কেমিক্যালসহ ক্ষতিকর পণ্যবাহী জাহাজেই ভোগ্যপণ্য পরিবহন

ধুয়ে পরিষ্কার না করায় বাড়ছে জটিল রোগের ঝুঁকি ।। মানা হচ্ছে না খাদ্য অধিদপ্তর থেকে অনাপত্তি পত্র নেয়ার নিয়ম

হাসান আকবর | রবিবার , ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ at ৫:৪৫ পূর্বাহ্ণ

দেশের অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন রুটে পণ্য পরিবহনে জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি সৃষ্টি করা হচ্ছে। প্রচলিত নিয়ম না মেনে বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যালসহ ক্ষতিকর পণ্যবাহী জাহাজেই ভোগ্যপণ্য পরিবহন করা হচ্ছে। নিয়মানুযায়ী সার, ক্লিংকার, কেমিক্যাল, কয়লা জাতীয় পণ্য পরিবহনের পর ওই লাইটারেজ জাহাজটি পুরোপুরি পরিস্কার করার পরই কেবল ভোগ্যপণ্য পরিবহন করার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু ব্যাপারটি ব্যয়বহুল এবং কষ্টকর হওয়ায় লঙ্ঘন করা হয় নিয়ম। সরকারি খাতের চাল গম পরিবহনকালে কিছু নিয়মকানুন অনুসরণ করা হলেও বেসরকারি খাত চলে অনিয়ন্ত্রিতভাবে। বিষয়টি নিয়ে সাধারণ ভোক্তাদের পক্ষ থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।

সূত্র জানিয়েছে, লাখ লাখ টন ভোগ্যপণ্যসহ দেশের আমদানি বাণিজ্যের ৮০ শতাংশেরও বেশি হ্যান্ডলিং হয় চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে। প্রতিবছরই এর পরিমাণ বাড়ছে। বিশ্বের নানাদেশ থেকে বড় বড় জাহাজে বোঝাই করে এসব পণ্য আমদানি করা হয়। এগুলো বহির্নোঙরে পণ্য খালাস করে। কোন কোন জাহাজ বহির্নোঙরে সমুদয় পণ্য খালাস করে আবারো বিদেশের পথ ধরে। আবার কোন কোন জাহাজ বহির্নোঙরে কিছু পণ্য খালাস করে জাহাজের ড্রাফট কমিয়ে বন্দরের জেটিতে প্রবেশ করে। আবার বন্দরের জেটিতে বার্থিং নেয়া জাহাজের ওভার সাইড থেকেও বিপুল পরিমাণ পণ্য খালাস করা হয়। বহির্নোঙর এবং জেটিতে অবস্থানকারী জাহাজের ওভারসাইড থেকে কেবলমাত্র লাইটারেজ জাহাজেই পণ্য খালাস করা হয়। বিপুল পরিমাণ সিমেন্ট ক্লিংকার ছাড়াও গম, সরিষা, সারসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য লাইটারেজ জাহাজের মাধ্যমে পরিবহন করা হয়। চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে বছরে দশ কোটি টনেরও বেশি পণ্য হ্যান্ডলিং করা হয়।

চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙর থেকে বন্দর চ্যানেলের নানা ঘাট এবং ঢাকা, মিরপুর, নগরবাড়ী, বাঘাবাড়ী, নোয়াপাড়া, খুলনা, বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এই সব জাহাজ পণ্য পরিবহন করা হয়। চট্টগ্রামস্থ সিইউএফএল এবং কাফকোর উৎপাদিত সারের একটি অংশও বিসিআইসির নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন জেলার গুদামে লাইটারেজ জাহাজের মাধ্যমে পরিবহন করা হয়। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য পরিবহনে প্রায় ১৮শ’ লাইটারেজ জাহাজ রয়েছে। এসব জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙর থেকে কর্ণফুলী নদীর ১৬টি ঘাট এবং ঢাকা, মিরপুর, নগরবাড়ী, বাঘাবাড়ী, নোয়াপাড়া, খুলনা, বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে লাইটারেজ জাহাজ পণ্য পরিবহন করে। দেখা যায় সার কিংবা কয়লা পরিবহনকারী জাহাজই পরের ট্রিপে খোলা গম কিংবা র সুগার নিয়ে ছুটে। সিমেন্ট ক্লিংকার পরিবহনের পরপরই দেখা যায় অন্য কোনো ভোগ্যপণ্য বোঝাই করা হচ্ছে জাহাজটিতে।

প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী কোন লাইটারেজ জাহাজ জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এমন পণ্য পরিবহনের পর জাহাজটিকে ভালোমতে পরিস্কার করার কথা। এরপর খাদ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তার কাছ থেকে অনাপত্তি পত্র নেয়ার পরই কেবল ভোগ্য পণ্য পরিবহন করার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে এসব নিয়ম মানা হয় না।

খাদ্য অধিদপ্তরের গম পরিবহনকালে কোনো কোনো সময় কড়াকড়ি করা হয়। তবে বেসরকারি ভোগ্যপণ্য পরিবহনকালে এসব মানা হয় না। সম্প্রতি খাদ্য অধিদপ্তরের জন্য বরাদ্দকৃত একাধিক জাহাজ বাতিল করার পর বিষয়টি নিয়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। কয়লা কিংবা ক্লিংকার পরিবহনের পর এসব জাহাজ খোলা গম পরিবহন করতে গিয়েছিল। জাহাজগুলোকে ফেরত পাঠানো হয়েছে।

খাদ্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বলেছেন, ভোগ্যপণ্য পরিবহনের জন্য ডেডিকেটেড কোন লাইটারেজ নেই। এটা রাখাও সম্ভব নয়। তাই আগের ট্রিপে সার কয়লা কিংবা ক্লিংকার পরিবহন করেছে এমন লাইটারেজ জাহাজগুলোই মূলত পরের ট্রিপে গম, সরিষা, ভুট্টা, ছোলাসহ বিভিন্ন ডাল কিংবা র সুগার পরিবহন করতে যায়। নিয়মানুযায়ী এসব জাহাজকে ধুয়ে মুছে খুবই ভালোভাবে পরিস্কার করে পরের ট্রিপের জন্য তৈরি করার কথা। যাতে পরের ট্রিপের পণ্যে আগের ক্যামিকেল কিংবা অন্যান্য পণ্যের কোন ছোঁয়া না লাগে। কিন্তু জাহাজের হ্যাজগুলো ধুয়ে মুছে পরিস্কার করা বেশ কষ্টসাধ্য এবং ব্যয়বহুল। তাই জাহাজ মালিক এবং কর্মচারীরা তা না করে জাহাজকে পরের ট্রিপের পণ্য বোঝাইয়ের জন্য পাঠিয়ে দেয়।

খাদ্য অধিদপ্তরের নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সম্প্রতি আমাদের গম পরিবহনের জন্য এই ধরণের বেশ কয়েকটি জাহাজ পাঠানো হয়। যেগুলো আমরা বাতিল করে ফেরত পাঠিয়েছি। বিষয়টি নিয়ে খাদ্য অধিদপ্তর খুবই সজাগ থাকে বলে দাবি করে ওই কর্মকর্তা বলেন, আমাদের সার্ভেয়ারের রিপোর্ট পাওয়ার আগে আমরা কোন জাহাজে পণ্য বোঝাই করার ছাড়পত্র দিই না। তবে বেসরকারি ভোগ্যপণ্য কিভাবে পরিবহন করা হয় সেটা দেখভালের দায়িত্ব আমাদের নয়।

এই দায়িত্ব কার এমন প্রশ্ন করা হলে লাইটারেজ জাহাজ পরিচালনার সাথে জড়িত ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের একজন কর্মকর্তা বলেন, আমরা জাহাজের সিরিয়াল মেনে জাহাজ বরাদ্দ দিই। ওই জাহাজ আগের ট্রিপে কি পরিবহন করেছিল সেটা আমরা জানি, তবে পরের ট্রিপের জন্য জাহাজটিকে পরিস্কার বা তৈরি করা হয়েছে কিনা সেটা আমরা জানি না। তাছাড়া বড় বড় শিল্প গ্রুপের একাধিক ব্যবসা রয়েছে। তারা সিমেন্ট বানায়, চিনি উৎপাদন করে আবার ভোগ্যপণ্যও আমদানি করে। তাদের সব পণ্যই তাদের জাহাজগুলোতেই পরিবাহিত হয়। এসব জাহাজ আমাদের সিরিয়ালে আসে না, আমরা জানিও না যে তারা কখন কি পরিবহন করছে।

গম কিংবা র সুগারের সাথে কয়লা কিংবা পাথরের গুড়ো মিঙড হওয়া বা সারের ক্যামিকেল যুক্ত হওয়া জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। গতকাল মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. আরিফুল ইসলামের সাথে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করলে তিনি বলেন, এই ধরণের মিশ্রণ অত্যন্ত ভয়াবহ ব্যাপার। যদি পণ্যগুলোর উপাদান ভোগ্যপণ্যে জড়িয়ে থাকে তাহলে ক্যান্সারসহ নানা ধরণের রোগ হতে পারে। গমের সাথে কয়লা কিংবা পাথর বা অন্য কেমিক্যাল থাকলে সেটি ক্রাশ করার পর আটার সাথে থেকে যাবে। এই উপকরণ কোনভাবেই বাইরে যাবে না। যা মানুষের শরীরে প্রবেশ করে নানা রোগবালাই সৃষ্টি করবে।

লাইটারেজ জাহাজে ভোগ্যপণ্য পরিবহনের ব্যাপারটি দেখভালের জন্য বাংলাদেশ নৌ বাহিনী এবং কোস্টগার্ডকে দায়িত্ব দেয়ার আহ্বান জানিয়ে ক্যাবের চট্টগ্রামের সভাপতি মোহাম্মদ নাজের হোসাইন বিষয়টিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, নিরাপদ খাদ্য পাওয়ার প্রথম শর্তই হচ্ছে নিরাপদ পরিবহন। পরিবহনকালে যদি খাদ্যে ক্যামিকেলসহ ক্ষতিকর পণ্যের মিশ্রণ ঘটে তাহলে সেই খাদ্য মানুষের জন্য হুমকি হয়ে উঠে। বিষয়টিকে কঠোর নজরদারীর আওতায় আনার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধভাষা আন্দোলনের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে সবখানে
পরবর্তী নিবন্ধশুকিয়ে গেছে সর্তা খাল