কোরীয়দের সঙ্গে ইসলামের আন্তঃ সামাজিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে প্রায় ১২শত বছর আগে কিন্তু গত শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত কোরীয় ভাষায় পবিত্র কোরআনের কোনো অনুবাদ ছিল না। ‘ইসলামিক কল ইন কোরিয়া’ নামে খ্যাত ‘ড. হামিদ চৈ ইয়াং কিল’ সাত বছর কঠোর গবেষণা চালিয়ে অবশেষে কোরীয় ভাষায় কোরআনের প্রথম অনুবাদকারী হিসেবে গৌরব অর্জন করেন।
ইসলামের সাথে কোরিয়ার প্রথম সাক্ষাৎ ছিল বাণিজ্যিক। মুসলিম ঐতিহাসিক ও ভূগোলবিদদের মতে, কোরীয় উপদ্বীপের সঙ্গে মুসলিম ব্যবসায়ীদের সংযোগ স্থাপিত হয় খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীর মধ্যভাগে। কোরিয়ায় ইসলাম সংস্কৃতির শীর্ষ পণ্ডিত এবং সিউলের হানইয়াং বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি ও নৃতত্ত্ব বিভাগের ‘অধ্যাপক লি হি সুর’এর বর্ণনা মতে, মুসলিম সম্প্রদায়কে জোসন সাম্রাজ্যের আদালতের অনুষ্ঠানের সময় কোরআন তেলাওয়াত করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। যা কোরিয়াতে মুসলিমদের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতির ইঙ্গিত দেয়।
মুসলিম ঐতিহাসিক ও ভূগোলবিদ ‘ইবনে খারদাজবাহে’র বর্ণনা মতে, কোরীয় উপদ্বীপে খ্রিস্টীয় নবম শতকে শিলা রাজ্যে মুসলিমদের স্থায়ী আবাস গড়ে ওঠে। কোরিয়ায় শিলা সাম্রাজ্য ও মধ্যপ্রাচ্য দুই দেশের মধ্যে সংযোগ গড়ে ওঠার মাধ্যমে ইসলামিক স্বর্ণযুগের সূচিত হয়। এটি যখন মুসলিম বিশ্ব পূর্বে ফিলিপাইন থেকে পশ্চিমে সাইবেরীয় উপদ্বীপ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
প্রশাসনিক পদে মুসলিমদের দায়িত্ব পালন সহ ১৬ শতক পর্যন্ত কোরীয় উপদ্বীপের সাথে মুসলিম বণিকদের সখ্যতা গড়ে ওঠে এবং বিভিন্ন অঞ্চলে মসজিদ নির্মাণ করা হয়। কিন্তু রাজবংশ চীন ব্যতীত বিদেশী সংস্কৃতির ও রীতিনীতির প্রতি দমন নীতির ফলে কোরিয়ায় ইসলাম বিলুপ্ত হয়ে গেলেও কোরীয় যুদ্ধ (১৯৫০-১৯৫৩) পর্যন্ত আন্তঃকোরীয় সংঘাতে দক্ষিণ কোরিয়াকে সাহায্য করার জন্য দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে তুরস্ক থেকে সৈন্যদের আগমনের পর ইসলাম সংস্কৃতি দক্ষিণ কোরিয়াতে পুনরুত্থিত হতে শুরু করে।
এছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত কোরীয় নাগরিকরাও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে এবং দক্ষিণ কোরিয়ায় কর্মরত মুসলিম অভিবাসীদের মাধ্যমেও অনেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে।
১৯৫৫ সালে তুর্কি সেনাদের তত্ত্বাবধানে সিউলে প্রথম অস্থায়ী মসজিদ নির্মিত হলেও ১৯৬৫ সালে কোরিয়া মুসলিম ফেডারেশন (কেএমএফ) প্রতিষ্ঠার পর দক্ষিণ কোরিয়াতে ইসলাম স্বীকৃত হয়।
এটি শুধু মুসলমানদের জন্য পবিত্র গ্রন্থ কোরআনের মাধ্যমে দক্ষিণ কোরিয়ায় আল্লাহ ও নবী মোহাম্মদের বাণী ছড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ তৈরি করেনি বরং ১৯৭৬ সালে দেশের প্রথম সরকারি মসজিদ প্রতিষ্ঠারও সুযোগ করে দিয়েছে।
ড. হামিদ চৈ-এর শৈশব ও পারিবারিক ইতিহাস সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য পাওয়া না গেলেও জানা যায়, তার বয়স বর্তমান প্রায় ৭০ বছর। তিনি ১৯৭৫ সালে হানকুক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরবি ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একই বিষয়ে তিনি স্নাতকোত্তর ডিগ্রিও অর্জন করেন। তিনি ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব মদিনা থেকে ‘ফান্ডামেন্টালস অব রিলিজিয়ন এন্ড দাওয়াহ’ বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন (১৯৭৬-১৯৮০ খ্রি.)।
এসময় আরব বিশ্বের খ্যাতিমান আলেম শায়খ আব্দুল্লাহ বিন বাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। আল্লামা শফিউর রহমান মোবারকপুরী রচিত মহানবী (সা.)-এর প্রসিদ্ধ জীবনী গ্রন্থ ‘আর-রাহিকুল মাখতুম’-এর কোরীয় অনুবাদের জন্য ২০০৮ সালে ‘কিং আবদুল আজিজ ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড ফর ট্রান্সলেশন’ লাভ করেন।
ড. হামিদ চৈ-এর জীবনের সবচেয়ে বড় সাফল্য হলো কোরীয় ভাষায় পবিত্র কোরআনের অনুবাদ সম্পন্ন করা। এটি একমাত্র কোরীয় ভাষায় কোরআনের প্রথম অনুবাদ। এছাড়া তিনি এ পর্যন্ত ৩০টির বেশী ইসলামী বই কোরীয় ভাষায় অনুবাদ করেছেন।
তিনি ১৯৮৬ সালে সুদানের খার্তুমে অবস্থিত উমদুর্মান ইসলামিক ইউনিভার্সিটি থেকে ‘ইসলামিক কল ইন কোরিয়া’ শিরোনামে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন।
পেশাগত জীবনে ড. হামিদ চৈ ইয়াং কিল একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। কর্মজীবনে মিয়নজি বিশ্ববিদ্যালয় সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। তিনি ‘মুসলিম ওয়ার্ল্ড লীগ’ এর সদস্য এবং কোরিয়ান মুসলিম ফেডারেশন (কেএমএফ)-এর চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।