কী নামে ডেকে, বলবো তোমাকে

শিউলী নাথ | শনিবার , ২৪ মে, ২০২৫ at ৬:৫৯ পূর্বাহ্ণ

তিনি কখনো বিদ্রোহী, কখনো প্রেমিক, কখনো বিরহী, কখনো বা সাম্যের কবি। তিনিই আবার ছড়া, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ ও নাটকের চমৎকারীত্বে শিশু থেকে বৃদ্ধ সবার হৃদয় দখল করে আছেন। বলছিবাংলা সাহিত্য জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র, ধুমকেতু রূপে যার আবির্ভাবআমাদের জাতীয় কবি, প্রাণের কবি ‘কাজী নজরুল ইসলাম’ এর কথা। শৈশব ও বাল্যকাল থেকে প্রতিটি শিশু বড় হয়ে ওঠে ‘ভোর হলো দোর খোলো খুকুমণি ওঠো রে/ ওই ডাকে জুঁই শাখে ফুলখুকি ছোটরে’এই ছড়াটির সাথে পরিচয় এর মাধ্যমে। এরপর শিশু মনের নানা প্রশ্নে আসে– ‘কাঠবিড়ালি! কাঠবিড়ালি!/পেয়ারা তুমি খাও?/গুড়মুড়ি খাও? / দুধভাত খাও?/বাতাবি নেবু লাউ?-এই কবিতাটি। এভাবে ক্রমাগত শিশুতোষ ছড়ায় পরিপূর্ণ হতে থাকে শিশু হৃদয়। ‘লিচুচোর’ কবিতাটি ‘বাবুদের তালপুকুরে/ হাবুদের ডাল কুকুরে’ যেমনি পাঠে আনন্দ জাগায় তেমনি শিশুকিশোরদের আবৃত্তিতে উৎসাহ দেয়। ‘আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে? /তোমার ছেলে উঠলে মাগো রাত পোহাবে তবে’/। ‘আমি হব সকাল বেলার পাখি’ কবিতায় শিশু মনকে কবি আত্মপ্রত্যয়ী স্থানে পৌঁছে দিয়েছেন।

এরপর কিশোর মনে তীব্র আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তুলেছেন ‘থাকবো নাকো বদ্ধ ঘরে/ দেখবো এবার জগৎটাকে’– ‘সংকল্প’ কবিতাটির মধ্য দিয়ে। যার পরিণতি দেখতে পাই আমাদের ‘রণ সঙ্গীতের’ উদ্দীপ্ত চরণের মাঝে– ‘ঊষার দুয়ারে হানি আঘাত, /আমরা আনিব রাঙ্গা প্রভাত’। শিশুকিশোর মনকে প্রত্যয়ী করে তোলেন। কবি নজরুল ক্রমশই প্রবেশ করেন কিশোর ও তরুণদের মননেচেতনায়। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে কবির বিদ্রোহী সত্তা জেগেছিল দেশ মাতৃকাকে ভালোবেসে। তাই কবি ঔদ্ধত্য কণ্ঠে বলেছেন, ‘বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত/ আমি সেই দিন হব শান্ত /যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল /আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না’! কখনোবা ‘কারার ঐ লৌহ কবাঁ / ভেঙে ফেল কররে লোপাট’ অথবা ‘এই শিকল পরে শিকল তোদের করব রে বিকল’। শোষকের দিকে আঙ্গুল তোলার ক্ষমতা এবং গর্জে ওঠার এই সাহস কবি নজরুলেরই ছিল। যা ঈশ্বর প্রদত্ত।

মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী/ আর হাতে রণতুর্য’ এই একটি মাত্র পংক্তিতে নজরুলের দ্বিসত্তার সরস প্রাণবন্ত উপস্থিতি লক্ষণীয়। কাজী আব্দুল ওদুদ লিখেছেন, ‘যিনি খ্যাতি লাভ করলেন বিদ্রোহী রূপে, কিন্তু কাব্য লক্ষ্মীর প্রসাদ অজগ্রভাবে তিনি লাভ করলেন প্রেম সংগীতের রচয়িতা রূপে’। প্রেমে মশগুল কবি যেমন লিখেছেন ‘মোর প্রিয়া হবে এসো রানী দেব খোঁপায় তারার ফুল’ তেমনি বিরহী কবির লেখনীতে রয়েছে ‘চোখের নেশা ভালোবাসা, সে কি কভু থাকে গো’। নজরুলপ্রেমে কোনো প্রতিযোগিতা বা প্রতিদ্বন্দ্বিতা কাম্য ছিল না। তবে পাওয়ার আনন্দ আছে, হারানোর বেদনা আছে, ঈর্ষা আছে, মানঅভিমান আছে যা নজরুলের কাছে ছিল অসহনীয়। তাইতো ‘দোলনচাঁপা’ কাব্যগ্রন্থের ‘শেষ প্রার্থনা’ কবিতায় কবি লিখেছেন, ‘আজ চোখের জলে প্রার্থনা মোর শেষ বরষের শেষে/ যেন এমনি কাটে আসছে জনম তোমায় ভালোবেসে’। সৈনিক ও প্রেমিক এই দুই রূপেই নজরুল বাংলা সাহিত্য ও সংগীতে অসাধারণ সৃষ্টিশীলতার পরিচয় দিয়েছেন।

দেখিনু সেদিন রেলে / কুলি বলে এক বাবু সাব তারে/ ঠেলে দিলে নিচে ফেলে’। কিংবা ‘মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান’। অথবা ‘বিশ্বে যা কিছু মহান/ সৃষ্টির চির কল্যাণকর/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী/ অর্ধেক তার নর’।

অভেদ শ্রেণি, অসাম্প্রদায়িক চেতনা, নারী পুরুষের সম অধিকার এসব শুধু নজরুল কাব্যেই দৃশ্যমান। কালজয়ী এই প্রতিভা অমর। পৃথিবী যতদিন থাকবে ততদিন বেঁচে থাকবেন কবি। প্রজন্মের পর প্রজন্ম জানবে এই বিদ্রোহীকে, প্রেমিককে, বিরহীকে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রতি অবনত চিত্তে শ্রদ্ধা জানিয়ে আবারো দ্বিধান্বিত মনে কবির কাছে জানতে চাই, ‘কী নামে ডেকে, বলবো তোমাকে’।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমেঠো পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে
পরবর্তী নিবন্ধমক্কা ও মদিনায় দোয়া কবুলের বিশেষ স্থানসমূহ