কবি বলেছিলেন, ‘আমারই চেতনার রঙে পান্না হলো সবুজ,/ চুনি উঠলো রাঙা হয়ে।/ আমি চোখ মেললুম আকাশে,/ জ্বলে উঠলো আলো, পুবে পশ্চিমে/ গোলাপের দিকে চেয়ে বললুম, ‘সুন্দর’।/ সুন্দর হলো সে। ’
সুপ্রিয় পাঠক আজ আপনাদের কবিগুরুর সেই মনিমুক্তাখচিত পান্না নয়, এক অসহায় বালিকা পান্না কিভাবে নিজেকে অপরাজিতায় স্থান করে নিয়েছেন , তাঁর কাহিনী শোনাবো।
চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার ছোট্ট একটি বৌদ্ধ অধ্যুষিত গ্রাম কোটের পাড়। এই গ্রামের বাসিন্দা সুভাষ বড়ুয়া আর ভানু বড়ুয়ার তিন সন্তানের একজন পান্না বড়ুয়া। পিতা মাতার সংসারে তেমন একটি অভাব অনটন ছিল না। পরিবারের বড় কন্যা হিসাবে অনেকটা আদর আর আহ্লাদেই বেড়ে উঠেছিল পান্না। কিন্তু, যখন দশম শ্রেণিতে পড়ছেন, তখন এই বালিকাকে বসতে হয় বিয়ের পিঁড়িতে। মিরসরাই উপজেলার দমদমা গ্রামের জনৈক প্রদীপ বড়ুয়ার সাথে পান্না গাঁটছড়া বাঁধেন। বিয়েতে ছেলে পক্ষ যৌতুক হিসাবে যা যা দাবি করেছিল, সবই পান্নার পিতা পূরণ করেছিলেন। স্বামীর পরিবার বিশাল। ছয় বোন একভাই। চারবোনের বিয়ে হলেও বাকি দুবোন ছিল অবিবাহিত। সাথে শ্বশুর মশাইও আছেন। এমন এক সংসারে বউ হিসাবে এসে সংসারের স্বপ্ন দেখা তো দূরের কথা, যেন খেয়েদেয়ে কোনোরকমে বেঁচে থাকাই হলো তার বিবাহিত জীবনের সূচনা। টানাটানি আর অভাবের সংসার। এরই মাঝে বিয়ের ১৪ মাসের মাথায় পান্না এক কন্যা সন্তানের জননী হলেন। আর সেই সন্তানের জন্ম দেয়ার পরই শুরু হলো তার দুর্ভোগের জীবন। ক্ষুধা আর তৃষ্ণার কি জ্বালা, পান্না সেটি তখন থেকেই বুঝতে শুরু করেছেন। এই অবস্থায় শশুরবাড়ির নানান গঞ্জনা। সন্তান হওয়ার পর কিছু দিল না বাপের বাড়ি থেকে , সেই খোঁটা প্রতিদিন। বাবার বাড়ি থেকে কিছু না পেলে সন্তানই বা কেন পেটে নিল? এই ধরনের মারাত্মক অপমানে পান্না দিন দিন জর্জরিত হচ্ছিল। এই অবস্থায় ঝগড়াঝাটি আর শারীরিক নির্যাতনে পান্নার জীবন শশুরালয়ে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। একদিন স্বামীর নির্যাতন আর সহ্য করতে না পেরে পান্না বাবার বাড়িতে চলে আসে। এরপর শুরু হয় আরেক সংগ্রাম। এবার তার মুখেই শুনি জীবনের গল্প । পান্না বলতে থাকেন, আমার স্বামী লোকজন নিয়ে আমাকে নিয়ে যেতে আসেন। স্বামীর সাথে গিয়েও শান্তি নাই। একে তো অভাবের তাড়না, অন্য দিকে ননদদের যন্ত্রণা। খেতে দেয় না, পরতে দেয় না। বাচ্চাকেও ঠিকমতো খাবার দিতে পাচ্ছে না। মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে বেড়ায় একমুঠো অন্নের আশায়। মানুষের বাড়িতে কাজ করে যা পেতাম , তাই খেয়ে ক্ষুধা নিবারণ করতাম। ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করতে না পেরে একদিন পান্না এলাকার মহিলা মেম্বারের সাথে দেখা করেন যদি, কোনো সাহায্য সহযোগিতা পাওয়া যায় কিনা, সে আশায়। তিনি পান্নাকে ইউনিয়ন পরিষদে যেতে বলেন। পান্না বোর্ড অফিসে গেলে তিনি পান্নাকে অপরাজিতা প্রশিক্ষণে ভর্তি করিয়ে দেন। কিছু টাকাও দেন সংসারে খরচ করার জন্য। পান্না বলেন, এরপর থেকে আমি প্রতিটি প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করি। তখন থেকেই বুঝতে পারি, আসলে সরকারিভাবে অনেক সুবিধা রয়েছে নির্যাতিত মহিলাদের জন্য। একজন নারীর খেয়ে পরে বেঁচে থাকার মৌালিক অধিকারগুলো কি? সেগুলো সম্পর্কে ধারণা পেতে শুরু করলাম। দেখলাম নির্যাতিত মহিলাদের জন্য কঠোর আইন আছে, যা আমরা জানতাম না। আমাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য অনেকেই আছেন।
এবার আর দেরি নয়, উঠে পড়ে লেগে গেলাম, নিজেকে একটি অবস্থানে নিয়ে আসার। এই পর্যন্ত জীবনে ঘটে যাওয়া যাবতীয় অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে আওয়াজ দেবার প্রতিজ্ঞা করলাম। নিজের কন্যাকে মানুষ হিসাবে গড়ে তোলার ব্রত নিলাম। এসময় একদিন টেলিভিশনে দেখেন মাশরুম চাষের ওপর একটি তথ্যচিত্র। পান্না সেটি দেখে, মাশরুম চাষের প্রশিক্ষণ নিতে আগ্রহী হন। তিনি অপরাজিতার জিয়া ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করলে, তিনি পান্নাকে কৃষি অফিসে গিয়ে যোগাযোগ করার কথা বলেন। পান্না কৃষি অফিসে গেলে কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা পান্নাকে কুমিল্লায় মাশরুম প্রশিক্ষণ সেন্টারে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠান। প্রশিক্ষণ নিয়ে পান্না এলকায় এসে মাশরুম চাষ শুরু করেন। গ্রামীণ ব্যাংক থেকে পাঁচ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে পান্না ব্যবসা শুরু করেন। দুইমাস না যেতেই পান্নার কাছে লাভের টাকা আসতে শুরু করে। এলাকায় এই খবর ছড়িয়ে পরলে অন্য লোকজনেরা পান্নার কাছে এসে মাশরুম চাষ সম্পর্কে জানতে আসে। এতে আবার বিপরীত ইমেজও তৈরি হয়। এলাকার লোকজন কানাঘুষা শুরু করে, কেন তার বাড়িতে এতো লোকের আনাগোনা! এই অবস্থায় পান্না অপরাজিতার কর্মীদের সাথে শেয়ার করেন তার সংকটের কথা। তারা তাকে সাহস দেন । নির্বিঘ্নে কাজ করে যাবার পরামর্শ দেন।
কাজেই আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি পান্নাকে। পান্না এখন রীতিমতো মাশরুম বিশেষজ্ঞ। তিনি এলাকায় আগ্রহী নারীদের মাশরুম চাষে প্রশিক্ষণ দেন। নারীদেরকে কৃষি বিভাগের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। সরকারি সেবাগুলো কিভাবে কোথা থেকে নেবে সব বাৎলে দেন। পান্না একটি সরকারি মাশরুম খামার সুবিধা পাবার অপেক্ষায় আছেন। পাশাপাশি তিনি ব্র্যাক এর স্বাস্থ্যকর্মী হিসাবে কাজ করছেন। তিনি এলাকায় কৃষক দলনেতা হিসাবেও নিজেকে পরিচিত করে তুলেছেন। পান্না বলেন, যে স্বামী একদা নির্যাতন করতেন, তিনি এখন অনেক বদলে গেছেন। সব কাজেই সহযোগিতা করেন। পান্না দুই মেয়ে ও এক ছেলের সফল জননী। নিজে বেশি পড়ালেখা করতে পারেন নি, তবে সন্তানদের তিনি পড়লেখা করাচ্ছেন, এতেই আনন্দিত। পান্না বলেন, অনেক কষ্ট আর সংগ্রাম করে নিজের পায়ের ওপর নিজেই দাঁড়িয়েছি।
এলাকাবাসী আমাকে সম্মান করে। আমি সকলের কাছে মাশরুম দিদি হিসাবেই পরিচিত। এসব সম্ভব হয়েছে কেবল অপরাজিতা নেটওয়ার্কের কারণে। অপরাজিতা আমাদেরকে কথা বলতে শিখিয়েছে, শিখিয়েছে কিভাবে নিজের পায়ে নিজে দাঁড়াবো। পিতার ঘরে জন্ম নিয়ে যে পান্না নাম তিনি ধারণ করেছিলেন, দীর্ঘ সংগ্রাম আর কষ্টকে বরণ করে তিনি প্রমাণ করেছেন, আসলেই তিনি পান্না চুনি মুক্তা।