কুলসুমের বাবা তমিজউদ্দিন। মা রাহেলা বানু।
কুলসুমের বড় বোন নাজমা ছোট ভাই রতন। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় বড় বোন নাজমার বিয়ে হয় পাশের গ্রামের নবীর হোসেনের সাথে। আজ নাজমা তার স্বামীকে নিয়ে কুলসুমদের বাড়ি এসেছে। সারা বাড়িতে আনন্দের ঢেউ। সবার মনে খুশির বান ডেকেছে। কিন্তু একজনের মনে কোনো আনন্দ নেই। হাসি নেই। মনের উপর সারা রাজ্যের মেঘ এসে জমা হয়েছে। সে কুলসুম। কুলসুমের মনটা ঘন মেঘে ছেয়ে আছে।
কুলসুমের এতো সুন্দর মুখ। অথচ দেখলে মনে হচ্ছে এখনি কান্না করবে। কারণ আজ তমিজউদ্দিন মোল্লা বাড়ির ছেলে রহিমের সাথে কুলসুমের বিয়ের পাকা কথা দিয়ে এসেছে। বিয়ের দিন তারিখ ঠিক হয়ে গেছে। কুলসুমকে পাত্র পক্ষের খুব পছন্দ হয়েছে। কুলসুম পছন্দ না হওয়ার মতো পাত্রী নয়। ক্লাস এইট থেকে বৃত্তি নিয়ে পাশসকরেছে। এখন নাইনে পড়ছে কুলসুম। এ জন্যই বাড়িতে এতো আনন্দ। বিয়ের কথা শুনে কুলসুম মোটেও খুশি নয়। বরং এ বিয়ে কীভাবে বন্ধ করা যায় সেটা নিয়েই কুলসুম ভাবছে।
নাজমা কুলসুমের কাছে গিয়ে মাথায় হাত রেখে বললো-কী রে, এ বিয়েতে তোর মত নেই? তোর মুখটা এমন ফ্যাকাশে কেন? নাজমার বুকে মাথা রেখে কেঁদে ওঠে কুলসুম। কিছুই বলতে পারছে না। শুধু কাঁদছে।
নাজমার মনে পড়ছে। নাজমার যখন অল্প বয়সে বিয়ে ঠিক হয়েছিলো তখনও রাহেলা বানু নাজমার বিয়েতে অমত করেছিল। প্রতিবাদ করেছিল, এই অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে দেওয়া ঠিক নয়। কিন্তু রাহেলা বানুর প্রতিবাদ ধোপে ঠেকেনি। তমিজউদ্দিনের সেই এক কথা। এমন পাত্র হাতছাড়া হলে মেয়ে আয়বুড়ো হয়ে যাবে। তাছাড়া সমাজের যা দিনকাল, তাতে সোমত্ত মেয়ে ঘরে রাখা ঠিক না। প্রথম যখন নাজমা মা হলো তখন জীবন নিয়ে টানাটানি। ভাগ্য ভালো, কোনোরকমে সদর হাসপাতালে নিয়ে জীবন রক্ষা পেয়েছে। কিন্তু পেটের সন্তানকে বাঁচাতে পারেনি।
কুলসুম ভাবছে, আজ এই দু:সময়ে নাজমার সাহায্য প্রয়োজন। নাজমাকে দিয়ে মাকে বোঝাতে হবে। কিন্তু মায়ের কথা বাবা শুনলে তো। সেই কালো রাতের দিনগুলোর কথা কুলসুম নাজমাকে মনে করিয়ে দিলো। শিউড়ে ওঠলো নাজমা। সত্যিই তো, সেই দিনগুলোর কথা কি ভোলা যায়? কখনও না।
নাজমাকে জড়িয়ে ধরে বললো, আপা যেভাবে হোক এ বিয়ে বন্ধ করতে হবে। আমি কিছুতেই বিয়ে করবো না। আমি লেখাপড়া করবো। ডাক্তার হবো। অভয় দিলো নাজমা। আচ্ছা, ঠিক আছে। আমি আম্মার সাথে কথা বলি। আম্মা রাজী থাকলে আব্বাকে কোনোভাবে বুঝিয়ে সুজিয়ে এ বিয়ে বন্ধ করতে হবে।
সব শুনে তমিজউদ্দিনের সেই এক কথা। আমি ওয়াদার বরখেলাপ করতে পারব না। আমি কথা দিয়ে এসেছি। এ বিয়ে হবে। দিন তারিখ ঠিক হয়ে গেছে।
কুলসুমের বিয়ের খবর পেয়ে পাড়ার সহপাঠিরা এগিয়ে এলো। লুবনা, তমাল, আবীর, কৌশিক, সালেহা, চন্দন সবাই স্কুলের হেডস্যারের সাথে দেখা করলো। হেডস্যার রেগে গেলেন। একটা অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া বাচ্চা মেয়ে। এখনও আঠারো বছর পূর্ণ হয়নি। তমিজউদ্দিন কি জানে না যে, আঠারো বছরের আগে কোনো মেয়েশিশু কিংবা ২১ বছরের আগে কোনো ছেলেশিশুর বিয়ে দেওয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ। দেশে এখন বাল্য বিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭ পাশ হয়েছে। এ কথাগুলো কুলসুমের বাবাকে বোঝাতে হবে। এ ব্যাপারে পরিবারের এবং সমাজের সবাইকে সচেতন হতে হবে।
পরদিন সকালে হেডস্যারের সাথে স্কুলের বন্ধুদের একসাথে বাড়ির উঠোনে দেখে তমিজউদ্দিন অবাক হয়ে যায়। দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে কুলসুম। হেডস্যারের পা ছুঁয়ে সালাম করলো। কুলসুম এক মুহূর্তের জন্য ভুলে গেলো সবকিছু। বন্ধুদের আর হেডস্যারকে দেখে তারা কেন আসতে পারে সেকথাও ভুলে গেলো। পরক্ষণে মনে হতেই হেডস্যারের পাশে গিয়ে ভয়ে ভয়ে বললো, স্যার আমি লেখাপড়া করতে চাই। আপনি আমাকে বাঁচান।
নাজমা ও রতন এলো। এলো তমিজউদ্দিন। ভিতর বাড়ি থেকে বার বার উঁকি দিয়ে দেখছে রাহেলা বানু। হেডস্যারকে দেখে বাড়ির আরো অনেকে কুলসুমদের উঠোনে এসে দাঁড়িয়েছে। হেডস্যার তমিজউদ্দিনকে ডেকে বললেন, কি গো তমিজ ভাই, আপনার বাড়ি এসেছি। আমাদের একটু বসতে দেবেন তো। কুলসুমের মাকে বলেন, উঠোনে একটা মাদুর বিছিয়ে দিতে। আর বাড়ির কয়েকজন মুরুব্বীদেরও ডাকেন। সবাই বসে একটু কথা বলবো।
উঠোনে মাদুর পেতে দিলেন রাহেলা বানু। বাড়ির মুরুব্বীরাও আসলেন। ঘরের বৌ-ঝিরাও এলো। সবাই গোল করে মাদুরে বসলেন। প্রথমে কুলসুমের বন্ধুরা এ বিয়ের প্রতিবাদ করলো। আবীর বললো, কুলসুম আমাদের বন্ধু। ক্লাসে ও বরাবরই ভালো ছাত্রী। ও যদি ভালোমতো লেখাপড়া শেষ করতে পারে, তবে জীবনে অনেক বড় হতে পারবে। এই বয়সে বিয়ে দেওয়া মানে ওর সম্ভাবনাটা নষ্ট করে ফেলা। আমরা এটা হতে দিতে পারি না। একদিন কুলসুমই হবে আমাদের সমাজের গর্ব।
সবাই একে অন্যের মুখের দিকে চেয়ে আছে। তারপর হেডস্যার পুরো বিষয়টা পরিষ্কার করে সহজভাবে সবাইকে বুঝিয়ে বললেন। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, ছেলের বয়স কত?
আঠারো উনিশ হবে। জবাব দিলেন তমিজউদ্দিন।
হেডস্যার বললেন, দু’জনেই আইনের চোখে সমান অপরাধী। পুলিশ যদি জানতে পারে, মেয়ে এবং ছেলের বাবা দুজনকেই থানায় নিয়ে যাবে। যেভাবে হোক, এ বিয়ে বন্ধ করতে হবে।
বন্ধুরাও বলে উঠলো, এ বিয়ে বন্ধ করতে হবে। সাথে সাথে উপস্থিত সবাই কুলসুমের বন্ধুদের সাথে তাল মিলিয়ে বলে উঠলো, এ বিয়ে বন্ধ করতে হবে।
সবার সাথে কুলসুমের চোখে মুখেও আনন্দের ঢেউ খেলছে। সে আবার স্কুলে যাবে।