মামুন সিদ্দিকী রচিত “ভাষা সংগ্রামী মাহবুব উল আলম চৌধুরী ” গ্রন্থে একুশের পূর্বমুহূর্তের স্মৃতিচারণ করে ভাষা সৈনিক মাহবুব উল আলম চৌধুরী লিখেছেন” চট্টগ্রামে একুশে ফেব্রুয়ারি পালনের জন্য আমি, চৌধুরী হারুনুর রশীদ, আজিজুর রহমান সহ অনেকে বিভিন্ন এলাকায় সভা সমাবেশ করি। ২০ ফেব্রুয়ারি বিভিন্ন এলাকায় সভা সমাবেশ করে যখন অফিসে আসলাম তখন আমার ১০৪ ডিগ্রি জ্বর এবং গায়ে জলবসন্ত। সারাদিনই আমি গায়ে জ্বর এবং জলবসন্ত নিয়ে কাজ করেছি। কাজের উত্তেজনায় আমি এসব কিছু অনুভব করতে পারিনি। অসুস্থতার কারণে আমাকে আমাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। আমি যেহেতু ছাত্র ফেডারেশন এর রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলাম সে কারণে ছাত্র ফেডারেশনের একজন কর্মীকে আমার সঙ্গে দেয়া হয় কমিটির সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করার জন্য।একুশে ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে আসেন সর্বদলীয় ভাষা সংগ্রাম পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির একজন প্রভাবশালী সদস্য খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস। তিনি একজন বড় সাংবাদিক। তিনি একুশে ফেব্রুয়ারি বিকেল ৩ টার দিকে ঢাকায় যোগাযোগ করে জানতে পারেন ছাত্র জনতার মিছিলের উপর গুলি চলেছে এবং এতে অসংখ্য লোক মারা গেছে।কত লোক মারা গেছে তাও কেউ জানেনা এবং তখনো বরকত- সালামের নাম চট্টগ্রামে আসেনি। খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস এর কাছ থেকে এ খবর জানার পর সবাই ফুঁসে উঠলো। আমি বাড়িতে অসুস্থ অবস্থায় যখন ঢাকার গুলির খবর শুনলাম তখন “কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি” কবিতাটি শ্রুতিলিখনের মাধ্যমে লিখে ফেললাম। সন্ধ্যায় খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন এবং আমার এই দীর্ঘ কবিতাটি পড়েন। তিনি বলেন এটি অসাধারণ একটি কবিতা।এটি ছাপিয়ে ২৩ তারিখের জনসভায় বিলি করতে হবে এবং আবৃত্তি করে শোনাতে হবে”।
একদিকে ঢাকা যখন আন্দোলন সংগ্রামে রক্তে রঞ্জিত অন্যদিকে দেশের জেলা শহর গুলো ছিল ভাষার দাবীতে উত্তাল। বন্দর নগরীতে রচিত হয় রক্ত ঝরার প্রতিবাদে একুশের প্রথম কবিতা “কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি।” রচিত হয় ইতিহাস। কবিতাটি আন্দরকিল্লাহ কোহিনূর ইলেক্ট্রিক প্রেসে ছাপা হয় যার মূল্য ছিল দু আনা। প্রকাশক হিসেবে নাম ছিল কামাল উদ্দিন আহমদ খানের। ২৩ ফেব্রুয়ারি বিকেল ৩ টায় শুরু হওয়া সভার এক পর্যায়ে চৌধুরী হারুনুর রশিদ দৃপ্ত কন্ঠে কবিতাটি পাঠ করেন। স্লোগান ও করতালিতে কম্পিত হয় লালদিঘি ময়দান। সেদিনের বিশাল জনসমুদ্রের বিক্ষোভে প্রকম্পিত হয় বন্দরনগরী। ওইদিনই সরকার কবিতাটি বাজেয়াপ্ত করার ঘোষণা দেন, মাহবুব উল আলম চৌধুরীর উপর গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারী করে। কবিতা পড়ার অপরাধে ২৪ তারিখ চৌধুরী হারুনুর রশিদকে গ্রেপ্তার করা হয়। মাহবুব উল আলম চৌধুরী আত্মগোপনে যান, পুলিশ কোহিনূর ইলেক্ট্রিক প্রেসে তালা ঝুলিয়ে দেয়। কিন্ত এরিমধ্যে সৃষ্টি হয়ে গেছে ইতিহাস। মাহবুব উল আলম চৌধুরীর কলম দিয়ে চট্টগ্রাম সৃষ্টি করে একুশের প্রথম অমর কবিতা।
তাই এবারের একুশের মাসে কোহিনূর ইলেক্ট্রিক প্রেস ভবনটিকে (যেখান থেকে চট্টগ্রামের আজাদী পত্রিকা ছাপা হয়) ভাষা আন্দোলনের ঐতিহ্য স্মারক হিসেবে ঘোষণা দেয়ার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ জানাই।