নগরীর জামালখানের একটি নালা থেকে ৭ বছর বয়সী এক শিশুর লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। নিখোঁজের তিনদিন পর গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৫টায় পুলিশ ওই শিশুর বস্তাবন্দি গলিত লাশ উদ্ধার করে। দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গলির মুখের আজাদ স্টোর থেকে বিস্কুট চিপস কিনে বাসার দিকেই গিয়েছিল ৭ বছরের শিশু মারজানা হক বর্ষা। কিন্তু বাসায় ফিরেনি। দিনভর খুঁজেও তাকে কোথাও পাওয়া যায়নি। তিন দিন পর সেই গলির পাশের নালাতেই মিলে তার গলিত লাশ। অবুঝ শিশুর এমন করুণ মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না স্বজনরা। মা ঝর্ণা বেগম বারবার জ্ঞান হারাচ্ছিলেন। ঠিক করে কোনো কথায় তিনি বলতে পারছিলেন না। শুধু বলছিলেন, আমার মেয়েকে বস্তায় ভরল কে! কারা তাকে হত্যা করেছে? কার ক্ষতি করেছে আমার মেয়ে?
এ ঘটনার মধ্য দিয়ে সারা দেশে অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধির মধ্যে একটি মেসেজ পাওয়া যায়। মেসেজটি হল, সমাজ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ভেঙে পড়েছে সমাজের স্বাভাবিকতা ও মূল্যবোধ। অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে সামাজিক অস্থিরতা। সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, এ অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণ করে সমাজে স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনতে না পারলে সাময়িকভাবে সুপ্ত জঙ্গি তৎপরতা আবারও সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে। কাজেই উল্লিখিত খুনকে কেবল পারিবারিক ভাবলে হবে না, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-ফ্যাসাদ হিসেবেও বিবেচনা করা যাবে না। কেন সমাজে অস্বাভাবিক হারে এমন অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে, কেন মানুষ অন্যায় পথে অবৈধ খুন-খারাবিতে জড়িত হচ্ছে, সে বিষয়ে অপরাধবিজ্ঞানী ও সমাজবিজ্ঞানীদের অনেক কিছু ভাবতে হবে।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, সারাদেশে প্রতিদিন গড়ে ১৪/১৫ জন খুন হচ্ছেন। তবে এসব খুনের বেশিরভাগ ঘটছে পারিবারিক ও সামাজিক পর্যায়ে। বাবা অথবা মা নিজের শিশু সন্তানকে গলাটিপে হত্যা করছেন। বাবা অথবা মাও খুন হচ্ছেন সন্তানের হাতে। রাস্তা বা ডোবা থেকে উদ্ধার হচ্ছে তরুণীর খণ্ডিত লাশ। এতে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়ছে সচেতন নাগরিক এমনকি জনসাধারণের মাঝে। এভাবে দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রতিনিয়ত ঘটছে হত্যাকাণ্ড।
কেন এই নির্মমতা? কেন এই পাশবিকতা? কেন এই অস্থিরতা? এর উত্তরে অপরাধ বিশেষজ্ঞ, নারী ও শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করেন এমন বিশিষ্টজনরা বলছেন, সামাজিক অস্থিরতা, মূল্যবোধের অবক্ষয়, বিচারহীনতা ও প্রযুক্তির প্রসারের কারণে ঘটছে এ ধরনের ঘটনা। এ ধরনের ঘটনা রোধে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের যেমন আরও কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে, তেমনি পারিবারিক সচেতনতাও বৃদ্ধি করতে হবে। একই সঙ্গে সামাজিক অনুশাসনের প্রতি জোর দেয়ারও তাগিদ দিয়েছেন তারা। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, এসব খুনের বেশির ভাগই ঘটেছে সামাজিক ও পারিবারিক কারণে। সাধারণত পারিবারিক কলহ, অর্থ লেনদেন, ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব বা এলাকার আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষের হাতে এঁরা খুন হয়েছেন। আশঙ্কাজনক ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে পারিবারিক হত্যাকাণ্ড।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বলেন, অপরাধী ও দুর্নীতিবাজদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়েও অপরাধ কমানো যায়। অপরাধীদের শাস্তি দিলে তারা অপরাধ করা থেকে বিরত থাকবে। কিন্তু বাংলাদেশে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে পুলিশি তৎপরতায় দ্রুত বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করা গেলেও সার্বিকভাবে সব অপরাধীর বিচারের ব্যাপারে একই রকম গতি লক্ষ্য করা যায় না। ফলে দেশে একটি বিচারহীনতার সংস্কৃতি গড়ে ওঠার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। আইনের পরিভাষায় বলা হয়, ‘জাস্টিস ডিলেইড জাস্টিস ডিনাইড।’ কিছু অপরাধের বিচারে এত বেশি সময় লাগছে যে সাধারণ মানুষ সন্দিহান হয়ে পড়ছেন আদৌ ওই অপরাধের বিচার হবে কিনা। যেমন- সাংবাদিক সাগর-রুনী হত্যাকাণ্ড, নারায়ণগঞ্জের তানভীর মোহাম্মদ ত্বকী হত্যাকাণ্ড, কুমিল্লার তনু হত্যাকাণ্ড এবং চট্টগ্রামের মিতু হত্যাকাণ্ডের তদন্তের গতিপ্রকৃতি সমাজে বিচারহীনতার সংস্কৃতি গড়ে ওঠার সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দ্রুত বিচার এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিচার প্রক্রিয়া বিলম্বিত হওয়ায় অপরাধীরা প্রশ্রয় পায়।
স্বীকার করতে হবে, সমাজে স্থিতিশীলতা না থাকায় সামাজিক অস্থিরতা বেড়েছে। বিঘ্নিত হচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তা ও সুখ-শান্তি। সমাজের মূল্যবোধ যেমন ভেঙে পড়েছে, তেমনি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও হয়ে পড়েছে নাজুক। এক্ষেত্রে নাগরিকদের নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করার জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা।