কৃষি উন্নয়ন : প্রয়োজন উৎপাদন দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি

| সোমবার , ২১ জুন, ২০২১ at ৫:২৫ পূর্বাহ্ণ

কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক শনিবার বিকালে বান্দরবানের রুমা উপজেলায় কাজু বাদাম বাগান, কফি বাগান ও আমসহ অন্যান্য ফলবাগান পরিদর্শন শেষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘পাহাড়ের অর্থনৈতিক চেহারা বদলে যাবে কৃষির উন্নয়নে। এই অঞ্চলে কাজু বাদাম, কফি, মশলা চাষের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার এখন কৃষিকে বাণিজ্যিকীকরণ ও লাভজনক করতে নিরলস কাজ করছে। কাজু বাদাম ও কফি গবেষণা, উন্নয়ন ও সমপ্রসারণ এর লক্ষ্যে ২১১ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে।’
কৃষি মন্ত্রী আরও বলেন, ‘কৃষিকে লাভজনক করতে হলে কাজু বাদাম, কফি, গোলমরিচসহ অপ্রচলিত অর্থকরী ফসল চাষ করতে হবে। শুধু দেশে নয়, আন্তর্জাতিক বাজারেও এসবের বিশাল চাহিদা রয়েছে, দামও বেশি। সেজন্য এসব ফসলের চাষাবাদ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ বাড়াতে হবে। পাহাড়ের এই বৃহৎ অঞ্চলজুড়ে এসব ফসল চাষের সম্ভাবনা অনেক। এছাড়া, আনারস, আম, ড্রাগনসহ অন্যান্য ফল চাষের সম্ভাবনাও প্রচুর। তাই কাজু বাদাম ও কফির উন্নত জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং এসব ফসলের চাষ আরও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিতে কাজ করছে কৃষি মন্ত্রণালয়।’
আমরা জানি, কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির জীবনীশক্তি। কৃষিবিদদের মতে, উৎপাদনশীলতা ও আয় বৃদ্ধি এবং গ্রামীণ এলাকায় কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে বিশাল জনগোষ্ঠীর সমৃদ্ধির জন্য কৃষির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। দেশের জিডিপিতে কৃষি খাত অর্থাৎ ফসল, মৎস্য, প্রাণীসম্পদ এবং বন গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে, শ্রমশক্তির প্রায় অর্ধেক কর্মসংস্থান যোগান এবং কৃষিভিত্তিক শিল্প প্রতিষ্ঠানের প্রধান কাঁচামাল সরবরাহ করে। কৃষি সামাজিক কর্মকাণ্ডের এক বিশেষ ক্ষেত্র, যা জনগণের খাদ্য ও পুষ্টির নিশ্চয়তা, আয়ের সুযোগ সৃষ্টি এবং দারিদ্র্য হ্রাসকরণের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এছাড়া, কৃষি বিভিন্ন ধরনের ভোগ্যপণ্যের বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় ভোক্তাদের বাজারের চাহিদাভিত্তিক মালামালের উৎস। তাই কৃষির ক্ষেত্রের উন্নয়ন এবং এর প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করা অপরিহার্য। তবে কৃষকরা তেমন পৃষ্ঠপোষকতা পায় না বলে অভিযোগ রয়েছে। বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে কৃষির উন্নয়ন ঘটলেও কৃষকের উন্নয়ন হয়নি।
টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব তাঁর এক লেখায় বলেছেন, ঋণের কারণে ফসল সংরক্ষণ করতে পারেন না কৃষক, উৎপাদনের অব্যবহিত পরেই বিক্রি করে ঋণের কিস্তি কিংবা দেনা শোধ করতে হয়। তার ওপর উচ্চ আর্দ্রতার এবং উচ্চ তাপমাত্রায় পচনশীল সবজিজাতীয় কৃষিপণ্য সংরক্ষণের কোনো উপায়ই দেশে নেই, নেই অঞ্চল ও পণ্যভিত্তিক অবকাঠামো। ভিন্ন ভিন্ন ফসলের চাহিদা মোতাবেক আমাদের কোল্ডস্টোরেজ শ্রেণীকৃত নয়, দেখা যায় পুরোটাই আলুর উপযোগী! ফলে কৃষকেরা অ্যান্টি ক্লোরিনেটেড ওয়াটার, কার্বাইড কিংবা ফরমালিন ব্যবহার করছেন! উৎপাদিত পচনশীল শাকসবজি, ফল-ফুল সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় মৌসুমের বাইরে ফলনের কোনো বাজার নেই। এতে কৃষক বেশি উৎপাদিত পণ্য মৌসুমেই কম দামে বাজারে ছাড়াতে বাধ্য হন। ভিন্ন ভিন্ন জাতের আম পাড়ার মধ্যে ফারাক তিন-চার সপ্তাহ, লিচুর মাত্র দুই সপ্তাহ, কাঁঠালের তিন-চার সপ্তাহ, সবজি ও ফুলের ক্ষেত্রেও দু-তিন সপ্তাহ। সংরক্ষণব্যবস্থা না থাকায় এই স্বল্প সময়ের মধ্যেই কৃষককে বাজারজাত করতে হয়। তাই সমন্বিত বাজারজাতকরণ ব্যবস্থার অভাবে বাড়তি পচনশীল পণ্য পানির দরে বিক্রি হয়। অথচ মৌসুমের পরেই কিন্তু বাজারে এগুলোর ভালো দাম থাকে। এতে বিষ মিশিয়ে সংরক্ষণের প্রবণতা বাড়ে। উপরন্তু বাংলাদেশের কৃষিপণ্য বিক্রির বড় কোন আন্তর্জাতিক বাজারও তৈরি হয়নি। এর প্রধান কারণ হতে পারে, মানসম্পন্ন বিপণন ও প্রক্রিয়াজাতকরণ, ফুডগ্রেড সংরক্ষণ, মানসম্পন্ন প্যাকেজিং এবং আন্তর্জাতিক সরবরাহব্যবস্থায় সংযুক্ত হওয়ার বিপণন ব্যর্থতা। স্বাধীনতার পাঁচ দশকে বাংলাদেশের যত অর্জন, তার মধ্যে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশ পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম কৃষি উৎপাদনকারী দেশ। এই অর্জনকে নিবন্ধন, সংরক্ষণ, পরিবহন ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের অবকাঠামোগত উৎকর্ষে সঞ্চারিত করে প্রকৃত কৃষকদের ধনী করা গেলে সেটাই হবে টেকসই উন্নয়ন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, কৃষি উন্নয়নের জন্য একটি সুসমন্বিত গবেষণা পরিকল্পনা অপরিহার্য। গবেষণার মাধ্যমে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনা সম্ভব যার ফলে কৃষি সরবরাহকেন্দ্রিক এর পরিবর্তে চাহিদাভিত্তিক হবে। এর জন্য প্রয়োজন উৎপাদন মাত্রার চেয়ে উৎপাদন দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি। এছাড়াও এর জন্য প্রয়োজন সমতা, কর্মসংস্থান, সুষ্ঠু পরিবেশ সংরক্ষণ, পুষ্টি, খাদ্যের গুণগতমান, ব্যবসা বাণিজ্য ইত্যাদি নতুন ধারণার ক্ষেত্রসমূহ বিবেচনায় রেখে খাদ্য নিরাপত্তা প্রচেষ্টা চলমান রাখা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে