চট্টগ্রাম আদালতে আইন পেশায় নিয়োজিতদের একটি অংশ দীর্ঘদিন ধরে চেম্বার বরাদ্দ চেয়ে পাচ্ছেন না। আরেকটি অংশ চেম্বার বরাদ্দ পেয়েও থাকছেন না। এতে অব্যবহৃত চেম্বারগুলো ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিষয়টি নিয়ে আইনজীবীদের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে। এমনকি দুই পক্ষ বিরোধে জড়ানোর ঘটনাও ঘটছে। চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির তথ্য মতে, চট্টগ্রাম আদালতে সমিতির ৬ হাজার সদস্য আইনজীবী আইন পেশায় নিয়োজিত। এর মধ্যে বিভিন্ন ভবন মিলে আইনজীবীদের চেম্বার সংখ্যা এক হাজারেরও কম। সমিতির পক্ষ থেকে আইনজীবীদের চেম্বার দরপত্র ও উন্মুক্ত লটারির মাধ্যমে বরাদ্দ দেয়া হয়। তবে চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল থাকায় আইনজীবীদের একটি বড় অংশ চেম্বার বরাদ্দ পাওয়া থেকে বঞ্চিত থাকেন। অভিযোগ উঠেছে, যেসব আইনজীবী চেম্বার বরাদ্দ পেয়েছেন তাদের একটি অংশ দীর্ঘদিন ধরে সেগুলো অব্যবহৃত অবস্থায় ফেলে রেখেছেন।
সরেজমিনে জানা গেছে, চট্টগ্রামে আইনজীবীদের জন্য নির্মিত শাপলা ও দোয়েল ভবনের নিচ থেকে ওপর তলা পর্যন্ত প্রতি তলায় অন্তত ৩/৪টি চেম্বার সবসময় তালাবদ্ধ থাকে। চেম্বারগুলোর প্রবেশমুখে রয়েছে প্লাস্টিক বর্জ্য, কাগজপত্রসহ বিভিন্ন আবর্জনার স্তূপ। ভবনটির আইনজীবীদের কয়েকজন আজাদীকে বলেন, বছরের পর বছর ধরে চেম্বারগুলো তালাবদ্ধ অবস্থায় পড়ে রয়েছে। এসব চেম্বারের মালিকরা মূলত অপেশাদার আইজীবীরা। যারা মূলত আইনজীবী সনদ নিয়ে পরবর্তীতে ব্যাংকসহ সরকারি/বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে রয়েছেন। ফলে তাদের চেম্বারগুলো তালাবদ্ধ অবস্থায় পড়ে থাকছে। দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত পড়ে থাকায় এখানকার অনেক লোকজন সেগুলোতে ডাস্টবিন হিসেবে ব্যবহার করছেন। এছাড়া অনেকে আবার চেম্বার বরাদ্দ নিয়ে সেগুলো ভাড়ায় দিয়ে রেখেছেন। সমিতির নেতৃবৃন্দ বিষয়টি অবগত থাকলেও অদৃশ্য কারণে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় কোনো ব্যবস্থা না নেয়ার অভিযোগ করেছেন সাধারণ আইনজীবীরা।
শাপলা ও দোয়েল ভবনের মতো আইনজীবীদের অন্যান্য ভবনগুলোতেও চেম্বার বরাদ্দ পাওয়ার পর দীর্ঘদিন ধরে তা অব্যবহৃত অবস্থায় ফেলে রাখার অভিযোগ পাওয়া গেছে। জানা গেছে, বিভিন্ন সময় চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির তৎকালীন কমিটি আইনজীবীদের জন্য চেম্বারগুলো বরাদ্দ দিয়েছিলেন। এই ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক এএইচএম জিয়াউদ্দীন গতকাল আজাদীকে বলেন, বিষয়টি আমরা খোঁজ খবর নিয়ে ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছি। শীঘ্রই এই ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি বলেন, অনেক চেম্বার রয়েছে যেগুলো বরাদ্দ নেয়ার পর আইনজীবীরা তাদের প্যানেল আইনজীবীদের দিয়েছেন অথবা ভাড়ায় দিয়ে রেখেছেন। তবে যেসব চেম্বার বরাদ্দ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রাখা হয়েছে সেসব চেম্বার মালিকদের খুব শীঘ্রই নোটিশ পাঠানো হবে। একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নোটিশের জবাব না পেলে সেক্ষেত্রে তাদের বরাদ্দ বাতিল করা হবে বলে জানান আইনজীবী সমিতির এই নেতা। জানতে চাইলে সনাক-টিআইবি চট্টগ্রাম মহানগরের সভাপতি অ্যাডভোকেট আখতারুল কবির চৌধুরী আজাদীকে বলেন, আইনজীবী হিসেবে বার কাউন্সিরের সনদ পাওয়ার আগে সবাইকে একটি হলফনামা দাখিল করতে হয়। সেখানে সুস্পষ্ট উল্লেখ থাকে যে, উক্ত আইনজীবী আইন পেশা ছাড়া অন্যত্র কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করতে পারবেন না। এই ধরনের কোনো প্রমাণ পেলে আইনজীবী সনদ বাতিলের ক্ষমতা রাখে বার কাউন্সিল। তবে এক্ষেত্রে সেই আইনজীবীর সুস্পষ্ট তথ্য উপাত্ত বার কাউন্সিলে লিখিত আকারে আইনজীবী সমিতিকে দাখিল করতে হবে। এতে এসবের সম্পূর্ণ দায়িত্ব বর্তায় চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির ওপর। তবে বিভিন্ন সময় উদ্যোগ নেয়ার পরও এই সমস্যাটি এখনো নিরসন করা যায়নি। এক্ষেত্রে আইনজীবী সমিতিকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে বলে জানান অ্যাডভোকেট আখতারুল কবির চৌধুরী। তিনি বলেন, আইনজীবী সমিতিকে এসব নন-প্রাকটিস আইনজীবীদের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে তা অবিলম্বে বার কাউন্সিলে লিখিত রিপোর্ট দাখিল করার মাধ্যমে সংশ্লিষ্টদের সনদ বাতিলসহ চেম্বার বরাদ্দ বাতিল করাটা জরুরি হয়ে পড়েছে। তাদের চেম্বার বরাদ্দ বাতিল করে যাদের চেম্বার নেই তাদের বরাদ্দ দেয়া উচিত। একই সাথে যারা আইনজীবী হিসেবে সনদপ্রাপ্ত ও চেম্বার বরাদ্দ নিয়ে পরবর্তীতে অন্য পেশায় চলে গেছেন বা যারা আদালতে নন-প্রাকটিস হিসেবে আছেন তাদেরও চেম্বারগুলো নিজ থেকে ছেড়ে দেয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি। এছাড়া চেম্বার বরাদ্দ দেয়ার ব্যাপারে আরও সচ্ছতা আনা প্রয়োজন বলে জানান অ্যাডভোকেট আখতারুল কবির চৌধুরী।
অ্যাডভোকেট মিঠুন বিশ্বাস নামে একজন আইনজীবী আজাদীকে জানান, যারা আদালতে নিয়মিত আইন পেশার সাথে জড়িত তাদের বেশিরভাগই কোনো চেম্বার নেই। দীর্ঘদিন ধরে চেম্বার বরাদ্দ চেয়েও এখনো কোনো চেম্বার পাইনি। অথচ যারা অপেশাদার আইনজীবী তাদের অনুকূলে চেম্বার বরাদ্দ দিয়ে বছরের পর বছর ধরে চেম্বারগুলো ফেলে রাখা হয়েছে। এসব যেন দেখার কেউ নেই। আইনজীবীরা বলছেন, আদালতে নিয়মিত প্র্যাকটিস করে একজন আইনজীবী আর্থিকসহ অন্যান্য যেসব সুবিধা পাচ্ছেন, আইনের পেশায় অনিয়মিত হয়েও সেসব আইনজীবীরা একই সুবিধা পাচ্ছেন। এসব বন্ধে আইনজীবী সমিতিকে অতিসত্ত্বর ব্যবস্থা নেয়া জরুরি বলে মনে করেন সাধারণ আইনজীবীরা।
প্রসঙ্গত, প্রতি মাসে উকালতনামা, হাজিরা ফরম ও বেইল বন্ড বাবদ আইন পেশায় নিয়মিত আইনজীবীদের কাছ থেকে ২৮ থেকে ৩০ লাখ টাকা সমিতির ফান্ডে জমা দেয়া হয়। এসব অর্থ পরবর্তীতে সমিতির সব সদস্যের মাঝে বণ্টন হয়ে থাকে। উল্লেখ্য, ২০১৮ সালে আইনজীবীদের জন্য নির্মিত শাপলা ও দোয়েল ভবনে ৭৩টি চেম্বার নিয়ম বরাদ্দ নিয়ে সমিতির তৎকালীন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বিরোধে জড়িয়েছিলেন।