২০১৫ সালের মাঝামাঝি। দক্ষিণ গোলার্ধের সাজানো শহর মেলবোর্নের সুইনবার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি অভিযান শেষ হয়ে এলো বলে। প্রায় লক্ষ শব্দের অভিসন্দর্ভ রচিত হলো। একজন ভালো সম্পাদক চাই, যিনি ঠাণ্ডা মাথায় শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পাঠ করে ভুলভ্রান্তি থাকলে ধরিয়ে দেবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থায়নে গবেষকদের জন্য সম্পাদক নিয়োগ করার সুযোগ আছে। সহকারী তত্ত্বাবধায়ক জুলি কিম্বার ‘কেন হ্যালি’ নামে তাঁর পরিচিত এক সাংবাদিকের নাম প্রস্তাব করেন। আমার যেহেতু জানাশোনা কেউ নেই, ‘কেন হ্যালি’র উপর ভরসা করতেই হয়। ইমেইলে পরিচয়, ইমেইলেই কথপোকথন। যথারীতি কাজ শুরু করেন ‘কেন’। রাত জেগে আমার একেকটা অধ্যায় দেখে দেন তিনি। এক সকালে তাঁর ইমেইল আসেনা। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে যায়। এমনতো হওয়ার কথা নয়। এখানে সময় নিয়ে অভিযোগ করার সুযোগই নেই। তবে কি কোনো সমস্যা হলো? সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই সন্ধ্যা নাগাদ তাঁর বার্তা আসে ইমেইলে। আজকের অধ্যায়ের কাজ সময় মতো শেষ করতে পারেননি বলে প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নেন। তারপর কারণ দর্শান।
আগের সন্ধ্যায় অস্ট্রেলিয়ায় ক্ষমতার পালাবদল হয়ে গেল অনেকটা নিঃশব্দে। সংসদে সরকার প্রধানের প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন, এবং তারই জের ধরে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সরকার পরিবর্তন। অনাস্থা কেবল বিরোধী দলের পক্ষ থেকে নয়, নিজ দল এমনকি মন্ত্রীসভার সদস্যদের পক্ষ থেকেও আসে। গণতন্ত্রের সৌন্দর্য বোধ হয় একেই বলে। এ কেমন অদ্ভুত দেশ! চায়ের কাপে ঝড় নেই, রাজপথে ভিড় নেই, এমনকি টেলিভিশনে কোন ‘ব্রেকিং নিউজ’ও নেই। সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী আর তাঁর অনুসারীদের দেশত্যাগ বা কারাবরণও করতে হয় না। সাংবাদিক হিসেবে কেন হ্যালি’র উপর দায়িত্ব বর্তায় ঘটনা বিশ্লেষণের। প্রসঙ্গক্রমে তিনি এককালে ‘দি এইজ’ পত্রিকায় সংসদ প্রতিনিধি হিসেবে যুক্ত থাকার কথা উল্লেখ করেন। এবার আমার অবাক হওয়ার পালা। এই ভদ্রলোক দি এইজে কাজ করতেন! স্বগতোক্তির মতোই তিনি আমাদের দেশে সরকার পরিবর্তনের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন। তাঁর ভাষায়, “তোমাদের দেশেতো রক্তপাত ছাড়া পালাবদল হয়না”। আমি কিঞ্চিৎ বিরক্ত। আমার দেশ নিয়ে কথা বলার আপনি কে? আমাকে চূড়ান্ত অবাক করে দিয়ে তিনি ১৯৮৩ সালের মাঝামাঝিতে তাঁর বাংলাদেশ সফরের কথাটি উল্লেখ করেন।
কে এই কেন হ্যালি? তাঁর বয়সই বা কত? কেন তিনি বাংলাদেশে গিয়েছিলেন? ভাবনার অতলে তলিয়ে যাই আমি। এই প্রথম মনে হল তাঁর সঙ্গে দেখা করা দরকার। তিনিও দেখা করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। আনুষ্ঠানিকভাবে অভিসন্দর্ভ জমা দেওয়ার পর দিনক্ষণ ঠিক করে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাই। নির্দিষ্ট সময়ের কিছুক্ষণ আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা কফির দোকানে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। যথাসময়ে তিনি এলেন। তবে পায়ে হেঁটে নয়, হুইল চেয়ার ঘুরিয়ে। ‘হেই সালমা’ বলে ডেকে না উঠলে তাঁকে আমি চিনতেই পারতাম না। বলাবাহুল্য, খাঁটি বাংলাদেশী পোশাকের কারণে আমাকে চিনে নিতে তাঁর অসুবিধা হয়নি। গবেষণা তত্ত্বাবধায়কদের কথা ভাবছিলাম; তাঁরা কিন্তু একবারও বলেননি– কেন হ্যালি একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী। আমরা হলে নাম পরিচয়ের আগেই তা বলে দিতাম। এটা আমাদের বৈশিষ্ট্যই বলা যায়– মানুষের নাম পরিচয় কর্মের চেয়ে শারীরিক কোন ‘ত্রুটি’ই তাঁকে নির্দেশ করার প্রধান অনুষঙ্গ হয়ে যায় আমাদের কাছে।
ফিরে যাই কেন হ্যালি’র কাছে। আমার বিস্ময়ের ঘোর কাটার আগে তিনি নিজেই নিজের বসার জায়গা ঠিক করে নেন; টেবিলের পাশের একটা চেয়ার একপাশে সরিয়ে নিজের চাকা দেওয়া চেয়ারটা প্রতিস্থাপন করেন। ত্বরিত গতিতে দোকানিকে কফি দিতে বলে আবার নিজের জায়গায় ফিরে আসেন। শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর শুরুতেই তিনি বাংলাদেশে প্রবেশের প্রমাণ হিসেবে তাঁর নোট খাতার ভেতর থেকে লালচে হয়ে যাওয়া একটি কাগজ বের করেন, যা ছিল ১৯৮৩ সালের জুনে ঢাকায় নেমে অগ্রণী ব্যাংক বিমানবন্দর শাখা থেকে যে ডলার ভাঙিয়েছিলেন তার রশিদ।
১৯৮৩ তে আমি তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ি। তাও আবার মেঘনা পাড়ের অৎপাড়া–গাঁয়ের এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। বাংলাদেশের তদানিন্তন রাজনৈতিক অবস্থা ও পট পরিবর্তনের কোনো কথাই আমার মনে পড়ে না। কেন হ্যালি বলেন, তখন তোমার দেশে সামরিক একনায়কতন্ত্র চলছিল। একথা সেকথার পর তিনি তাঁর চট্টগ্রাম সফরের কথা পাড়েন। মধ্য জুনের ভয়াবহ গরমের পর এক দুপুরে রাঙামাটির এক পাহাড়ি গ্রামে বসে তাঁর দেখা সেরা বৃষ্টির কথা আজও ভোলেননি তিনি। সাতদিনের বাংলাদেশ সফরে তাঁর সবচেয়ে ভালো লেগেছিল সাধারণ মানুষের সারল্য আর আন্তরিকতা। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম তাঁর কথা। আরও বিস্মিত হয়েছিলাম যখন জানলাম বাংলাদেশকে তিনি জানেন সেই ১৯৭১ সাল হতে। কেন হ্যালি বলে যান– “তোমার দেশের জন্মের ইতিহাসের কথা কিছুটা জানা আছে আমার। ১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর অন্যায়, নিষ্ঠুরতা ও গণহত্যার প্রতিবাদে ফ্লিন্ডার্স স্ট্রিটে একটি জনসভা হয়েছিল। সেই সভায় আমার স্কুলের অনেক সহপাঠীর সঙ্গে আমিও যোগ দিয়েছিলাম।”
আমার মনে হল সারা শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছে। হৃদযন্ত্র কি থেমে যাচ্ছে? না কি দ্রুতলয়ে ঘুরছে? একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী বর্ষীয়ান সাংবাদিকের ঝুলিতে আমার জন্য এতো গল্প জমা ছিল? বোকার মতো তাঁকে প্রশ্ন করি– সেই দিনের কোনো ছবি কি আছে? তিনি বলেন– “তখনতো আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছিল না। কিশোর যুবার হাতে হাতে চকচকে মুঠোফোনও ছিল না। হয়তো তখনকার কোনো সাংবাদিক তুলেছিলেন ছবি। আমার মতো সতের বছরের কিশোরের পক্ষে তা জানা সম্ভব ছিল না। তবে একটা কিছু আমরা করছি (উই আর ডুইং সামথিং) এরকম একটা উন্মাদনা অনুভব করছিলাম”। সেদিনের স্মৃতিচারণ করেন কেন– “আমরা রাস্তায় বসে শ্লোগান দিয়েছিলাম। কিছুক্ষণের জন্য সেই ব্যস্ত রাজপথে গাড়ি চলাচল থেমে গিয়েছিল। অন্তত কয়েকশ মানুষ জমা হয়েছিল সেদিনের জনসভায়।” তখনই ‘ ‘কেন’–কে বলেছিলাম– বাংলাদেশকে আমি সেই সতের বছরের কিশোরের গল্প শোনাতে চাই।
মেট্রোতে করে ঘরে ফিরতে ফিরতে ভাবছিলাম– কেন হ্যালি ও তাঁর বন্ধুরা কেন আমাদের মুক্তি সংগ্রামে একাত্মতা প্রকাশ করেছিল? বাংলাদেশের থেকে প্রায় নয় হাজার কিলোমিটার দূরে ভুগোলকের অন্য প্রান্তে বিচ্ছিন্নভাবে ঝুলে থাকা এক মহাদেশের কিশোরদের কানে আমাদের বঞ্চনা ও কান্নার কথা পৌঁছালইবা কেমন করে? অপেক্ষার প্রহর বাড়াতে চাইনি। ইমেইলেই প্রশ্নটা তুলি। স্মৃতি হাতড়ে তিনি লেখেন– তাঁদের ইংরেজির শিক্ষক রিচার্ড গেডস ছিলেন একজন মানবতাবাদী ও রাজনীতি সচেতন মানুষ। সাহিত্য পড়ানোর পাশাপাশি তিনি বিশ্ব পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলতেন আর শিক্ষার্থীদের উৎসাহ দিতেন রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়াশীল আচরণের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলতে। তাঁরই অনুপ্রেরণায় সমকালীন পৃথিবীর ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে খোলামেলা আলোচনা ও বিতর্ক হত কেনদের ক্লাসে। ভিয়েতনাম যুদ্ধ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে কথা বলত তারা। তাছাড়া মেলবোর্ন, সিডনি, ক্যানবেরা থেকে প্রকাশিত খবরের কাগজে পূর্ব পাকিস্তানীদের সংগ্রামের কথা নিয়মিত প্রকাশিত হত। খবরের পাশাপাশি মতামত পাতায় সম্পাদকীয় ও উপ–সম্পাদকীয় তে প্রবন্ধ ছাপানো হতো, যা উচ্চ মাধ্যমিকের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী হিসেবে কেনদের ভাবনাকে আরও শানিত করতো। একুশ শতকের স্মার্ট যুগের উচ্চ মাধ্যমিকের কিংবা উপরের দিকের শিক্ষার্থীদেরকে ঘরের সমস্যাই স্পর্শ করে না, ভিনদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে ভাববার অবকাশ কোথায় তাদের !
কেন হেলির কাছ থেকে ইমেইলে পাওয়া তথ্যে মন ভরে না। ইতিহাসের শিক্ষার্থী হিসেবে আরও খোঁড়াখুঁড়ি করার আশায় আবারও তাঁর মুখোমুখি হই। কেন বলছিলেন, ১৯৭১ এর মার্চে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনায় অবাক হননি তাঁরা। তাঁদের মনে হয়েছিল– এমনইতো হওয়ার কথা ছিল। খবরের কাগজে নয় মাসের ঘটনাপ্রবাহ পর্যবেক্ষণ করে আন্দোলনের ফলাফলের ব্যাপারেও তাঁরা আশাবাদী ছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় ৪ ডিসেম্বরের প্রতিবাদ সভায় যোগ দেওয়াটা হুজুগ মাত্র ছিল না। টেলিভিশনের কল্যাণে ম্যাডিসন স্কয়ারে জর্জ হ্যারিসনদের সেই উন্মাতাল সংগীত সন্ধ্যার উত্তাপ স্পর্শ করেছিল কেনদেরকেও। আমাদের গৌরবময় মুক্তি সংগ্রামকে নিয়ে কেন হ্যালি উপসংহার টানেন এই বলে, “বিশ শতকের শেষার্ধের সবচেয়ে বীরোচিত আন্দোলনগুলোর একটা বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন। সাহস, বুদ্ধিমত্তা আর ধৈর্যের অপূর্ব মেলবন্ধন ছিল এই সংগ্রামে, সেই সঙ্গে আত্মাহুতির পালাতো ছিলই। বিজয় তাই অনিবার্য ছিল।”
কেনের গল্প বলা শেষ হয়। গল্পের শেষে ছবি তোলার অনুমতি চাইলে হাসিমুখে রাজি হয়ে যান তিনি– “আমি তাহলে বিখ্যাত হতে চলেছি”। আমি হাসি– “আপনিতো বিখ্যাতই, আমারই আপনাকে চিনতে দেরি হয়ে গেল।” কেনের সঙ্গে দ্বিতীয় সাক্ষাতের আগে কি মনে করে যেন তাঁর নাম লিখে গুগোল করছিলাম (যদিও কাজটা আরও আগেই করা উচিত ছিল)। তখনই বেরিয়ে আসে তাঁর রোমাঞ্চকর জীবনের নানা অধ্যায়। অস্ট্রেলিয়ার সাংবাদিকতার ইতিহাসে কেন হ্যালি একটি স্বতন্ত্র নাম, যিনি গতানুগতিক ধারায় সাফল্যের পেছনে না ছুটে ঘুরে বেড়িয়েছেন বিশ্বজুড়ে। নিউইয়র্কের টাইমস, লন্ডনের অবজারভার, সানডে টাইমস, চীনের দ্য সাউথ চায়না মর্নিং, হংকং এর দ্য পোস্ট, বাহরাইনের দ্য গালফ ডেইলি নিউজ, ওমানের দ্য ডেইলি অবজারভারে বৈদেশিক প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন তিনি। এ পর্যন্ত ১৪৩ টি দেশে তিনি ভ্রমণ করেছেন কেন। আত্মহননের চেষ্টা করে বিফল হয়ে নতুন উদ্যমে শুরু হয় তাঁর পথ চলা। ১৯৯১ সাল থেকে তিনি হুইল চেয়ারে আসিন। তাঁর সেই হুইল চেয়ারের ছাপ পড়েছে দুই তৃতীয়াংশের বেশী দেশে। বর্ণাঢ্য জীবনে কারাভোগসহ নানা প্রতিকুলতার মুখোমুখী হয়েছিলেন তিনি। করোনা মহামারীকালেও তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার নানান জনপদে। আবারও ভ্রমণ করতে চান বাংলাদেশে।