যাপী ক্যান্সার আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ২০৫০ সালের মধ্যে সাড়ে ৩ কোটিতে পৌঁছাতে পারে বলে ধারণা দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। ১৮৫টি দেশের ৩৬ রকমের রোগ বিশ্লেষণ করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সার এই পূর্বাভাস দিয়েছে। সিএনএন জানিয়েছে, ২০২২ সালে বিশ্বে ক্যান্সার আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ২ কোটি; সেই হিসাবে পরবর্তী ২৮ বছরে এই সংখ্যা ৭৭ শতাংশ বেড়ে যাবে। গবেষকরা তাদের বিশ্লেষণে দেখেছেন, ২০২২ সালে বিশ্বে ফুসফুসের ক্যান্সারের প্রভাব ছিল বেশি। ওই বছর ২৫ লাখ ফুসফুসের ক্যান্সার শনাক্তের হিসাব পাওয়া যায়, যা মোট শনাক্তের ১২ দশমিক ৪ শতাংশ। এরপরই রয়েছে নারীদের স্তন ক্যান্সার, কোলোরেক্টাল, প্রোস্টেট ও পাকস্থলীর ক্যান্সার। বিশ্বে ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্তদেরই মৃত্যুর হার বেশি। ২০২২ সালে ক্যান্সারে মারা যাওয়াদের ১ দশমিক ৮ শতাংশের মৃত্যু হয় এই ক্যান্সারে, যা মোট মৃত্যুর প্রায় ১৯ শতাংশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ক্যান্সার গবেষণা এজেন্সি বলছে, উন্নত দেশগুলোতে আক্রান্তদের সংখ্যা দেখা যায় বেশি। যেমন মানব উন্নয়ন সূচকে (এইচডিআই) এগিয়ে থাকা দেশগুলোতে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও জীবনযাত্রার মান উন্নত। আগামীতে সেখানে ১২ নারীর মধ্যে ক্যান্সার শনাক্ত হবে একজনের। আর মারা যাবেন ৭১ জনের মধ্যে একজন। অপরদিকে মানব উন্নয়ন সূচকে পিছিয়ে দেশগুলোতে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও জীবনযাত্রার মান তেমন উন্নত নয়। সেখানে ২৭ জনে একজন নারী স্তন ক্যান্সার ধরা পড়বে এবং প্রতি ৪৮ জনে একজনের মৃত্যুর হবে। মূলত দেরিতে রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার সুযোগের অভাবে এসব দেশে শনাক্তের হার কম, কিন্তু মৃত্যুর হার বেশি। ক্যান্সারে আক্রান্তদের চিকিৎসায় রেডিয়েশন বা রেডিওথেরাপি ও স্টেম সেল ট্রান্সপ্লান্টের মতো সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রেও বৈষম্য রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অসংক্রামক রোগ বিভাগের পরিচালক বেন্তে মিক্কেলসেন এক বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, বিশ্বজুড়ে ক্যান্সারে আক্রান্তদের প্রতি বৈষম্য ও আর্থিক সুরক্ষার অভাবের ওপর আলো ফেলেছে এই গবেষণা। বিশেষ করে নিম্নআয়ের দেশগুলো ক্যান্সারের প্রাথমিক সেবা ও চিকিৎসা দিতে অক্ষম।
মেডিকেল অনকোলজি সোসাইটি ইন বাংলাদেশ–এর প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা.পারভীন শাহিদা আখতার বলেছেন, ক্যানসার চিকিৎসায় উন্নত বিশ্বে অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। সেসব দেশে অধিকাংশ রোগীর ক্যানসার পূর্ব অবস্থায় বা প্রথম স্টেজেই রোগ নির্ণয় হয়। ফলে উপযুক্ত চিকিৎসার মাধ্যমে রোগ নিরাময় হয়; নিরাময়ের হার অনেক বেশি। অন্যদিকে আমাদের কাছে রোগীদের ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ আসেন তৃতীয় ও চতুর্থ পর্যায়ে।
বলা হয়, বর্তমানে ৪০ শতাংশ ক্যানসার প্রতিরোধ করা যায়। ক্যানসার চিকিৎসা একটি সমন্বিত চিকিৎসাপদ্ধতি। এটি জটিল, দীর্ঘমেয়াদি ও ব্যয়বহুল। কেবল কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি বা অস্ত্রোপচার নয়, বরং সব কটি চিকিৎসা সমন্বিতভাবে প্রয়োগ করতে হয়। এর বাইরে অন্যান্য সাধারণ চিকিৎসাও প্রয়োজন হয়। তাই সমন্বিত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দ্বারা পরিচালিত একটি টিম গঠন করে যথাযথ চিকিৎসা দেওয়া হলে ক্যানসার চিকিৎসার সুফল পাওয়া সম্ভব। আমাদের প্রয়োজনীয় ওষুধের ৯০ শতাংশের বেশি ওষুধ দেশীয় কোম্পানি থেকে পাচ্ছি। ফলে ক্যানসার চিকিৎসার খরচ কমে এসেছে অনেক গুণ। ক্যানসার কেমোথেরাপি বা ইমিউনো থেরাপির জন্য প্রয়োজনীয় ল্যাব আমাদের নেই। ওষুধের যথাযথ প্রয়োগের জন্য ল্যাব সুবিধা প্রয়োজন। মলিকুলার টেস্টগুলো না জানলে যথাযথ ওষুধ দেওয়া সম্ভব নয়। বর্তমানে ক্যানসার চিকিৎসায় রেডিওথেরাপি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি চিকিৎসাপদ্ধতি। বর্তমানে রোগীদের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশের রেডিওথেরাপি প্রয়োজন হয়। ক্যানসার নিরাময়, সহায়ক চিকিৎসা, প্যালিয়েটিভের জন্য রেডিওথেরাপি প্রয়োজন হয়। কিন্তু সরকারি ও বেসরকারি পর্যায় মিলে এ সুবিধা আছে যৎসামান্যই। বিষয়টির প্রতি নজর দেওয়া খুবই জরুরি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনো ক্যানসার চিকিৎসার ক্ষেত্রে আমাদের দেশে পরীক্ষা–নিরীক্ষা ও ওষুধের দাম পার্শ্ববর্তী দেশের তুলনায় বেশি। রোগীরা উন্নত পদ্ধতিতে রোগ নির্ণয় করতে গিয়ে সিংহভাগ টাকা ব্যয় করে ফেলেন। পরে দেখা যায়, চিকিৎসার জন্য ব্যয় করার টাকা অবশিষ্ট থাকে না। কর মওকুফ করে দেওয়ায় ভারতে ওষুধের দাম স্বয়ংক্রিয়ভাবে কমে গেছে। আমাদের চিকিৎসা ব্যয় বেশি। ক্যানসার চিকিৎসায় ধনী–গরিবের চিকিৎসা বৈষম্য দূর করতে সরকার ও বিত্তবানদের এগিয়ে আসতে হবে।