কোন কথায় রেগে যান জেলেনস্কি কখন মেজাজ হারালেন ট্রাম্প

উত্তপ্ত ১০ মিনিটে যেভাবে ভেস্তে গেল বৈঠক

আজাদী ডেস্ক | রবিবার , ২ মার্চ, ২০২৫ at ৬:০৫ পূর্বাহ্ণ

হোয়াইট হাউসে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। কিন্তু তাদের বৈঠক ফলপ্রসূ হয়নি। বরং ট্রাম্প এবং আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভান্সের সঙ্গে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয় জেলেনস্কির। বৈঠকের মাঝপথেই ইউক্রেনের প্রতিনিধিদের বেরিয়ে যেতে বলা হয় ওভাল অফিস থেকে। পূর্বপরিকল্পিত মধ্যাহ্নভোজনও করেননি তারা কেউ। বাতিল হয়েছে বহু আলোচিত খনিজ চুক্তি। কিন্তু কেন ট্রাম্পজেলেনস্কির বৈঠকের এই পরিণতি হল? কী কথা হয়েছিল দুই রাষ্ট্রপ্রধানের মধ্যে? ঠিক কোন কথায় রেগে গিয়েছিলেন জেলেনস্কি?

ট্রাম্প এবং জেলেনস্কির বাগ্‌বিতণ্ডা স্থায়ী হয় প্রায় ১০ মিনিট। তাতে বড় ভূমিকা ছিল ভান্সেরও। মূলত তার একটি কথার উত্তর দিতে গিয়েই পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। তার পর সংবাদমাধ্যমের সামনেই একে অপরকে দোষারোপ করে চলেন ট্রাম্প, ভান্স এবং জেলেনস্কি।

বৈঠকের শুরুটা ভাল ভাবেই হয়েছিল। জেলেনস্কি, ট্রাম্প একে অপরকে অভিবাদন জানিয়েছিলেন। এরপর সংবাদমাধ্যমের সামনে পূর্বতন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে কটাক্ষ করে ভান্স বলেন, চার বছর ধরে আমেরিকার একজন প্রেসিডেন্ট সংবাদমাধ্যমের সামনে দাঁড়িয়ে ভ্লাদিমির পুতিনকে নিয়ে কড়া কড়া কথা বলে গিয়েছেন। তারপর পুতিন ইউক্রেন আক্রমণ করলেন। দেশের একটা বড় অংশ ধ্বংস করলেন। আসলে শান্তি এবং উন্নয়নের পথ হল কূটনীতির পথ। তিনি বলে চলেন, বাইডেনের পথে হেঁটে আমরা দেখেছি। আমরা রাশিয়ার বিরুদ্ধে কড়া কড়া কথা বলে দেখেছি। কাজে কিছু করে দেখাইনি। আসলে আমেরিকা যদি কূটনীতির পথে হাঁটে, তবেই আমেরিকা একটি সুন্দর দেশে পরিণত হতে পারবে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সেই চেষ্টাই করে চলেছেন। ভান্সের এই বক্তব্যের পর জেলেনস্কি তাকে একটি প্রশ্ন করতে চান। তিনি বলেন, পুতিন আমাদের দেশ আক্রমণ করলেন। বড় অংশ দখল করে নিলেন। ২০১৪ সাল থেকে এটা চলছে। শুধু বাইডেনের কথা বলছি না। ওবামা ছিলেন। তারপর ট্রাম্প ছিলেন, বাইডেন ছিলেন, এখন আবার ট্রাম্প এসেছেন। ২০১৪ সালে কিন্তু কেউ পুতিনকে আটকাননি। উনি বিনা বাধায় আমাদের দেশ দখল করেছেন। মানুষ মেরেছেন। ২০২২ পর্যন্ত ছবিটা একই ছিল। আমরা পুতিনের সঙ্গে অনেক কথা বলে দেখেছি। অনেক চুক্তি করে দেখেছি। কিন্তু তারপরেও বার বার উনি যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করেছেন। আমাদের দেশের মানুষদের মেরেছেন। বন্দিদের ফেরত দেননি। কোনও শর্ত মানেননি। ভান্স, এরপরেও আপনি কোন কূটনীতির কথা বলছেন? এর মানে কী?

ভান্স জবাব দেন, আমি সেই কূটনীতির কথাই বলছি, যেটা আপনার দেশে এই ধ্বংসলীলা বন্ধ করবে। জেলেনস্কি বললেন, ঠিক। কিন্তু আপনি যদি। তাকে থামিয়ে ভান্স বলেন, মিস্টার প্রেসিডেন্ট, আপনাকে সম্মান করি। কিন্তু ওভাল অফিসে এসে আমেরিকান সংবাদমাধ্যমের সামনে এই ধরনের কথা বলে আপনি আমাদের অশ্রদ্ধা করছেন। আপনার তো আমাদের প্রেসিডেন্টকে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত!

জেলেনস্কি বলেন, আপনি যদি কখনও ইউক্রেনে যেতেন এবং সেখানকার মানুষের সমস্যাটা নিজের চোখে দেখতেন, তা হলে এই কথা বলতেন না। ভান্স বলে উঠলেন, আমি দেখেছি অনেক কিছুই। আমি জানি, আপনি কীভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে মানুষের সামনে নিজের কথা প্রচার করেন। আপনার লোকজনকে সেনাবাহিনীতে আনতে সমস্যা ছিল, এটা কি অস্বীকার করতে পারেন? ওভাল অফিসে এসে আপনি সেই দেশের প্রশাসনকেই অপমান করছেন, যারা আপনার দেশকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে? এটা কি সম্মানজনক?

জেলেনস্কি বলেন, যুদ্ধের সময়ে প্রত্যেকটা দেশের নিজের নিজের সমস্যা থাকে। আপনারা কিছু অনুভব করছেন না। তাই সুন্দর সমাধান বলে দিতে পারছেন। ভবিষ্যতে আপনারাও এই জিনিস অনুভব করবেন।

ইউক্রেন প্রেসিডেন্টের এই মন্তব্যে মেজাজ হারান ট্রাম্প। তিনি বলেন, আমরা কী অনুভব করব না করব, আপনাকে সেটা বলে দিতে হবে না। আমরা একটা সমস্যার সমাধান করতে চাইছি। আমরা কী অনুভব করব, আপনি বলবেন না সেটা।

জেলেনস্কি জানান, আমি আপনাদের সেটা বলছি না। আমি তো শুধু উত্তর দেওয়ার। ট্রাম্প জেলেনস্কিকে থামিয়ে দিয়ে গলার স্বর চড়িয়ে বললেন, আমরা কী অনুভব করব সেটা বলে দেওয়ার মতো জায়গায় আপনি নেই। আমরা খুব ভাল এবং শক্তিশালী হিসাবেই আছি। বরং আপনি নিজে এই মুহূর্তে খুব একটা ভাল জায়গায় নেই। নিজেই নিজেকে সেই জায়গায় নিয়ে গিয়েছেন। লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন নিয়ে আপনি ছিনিমিনি খেলছেন। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে জুয়া খেলছেন। আমেরিকাকে অপমান করছেন।

ভান্স জানতে চাইলেন, আপনি কি এক বারও আমাদের কাউকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন? জেলেনস্কি বলেন, অনেক বার। ভান্স বললেন, না, আমি এই বৈঠকের কথা বলছি। আমেরিকা আপনার দেশকে সাহায্যের চেষ্টা করছে। এক বারও এই বৈঠকে আপনি আমেরিকাকে ধন্যবাদ দিয়েছেন? জেলেনস্কি বললেন, আপনারা মনে করছেন, আপনারা গলা চড়িয়ে কথা বলবেন যুদ্ধ নিয়ে আর

ট্রাম্প বলে উঠলেন, উনি গলা চড়িয়ে কথা বলছেন না। আপনার দেশ বড় সমস্যার মধ্যে আছে। আপনি অনেক কথা বলে ফেলেছেন। আপনারা এই যুদ্ধে জিততে পারবেন না। আমাদের সাহায্যে আপনি এর মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন। আমাদের অস্ত্র নাপেলে দু’সপ্তাহও টিকত না এই যুদ্ধ। জেলেনস্কি বলেন, আমি পুতিনের কাছ থেকেও একই কথা শুনেছিলাম। উনিও বলেছিলেন, যুদ্ধ তিন দিন টিকবে না।

ট্রাম্প বলেন, এভাবে তো ব্যবসা করা খুব মুশকিল হয়ে পড়ছে। আপনার দেশে মানুষ মরছে। আপনার কাছে পর্যাপ্ত সেনা নেই। আর আপনি বলছেন, আপনি যুদ্ধবিরতি চান না! আপনার মধ্যে কোনও কৃতজ্ঞতা নেই। এটা খুব একটা ভাল কথা নয়। অনেক হয়েছে।

এই বলে ৪০ মিনিটের বৈঠকে আচমকা ইতি টানেন, চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়েন ট্রাম্প। পরে সমাজমাধ্যমে তিনি জানিয়েছেন, শান্তি চাইলে জেলেনস্কির সঙ্গে আলোচনার রাস্তা এখনও খোলা আছে। নিজের ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চাইতে রাজি হননি জেলেনস্কি। আমেরিকার সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেছেন, তিনি ক্ষমা চাইবেন না। তবে ট্রাম্পের সঙ্গে সম্পর্কের মেরামত সম্ভব। আমেরিকার সাহায্যের কথাও তিনি স্বীকার করে নিয়েছেন।

যুক্তরাষ্ট্রইউক্রেন খনিজ চুক্তির মাধ্যমে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে কিয়েভের সম্পর্ক ফের ভালো হবে বলে আশা করেছিল ইউক্রেন ও তার ইউরোপীয় মিত্ররা। কিন্তু সব প্রত্যাশাই ভেস্তে গেছে, ট্রাম্প ও জেলেনস্কির ওই বৈঠক নজিরবিহীন তর্কাতর্কিতে বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে শেষ হয়ে। ইতিবাচক আলোচনার আশা নিয়ে হোয়াইট হাউজে গিয়েছিলেন জেলেনস্কি। কিন্তু তার বদলে বিশ্ব গণমাধ্যমের সামনে চূড়ান্তভাবে অপদস্থ হন তিনি। প্রথম আধ ঘণ্টা সবকিছু ভালোভাবে চলার পর পরবর্তী ১০ মিনিটের উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে এসব ঘটনা ঘটে যায়। খনিজ চুক্তি নিয়ে আর কোনো আলোচনাই হয়নি এবং এর ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসীমান্তে নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কার কারণ নেই
পরবর্তী নিবন্ধমাহে রমজানের পবিত্রতা রক্ষায় সকলকে এগিয়ে আসার আহ্বান