নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলায় এক নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন এবং ভিডিও ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া, তাদের বিকৃত মানসিকতার বিষয়টিকে সামনে এনেছে। এ নিয়ে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে জনমনে। এসব ঘটনার পেছনে ত্রুটিপূর্ণ পারিবারিক শিক্ষা, নারীকে হীন করে দেখার সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং দীর্ঘদিন ধরে বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ভিডিও চিত্রে দুর্বৃত্ত যাদের দেখা গেছে, তাদের বেশিরভাগের বয়স ২০ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে বলে অনুমান করা হচ্ছে। কৈশোর থেকে সদ্য তারুণ্যে পা দেওয়া এই বয়সটিতে ক্ষমতা প্রদর্শনের মানসিকতা কাজ করে বলে জানান মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মেখলা সরকার। নারীর প্রতি সহিংসতাকে যৌনতা থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে নারীকে দমিয়ে রাখা ক্ষমতার প্রকাশ হিসাবে দেখছেন তিনি। এই বয়সে নীতি-নৈতিকতার শিক্ষায় পরিপক্ব হওয়ার কথা থাকলেও ওই তরুণদের বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় ত্রুটি থাকায় তারা বিকৃতভাবে ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে। তিনি বলেন, কেউ ধর্ষক হয়ে জন্মায় না। তার পরিবার কী শিখিয়েছে এবং কেমন পরিবেশে সে বড় হয়েছে সেটার অনেক বড় প্রভাব থাকে।
এছাড়া বর্তমানে তথ্য প্রযুক্তির যে জোয়ার উঠেছে সেটার কোনো নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি না থাকায় কিশোর ও তরুণ সমাজ নৈতিক শিক্ষা থেকে ক্রমশ ছিটকে পড়ছে। অভিভাবকরা এই বিষয়গুলোর তদারকি দূরে থাক, তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। এ কারণে এই কিশোর তরুণদের মানসিকতা ভুল দিকে পরিচালিত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। বর্তমানে মানুষের জীবনযাত্রা ও চিন্তাভাবনা প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণ করায় পরিবারকে এর নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিত করার ওপর জোর দিয়েছেন তিনি। খবর বিবিসি বাংলার। সমাজবিজ্ঞানী সায়মা হক বিদিশা বলেন, অপরাধীরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, মাদক চক্র, প্রভাবশালী ব্যবসায়ীর ছত্রছায়ায় থাকার কারণে তারা বারবার অপরাধ করে পার পেয়ে যাচ্ছে। ফলে তাদের ঠেকানো যাচ্ছে না।
নারীর প্রতি একের পর এক সহিংস ঘটনার পেছনে বড় কারণ হিসেবে বিচারহীনতার সংস্কৃতি, বিচারের দীর্ঘসূত্রতা এবং সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে না ওঠাকে চিহ্নিত করেছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞ ফারজানা রহমান। এছাড়া পরিবার, সমাজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্রে সঠিক যৌনশিক্ষা ও জেন্ডার শিক্ষা না দেওয়ায় তরুণরা ত্রুটিপূর্ণ মানসিকতা নিয়ে বেড়ে উঠছে বলে তিনি জানান। অযৌক্তিকভাবে যৌন চাহিদা মেটানোর এই বিকৃত মানসিকতা দূর করতে ছোটবেলা থেকে সঠিক যৌনশিক্ষা ও জেন্ডার শিক্ষা থাকা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
এছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, তদন্ত প্রক্রিয়া, আদালত থেকে শুরু করে বিচার বিভাগীয় ব্যবস্থায় যে দুর্বলতা আছে, সেটাকে শক্তিশালী না করলে, বিচার ব্যবস্থাকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে না দিলে এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি না ভাঙা পর্যন্ত এ ধরনের অপরাধ দমন করা সম্ভব নয়। এছাড়া বিকল্প উপায়ে এই অপরাধীদের সংশোধনের সুযোগও বাংলাদেশে অনেক কম।
সমাজবিজ্ঞানী সায়মা বলেন, সমাজ থেকে নারীকে দমন করা বা অসম্মান করার মানসিকতা দূর করা না গেলে এ ধরনের সহিংসতার ঘটনা বারবার ঘটবে। এক্ষেত্রে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার পাশাপাশি পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমে প্রচার-প্রচারণা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। তবে আইনের শাসন না থাকলে পারিবারিক শিক্ষাও কাজ করবে না বলে জানান তিনি।