সাগরের ভাঙনে বিলীন হয়ে যাচ্ছে কক্সবাজার সৈকতের বিস্তীর্ণ এলাকা। ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে পর্যটন এলাকার সরকারি বেসরকারি অনেক স্থাপনা। কিন্তু কী কারণে এভাবে ভাঙছে সৈকত?
বিজ্ঞানীরা বলছেন, মূলত সৈকতের প্রাকৃতিক জৈব প্রতিরোধ ব্যবস্থা ধ্বংস করে অপরিকল্পিত উন্নয়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই ভেঙে বিলীন হচ্ছে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত। এ বিষয়ে দীর্ঘ মেয়াদী সমীক্ষার মাধ্যমে একটি টেকসই পরিকল্পনা প্রণয়নের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইন্সটিটিউটের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দার বলেন, হঠাৎ করে কী কারণে এভাবে সৈকত ভাঙছে তা জানার জন্য আজ (রোববার) আমরা একটি টিম নিয়ে কক্সবাজার শহর থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সমুদ্র সৈকত এলাকা পরিদর্শন করেছি। দেখা গেছে, যেখানে সাগর লতার বালিয়াড়ি ও কেয়া-নিশিন্দার বন আছে, সেখানে সাগরতীর ভাঙেনি। বরং সাগর লতায় বালি ও আবর্জনা আটকে বালিয়াড়ি আরও উঁচু হয়েছে। আর যেখানে ঝাউবন ও অন্য কোন উঁচু বাঁধ আছে সেখানেই ক্ষয়ের শিকার হয়েছে সৈকতের মাটি। এতে প্রমাণিত হয়, প্রাকৃতিক জৈব প্রতিরোধ ব্যবস্থা ধ্বংস করে অপরিকল্পিত উন্নয়নের কারণেই ভাঙছে সমুদ্র সৈকত।
পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. আনসারুল করিমও মনে করেন সাগর লতার বালিয়াড়ি ও কেয়া-নিশিন্দার বনসহ কক্সবাজার সৈকতের প্রাকৃতিক জৈব প্রতিরোধ ব্যবস্থা ধ্বংস হওয়ার কারণেই ভাঙছে সৈকত।
তিনি বলেন, সৈকতের যেখানেই জোয়ারের ঢেউকে বাধা দেওয়া হয়, সেখানেই সৈকতের মাটি ক্ষয়ের শিকার হয়। সৈকতের বালিয়াড়িতে সাগর লতাসহ অন্যান্য লতাজাতীয় উদ্ভিদের পরিবর্তে ঝাউগাছ লাগানোসহ নানা স্থাপনা নির্মাণের কারণে প্রাকৃতিক জৈব প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। এ বিষয়ে একটি দীর্ঘ মেয়াদী সমীক্ষা ছাড়া কোনো উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলে পরিস্থিতি আরো হিতে বিপরীত হতে পারে।
লঘুচাপ ও পূর্ণিমার জোয়ারের প্রভাবে গত বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার কক্সবাজার উপকূলে আঁছড়ে পড়ে ঢেউ। ঢেউয়ের তোড়ে হারিয়ে যায় শহরের কলাতলী শুকনাছড়ি সাগরতীরের অন্তত ১৫টি বসতবাড়ি ছাড়াও শহরের লাবণী পয়েন্ট, শৈবাল পয়েন্ট ও ডায়বেটিক পয়েন্টসহ বিস্তীর্ণ সৈকতের ঝাউবন। ভাঙনের কারণে ঝুঁকির মুখে রয়েছে শহর ও শহরের বাইরে অবস্থিত সরকারি-বেসরকারি বহু স্থাপনা। পানি উন্নয়ন বোর্ড সৈকতে বালু ভর্তি জিও টিউব বসিয়ে সমুদ্রের ভাঙন ঠেকানোর চেষ্টা করলেও তা কার্যকর প্রমাণিত হচ্ছে না। এই অবস্থায় প্রায় ৩ হাজার ১৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে শহরের দরিয়ানগর পয়েন্ট সৈকত থেকে নাজিরারটেক-এয়ারপোর্ট হয়ে নুনিয়াছড়া পর্যন্ত ১২ কি.মি. দীর্ঘ বাঁধ নির্মাণের একটি প্রকল্প একনেকের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে বলে জানিয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের সিনিয়র সচিব কবির বিন আনোয়ার।
তবে এই প্রকল্পটি নিয়ে আপত্তি জানিয়েছেন স্থানীয় পরিবেশবাদী সংগঠনের নেতারা। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কক্সবাজার জেলা শাখার সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী বলেন, সরকারঘোষিত পরিবেশ সংকটাপন্ন এলাকায় সকল ধরনের স্থাপনা নির্মাণ নিষিদ্ধ হলেও তিন বছর আগে দেয়া উচ্চ আদালতের রায় এখনও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। প্রভাবশালীরা দেশের আইন কানুনের তোয়াক্কা না করে অবৈধভাবে একের পর এক ৮/১০ তলা ভবন তৈরি করছে। ফলে প্রকৃতি তার পাওনা বুঝিয়ে নিচ্ছে। তিনি বলেন, কক্সবাজার শহরের সাগর তীরবর্তী যে জমিতে এখন ৫ শতাধিক হোটেলসহ কয়েক হাজার ভবন গড়ে ওঠেছে, তা ছিল ‘ফ্লাড প্লেইন’ বা বন্যা কবলিত নিচুঁ ভূমি; যেখানে একসময় সাগরের জোয়ার ভাটা হত। আর এখন সেই জমিতে প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট করে উচুঁ বাঁধ নির্মাণ করা হলে জোয়ারের সময় সৈকতের অস্তিত্বই হারিয়ে যেতে পারে। যার প্রমাণ সাগরের ভাঙনে কলাতলী থেকে বেইলি হ্যাচারি পর্যন্ত সোয়া এক কিলোমিটার দীর্ঘ মেরিন ড্রাইভ বিলীন হয়ে যাওয়ার ঘটনা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. শাহ নেওয়াজ চৌধুরী সম্প্রতি সাগর তীর ভেঙে বিলীন হওয়ার ঘটনায় প্রাকৃতিক রক্ষাকবচ ভেঙ্গে পড়াকে দায়ী করে বলেন, সৈকতের সুরক্ষায় উন্নত বিশ্বের সরকারগুলো খুবই সক্রিয়। এজন্য তারা সৈকত এলাকায় কোনো ধরনের অবকাঠামোগত উন্নয়ন করতে দেয় না। সৈকতকে রাখা হয় প্রাকৃতিকভাবেই। অথচ আমরা কী করছি? সেই সৈকত এলাকায় আমরা বড় বড় হোটেল ও অবকাঠামো গড়ে তুলছি। তিনি আরও বলেন, কক্সবাজার সৈকতে একসময় বালিয়াড়ি ছিল, বালিয়াড়ির ওপর সাগরলতাসহ নানা ধরনের লতা-গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ ছিল। এগুলো সৈকতের সুরক্ষায় প্রাকৃতিকভাবে কাজ করত। কিন্তু পর্যটকদের চলাফেরার কারণে সাগরলতা মরে গেছে, বালিয়াড়িগুলোও নেই। অথচ বিশ্বের অন্যান্য দেশ তা যত্ন করে রেখে দেয়। আমাদের সৈকতের কিছু জায়গা সুরক্ষিত করা দরকার ছিল।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিদ্যা ও প্রকৌশল বিভাগের প্রফেসর ড. আশরাফ আলী সিদ্দিকী বলেন, সমুদ্র তীরবর্তী ভূমির যে ভূ-তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট থাকে, তা উপেক্ষা করে অপরিকল্পিতভাবে স্থাপনা গড়া হয়েছে কক্সবাজারে। যে কারণে সাগর তীর ভাঙছে। তিনি বলেন, সমুদ্র ও মূল ভূ-খণ্ডের মাঝখানে সমান্তরালভাবে একটি জলাভূমি ও সৈকত থাকে। ঘূর্ণিঝড়সহ বিভিণ্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় সাগরের উপচে পড়া জোয়ার সৈকতের বালিয়াড়িতে আঁছড়ে পড়ে। এ সময় কিছু পানি বালিয়াড়ি পেরিয়ে জলাভূমি অথবা ক্যানেলের মতো ছোট জলধারায় জমা হয়। যে জলাধারাটি সৈকতের সাথে সমান্তরালভাবে প্রবাহিত হয়ে এক প্রান্তে গিয়ে বড় জলধারার মাধ্যমে সাগরে মিলিত হয়। আর এই ভূ-তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট যতদিন অবশিষ্ট ছিল, প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ব্যবস্থাও প্রায় অক্ষুণ্ন ছিল।
বালিয়াড়িতে স্থাপনা নির্মাণ ও ঝাউগাছের মতো দীর্ঘ উচ্চতার বৃক্ষ লাগানোর বিরোধিতা করে তিনি বলেন, সৈকতের অগ্রবর্তী অংশে দীর্ঘ উচ্চতা সম্পন্ন বৃক্ষের ঢাল সৃষ্টির কারণে বালিয়াড়িগুলো বিলীন হয়ে যাচ্ছে এবং সাগর তীরে ভাঙন দেখা দিচ্ছে। গভীর সমুদ্র থেকে শত শত মাইল পেরিয়ে বিনাবাধায় ধেয়ে আসা বাতাসগুলো সৈকতে এসে হঠাৎ ঝাউগাছের মতো দীর্ঘ উচ্চতাসম্পন্ন প্রাকৃতিক ঢালে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে নীচের দিকে চাপ তৈরি করে এবং এতে বালিয়াড়ির মাটি সরে যায়। ফলে সাগরতীর ভেঙে যায়। তিনি কক্সবাজার সৈকতের টেকসই সংরক্ষণে একটি প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলার ওপর জোর দেন।