বাংলাদেশের উত্থান কিংবা জন্ম কম–বেশি আমরা জানি! দেশের চলমান এই পরিস্থিতিতে আমাদের ভাবনা খুব দ্রুত পরিবর্তিত হয়েছে! আমি আমার ভাবনাটুকুই বলতে চাই! আমার কাছে মনে হয় জাতিগতভাবে আমরা কিছুটা দুর্বল চিত্তের সেই সাথে ভীষণ রকম দুর্নীতিগ্রস্ত! দুর্বল চিত্তের বলেই আমাদেরকে ভয় দেখানো খুব সহজ! আমরা সংঘবদ্ধ হতে পারি না সহজে, হলেও সেখানে দ্বিধার অনুপ্রবেশ ঘটানো সহজ! আমরা কোনো অন্যায়–অবিচারের বিরুদ্ধে পারতপক্ষে কথা বলি না। কারণ আমাদেরকে পেছন থেকে কেউ না কেউ টেনে ধরে! জানি আমাদের দেশে আইনের শাসন নেই, বিচার ব্যবস্থা স্বাধীন না–এরকম অনেক বিষয় আছে। বৃহত্তর ক্ষেত্রে আমি যাচ্ছি না। একদম ছোট ছোট জায়গায়–প্রত্যেকের নিজের ক্ষেত্রটুকু যদি ভাবি তাহলে পরিষ্কার হবে সেটা। আমি যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করি সেখানে মেয়েদের ওয়াশরুম, পানি না থাকা এরকম কিছু ছোট কিন্তু প্রয়োজনীয় বিষয় ছিলো! এই প্রতিষ্ঠানে নারী কর্মীর সংখ্যা কম না! কিন্তু কেউ এসব বিষয়ে কথা বলে না– যেন এটাই স্বাভাবিক! আমি একদিন সবার সাথে কথা বললাম– সবাইকে বুঝলাম। সবাই সম্মত হলেন আমার সাথে। একদিন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পরিদর্শনে আসবার কথা। সিদ্ধান্ত হলো আমরা আমাদের এই প্রয়োজনগুলো কর্তৃপক্ষকে তুলে ধরব। আসলেন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ–আমরা বসলাম! অত্যন্ত বিস্মিত হয়ে দেখলাম আমার সিনিয়ররা সম্পূর্ণ উল্টোকথা বলতে লাগলেন–আমাদের সমস্যার কথা এক ফোঁটাও বললেন না বরং আমরা কতো সন্তুষ্ট তা বলতে লাগলেন! আমার প্রথম শিক্ষা! যতক্ষণ না মানুষ তার যৌক্তিক চাওয়া নিয়ে সোচ্চার হবে ততক্ষণ ক্ষমতাশীলরা স্বৈরাচার হবে! পরোক্ষভাবে অধিকতর আনুগত্য প্রদর্শন করতে গিয়ে আমরাই তাদের স্বৈরাচার হতে সাহায্য করি!
দেশ আমার কাছে অনেক বড় একটা প্রতিষ্ঠান! পরিবর্তনের কথা বলি আমরা! প্রত্যেকটা মানুষ তার নিজের জায়গায় যদি না বদলায় তাহলে সামগ্রিক পরিবর্তন আসবে কীভাবে? আমরা পরিবেশের কথা বলি অথচ প্লাস্টিক এর ব্যবহার কমাই না! যেখানে–সেখানে ময়লা ফেলি! যেখানে–সেখানে থুতু ফেলবেন না! এই সামান্য নির্দেশনা মানবার জন্য কী সরকারের কঠোরতা লাগবে?
বর্তমানে দেশে কী ভয়াবহ সহিংসতা চলছে। যখন যে ক্ষমতায় সে মারছে! আমাকে মেরেছে একদিন, সুযোগ পেয়েছি তাই আজ আমি মারবো! এভাবে মারতে–মারতে একদিন আমরা নিঃশেষ হবো তবু ক্ষমাশীল হবো না। আমি দেখেছি–শিক্ষিত বলতে আমরা যাদের বুঝি তারা বলে সহিংসতা চাই না আবার পরক্ষণেই তারা বলে একে মেরে ফেলা উচিত! ওকে মারছে ঠিক আছে! এই ভাবনার পরিবর্তন আসতে হবে! একটা খুনকে জাস্টিফাই করার জন্য আরেকটা খুন করা যায় না! এমন চলতে থাকলে জাতি হিসেবে আমরা যেই তিমিরে ছিলাম সেই তিমিরেই থাকবো!
হ্যাঁ, প্রশ্ন আসতে পারে দেশ পরিচালনার জন্য এই পরিবর্তন যথেষ্ট কিনা! হয়তো যথেষ্ট না! কিন্তু আমরা তো সেই শৈবাল হতে পারি যে দিঘীকে এক ফোঁটা অন্তত শিশির দেয়! অনেক শিশির ফোঁটা মিলে কি দীঘির এক ভাগ অন্তত পূরণ হয় না? এত জাজমেন্টাল আমরা– কেন এই বিষয়ে বলল না, কেন একজন এই কাজ করল না, কেন তখন আসল না এরকম হাজারটা জাজমেন্টাল মন্তব্য করেই যাই নির্লজ্জের মতো! নিজের কাছে কী কখনও প্রশ্ন করি আমি কী করেছি? যে করতে পারেনি তার জায়গায় নিজেকে বসিয়ে বুঝবার চেষ্টা করেছি কী যে ওই ব্যাক্তি কেন কাজটা করতে পারে নাই?
একজন নারী হিসেবে আমার পর্যবেক্ষণ একটু ভিন্ন! যে কোনো পরিস্থিতিতে নারীর অংশগ্রহণ, নারীর প্রতি সাধারণের মনোভাব এসব আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ্য করি! জুলাইয়ের ছাত্র আন্দোলনে আমার কাছে উল্লেখযোগ্য মনে হয়েছে নারীদের তেজোদীপ্ত উপস্থিতি! কী দৃপ্ত কণ্ঠ! একেকজন অগ্নিস্ফুলিঙ্গ! অথচ এই তরুণ তেজি নারীরাও বলছেন নারী নেতৃত্ব চাই না! হ্যাঁ, এদেশে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ ঘটে এসেছে অহরহ! তাই তারা নারী নেতৃত্ব চায় না এটা আমাকে বিস্মিত করে না! কিন্তু এই বহ্নিশিখারাও নারী নেতৃত্ব চায় না? কেন? এই মেয়েগুলোই তো সাঁজোয়া যান এর সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়ায়, এরাই তো হাজারটা অস্ত্রের সামনে থেকে ভাইকে কেড়ে আনে! তাদের উপর ভরসা করে অন্যরা! তবু কেন তাদের এত দ্বিধা? আমরা যারা নারীর ক্ষমতায়ন, নারীর প্রতি সহিংসতা নিয়ে ভাবি তারা বুঝি এটা কোন ভালো উদাহরণ না। আমরা দেখেছি এই আন্দোলনে নারী–পুরুষ সমার্থক হয়ে কাজ করেছে। আবার এটাও দেখেছি সাবেক রাষ্ট্রপ্রধানের অন্তর্বাস নিয়ে পৈশাচিক উল্লাস, নোংরা মন্তব্য! যে পরিবর্তনের আশা নিয়ে সাধারণ মানুষ পথে নেমেছে আচমকাই দেখতে পাই নারীর প্রতি সহিংস, বিধ্বংসী আচরণের কোনো পরিবর্তন নাই! মুহূর্তে আমার কাছে সব অবদান ম্লান হয়ে যায়!
মানবিকতা, সংবেদনশীলতা এই দিকগুলো না থাকলে মানুষ হলাম কেন? ছোটবেলায় পড়েছিলাম–দণ্ডিতের সাথে দণ্ডদাতা কাঁদে যবে সমান আঘাতে, সর্বশ্রেষ্ঠ সে বিচার! কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু আমি কামনা করি না। আমার খারাপ লাগে–সকলের জন্য আমার খারাপ লাগে! এটা হয়তো দুর্বলতা–কি করা যাবে?
আমি ভাবি পৃথিবীতে সাম্য আসবে, শান্তি আসবে, সহমর্মিতা আসবে। স্বাধীনতা আর সভ্যতা আসবে! মানুষ মানুষকে জাজ করবে না। নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবে, সম্মান করবে মানুষ হিসেবে। কেউ কারও প্রতি প্রতিহিংসা চরিতার্থ করবে না। ন্যায়ের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। স্বাভাবিক মৃত্যু নিশ্চিত হবে। এগুলো হয়তো খুব তাত্ত্বিক ধারণা, তাত্ত্বিক চাওয়া। আমি এটাই চাই! আমি নিহিলজমবাদী! পৃথিবীর কোথাও ভালো কিছু ঘটছে না। কোথাও কোনো আশা নেই। স্বপ্ন নেই। তাই আমার চাওয়াগুলো হয়তো একটা সুন্দর পৃথিবীর ধারণা কেবল! তবু আমি এভাবেই ভাবতে চাই! এবং চাই আরও অনেকে ভাবুক। একদিন সংখ্যাটা বাড়বে নিশ্চয়ই।