কনস্তানতিন কোস্টা গাভরাস, তাঁর চলচ্চিত্রদর্শন সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘সিনেমাকে আমি প্রোপাগান্ডার মাধ্যম হিসেবে বিশ্বাস করি না। আমার ছবিগুলি কোনো একটি ঘটনা সম্পর্কে বক্তব্য রাখার চাইতে ঘটনাটি সম্পর্কে অবহিত করানোর কাজটাই মূলত করে থাকে। আমি আমার ছবিগুলির মাধ্যমে আমাদের এই রাজনীতিময় বিশ্বে অহরহ যা ঘটছে তার সম্বন্ধে সচেতন হবার জন্যে, সমস্যাগুলি অনুধাবন করবার জন্যে এবং তার অন্তর্নিহিত কারণসমূহ বোঝার ও প্রকাশ করার জন্যে অনুপ্রেরণা যোগাবার চেষ্টা করি এবং আমি এর যথার্থ সমাধান কোনটি তা নির্ণয়ের ভার ছেড়ে দিই দর্শকদের ওপর।’
কোস্টা গাভরাস রাজনৈতিক চলচ্চিত্রকার হিসেবে বিশ্বচলচ্চিত্রে পরিচিত এবং সমাদৃত। ১৯৩৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি গ্রিসের আর্কেডিয়ায় তাঁর জন্ম। আঠারো বছর বয়সে ফ্রান্সে চলে আসেন চলচ্চিত্রের পাঠ নিতে। সে থেকেই ফ্রান্সে। ফিল্ম ক্যারিয়ার গড়ে তোলেন প্যারিসে ধীরে ধীরে। শুরু থেকেই সাহসের পরিচয় দিয়ে ব্যতিক্রমধর্মী চলচ্চিত্র পরিচালনায় নিয়োজিত করেন নিজেকে। নিজেকে একজন ফরাসি চলচ্চিত্রকার বলেই শুরু থেকে ভেবে গেছেন তিনি। কর্মক্ষেত্র ফ্রান্সকে নিজের দেশ করে নিয়েছিলেন প্রথম থেকেই। ফ্রান্সও তাঁকে সর্বতো সহযোগিতা করে বরাবর। তিনিও একের পর এক দুর্ধর্ষ সব রাজনৈতিক চলচ্চিত্র নির্মাণ করে গেছেন। কোনো কোনো সময় কোনো ছবি বিভিন্ন দেশে প্রদর্শনের সময় বাধার সম্মুখীন হয়েছে। যেমন জেড, মিসিং, হান্নাকে। কিন্তু গাভরাস এগিয়ে গেছেন সব বাধা অতিক্রম করে।
কোস্টা গাভরাসের তৃতীয় ছবি ‘জেড’ (১৯৬৮) তাঁকে সারা চলচ্চিত্র বিশ্বে পরিচিত ও মনোযোগী করে তোলে এবং তাঁর নামটিকে সমার্থক করে তোলে রাজনৈতিক থ্রিলার চলচ্চিত্র রীতির সঙ্গে। ‘জেড’ গ্রিক ভাষায় পরিকল্পিত এবং ফরাসিতে নির্মিত। ১৯৬৩ সালে গ্রিসে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটবার প্রাক্কালীন ‘ল্যম্ব্রাকিস এ্যাফেয়ার’–যার কর্দয ফলাফল ১৯৬৭ সালে এথেন্সের রক্তাক্ত সামরিক অভ্যুত্থান। ছবিটি দীর্ঘদিন গ্রিসসহ আরও কয়েকটি দেশে নিষিদ্ধ ছিল। পরে এ নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়। ছবিটি শ্রেষ্ঠ বিদেশি ছবির অস্কার ও কান উৎসবে বিশেষ পুরস্কার অর্জন করে।
এর পরের ছবি ‘দ্য কনফেশন’ (১৯৬৯) ১৯৫২ সালের চেকোস্লোভাকিয়ার তথাকথিত প্রাগ শুদ্ধি অভিযান ও রাজনৈতিক বিচার প্রহসন এবং তার পূর্ববর্তী ঘটনাপঞ্জির ওপর নির্মিত। এই অভিযানে অনেক রাজনৈতিক কর্মীকে মৃত্যুদণ্ড ও অনেককে আমৃত্যু কারারুদ্ধাদেশ দেয়া হয়। অনেক পরে এসব অমানবিক কর্মকাণ্ডের অবসান ঘটে।
১৯৭২ সালে গাভরাস নির্মাণ করেন ‘স্টেট অফ সিজ।’ এ ছবিতে কোস্টা গাভরাস এমন একটি বিষয়ের ওপর দৃষ্টিপাত করান যা সে সময়ে তৃতীয় বিশ্ব বিশেষ করে লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে ঘটছিল। এটা হলো সাম্রাজ্যবাদী রাজনৈতিক ও সামরিক হস্তক্ষেপ এবং অনুপ্রবেশ। ছবিতে বিশ্বাসযোগ্য ডিটেলসের মধ্য দিয়ে প্রেক্ষাপটটিকে উপস্থাপন করা হয়েছে।
‘জেড’–এর পর যে ছবি কোস্টা গাভরাসকে সাহসী চলচ্চিত্রকার হিসেবে পুনরায় চলচ্চিত্র বিশ্বে পরিচিত করে তোলে সেটি ‘মিসিং’। ছবিটি ১৯৮২ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে তুর্কী চলচ্চিত্রকার ইলমাজ গুনের ‘ইউল’ (দি ওয়াল) ছবির সঙ্গে যৌথভাবে গ্রাঁ প্রি অর্জন করে। ‘মিসিং’–মার্কিন সাংবাদিক চার্লস হরম্যানের দুঃসহ জীবনের মর্মন্তুদ চিত্র। ১৯৭৩ সালে চিলিতে সংঘটিত সামরিক অভ্যুত্থানের পর পর চার্লস নিখোঁজ হন। অনেক খোঁজাখুঁজির পর শেষ পর্যন্ত চার্লসকে আবিষ্কার করা হয় চিলির রাজধানী সান্তিয়াগোর মর্গে। চার্লস হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে সান্তিয়াগোর মার্কিন দূতাবাসের সম্পৃক্তির বিষয়ে সন্দহ ঘনীভূত হয়।
‘মিসিং’–এর মুক্তির বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই প্রথম তাদের প্রচলিত রীতির ব্যতিক্রম ঘটিয়ে ছবিটির কিছু বিষয়কে অস্বীকার করে প্রতিবাদ স্বরূপ সুদীর্ঘ তিন পৃষ্ঠাব্যাপী এক অভূতপূর্ব অভিযোগপত্র প্রচার করে। এতদ্সত্ত্বেও ছবিটি বিশ্বজুড়ে মুক্তিলাভ করে এবং আলোড়ন তোলে।
‘স্টেট অফ সিজ’ এবং ‘মিসিং’ এর মধ্যবর্তী সময়ে গাভরাস ‘স্পেশাল সেকশন’ (১৯৭৫) ও ‘ক্লেয়ার দ্য ফম’ (ওমেনলাইট) (১৯৭৯) এ দুটি ছবি পরিচালনা করেন। ‘স্পেশাল সেকশন’ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে হিটলারের নাৎসি বাহিনীর তাঁবেদার ফ্রান্সের ভিশি সরকারের কার্যকলাপ নিয়ে চিত্রিত। ‘ক্লেয়ার দ্য ফম’ (ওমেনলাইট) ছবিতে অবশ্য রাজনীতি সরাসরি না এসে এসেছে পরোক্ষভাবে এক মধ্যবয়েসী দম্পতির জীবন প্রাত্যহিকীর মধ্য দিয়ে।
কোস্টা গাভরাসের প্রথম ছবি ‘স্লিপিং কার মার্ডারস’ (১৯৬৪) এবং দ্বিতীয় ছবি ‘শক ট্রপস’ (১৯৬৬) তাঁর পরবর্তী ছবিগুলির মতো সরাসরি রাজনীতি সম্পৃক্ত না হলেও রাজনীতির ছোঁয়া রয়েছে দু’টি ছবিতেই। স্বল্পজ্ঞাত এ দু’টি ছবিকে তাঁর রাজনৈতিক চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রস্তুতি পর্ব বলে ধরে নেয়া যায়।
‘মিসিং’ ছবিতেই গাভরাস থ্রিলার পদ্ধতি থেকে আরও খোলামেলা ডকু–ফিকশন পদ্ধতির দিকে ঝোঁকেন। ‘মিসিং’ এরপর তিনি তৈরি করেন তাঁর আরেক দুঃসাহসিক চলচ্চিত্র ‘হান্না কে’ (১৯৮৩)। ছবিটি সে সময় যথেষ্ট বিতর্ক তৈরি করেছিল। প্রধান কারণ এ ছবিতে তিনি মধ্যপ্রাচ্য সমস্যাকে নির্মোহ দৃষ্টিতে তুলে ধরেছিলেন। যা নির্যাতিত ফিলিস্তিনিদের পক্ষে চলে গিয়েছিল। ইসরায়েলের প্রতি অনেক সমালোচনা ছিল ছবিতে। এ ছবিতে তিনি প্রথমবারের মতো এমন একটি জটিল সমস্যা নিয়ে কথা বলেন যে সমস্যায় মধ্যপ্রাচ্য এখনও আক্রান্ত এবং যার কোনো আপাতঃ সহজ সমাধান নেই।
এরপর গাভরাস একে একে আরও ১১টি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন ২০১৯ সাল পর্যন্ত। যার মধ্যে ‘ফ্যামিলি বিজনেস’ (১৯৮৬), ‘দ্য লিটল অ্যাপোকেলিপস (১৯৯৩), ‘ম্যাড সিটি’ (১৯৯৭), ‘আমেন’ (২০০২), ‘দি এক্স’ (২০০৫), ‘দি কলোনে’ (২০০৬), ‘ক্যাপিটাল’ (২০১২) অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য। শেষ ছবিটি তিনি পরিচালনা করেন ২০১৯ সালে । ‘এডাল্টস ইন দ্য রুম’। এর বাইরে চারটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্রও নির্মাণ করেছেন। নিজের একটি ছবি (স্পেশাল সেকশন)সহ অন্য পাঁচটি ছবিতে অভিনয়ও করেছেন। ছয়টি ছবি তিনি নির্মাণ করেছেন ইংরেজি ভাষায় যার মধ্যে রয়েছে ‘হান্না কে’। ৯১ বছর বয়সে এখন অবসর জীবন যাপন করছেন কোস্টা গাভরাস। তাঁর তিন পুত্র কন্যা (আলেকজান্ডার, জুলি ও রোমেন) পিতার পদাংকানুসরণ করে চলচ্চিত্র নির্মাণে যুক্ত।