পল্লীর মানুষ ও তার সাহিত্য–সংস্কৃতিকে অমরত্ব দান করতে হলে তাঁদের ভালবাসতে হয়, নিজের মধ্যে থাকতে হয় স্বজাত্যবোধ। জানতে হয় স্বজাতির সাহিত্য–সংস্কৃতির অতীত ইতিহাস, উপলব্ধি করতে হয় তাদের চাহিদা। সর্বোপরি সব কাজেই নিজেকে শ্রেণিনির্বিশেষে মানুষের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার মানসিকতা থাকতে হয় একজন সাধক পুরুষের। এমনই একজন সাধক মুন্সি আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ। মুন্সি তাঁর বংশগত উপাধি এবং সাহিত্যবিশারদ হচ্ছে সুধী সমাজের পক্ষ থেকে তাঁকে দেওয়া উপাধি।
আবদুল করিমের জন্ম ১৮৭১ সালে পটিয়া উপজেলার সুচক্রদন্ডী গ্রামের এক উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারে। তাঁর বাবার নাম মুন্শী নুরউদ্দীন (১৮৩৮–৭১) এবং মায়ের নাম মিস্রীজান। বাবা মারা যাওয়ার তিন মাস পর আবদুল করিমের জন্ম হয়। ১৮৮৮ সালে ১৭ বছর বয়সে মাকেও হারান তিনি। ১৮৮২ সালে আবদুল করিমের দাদা–দাদী তাঁদের ছেলে আইনউদ্দীনের (আবদুল করিমের চাচা) বড় মেয়ে নয় বছর বয়স্ক বদিউননিসার সঙ্গে এগারো বছরের করিমের বিয়ে দেন। করিম ১৯২১ সাল পর্যন্ত চাচার সঙ্গে যৌথ পরিবারেই ছিলেন।
কর্ণফুলী নদীর পূর্ব তীর থেকে টেকনাফ পর্যন্ত অঞ্চলে বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদই প্রথম ও একমাত্র ব্যক্তি যিনি ১৮৯৩ সালে প্রথম এন্ট্রাস পাস করেন। তিনি ১৮৯৫ সন পর্যন্ত এ অঞ্চলের একমাত্র এফ–এ পড়ুয়া ছাত্র ছিলেন। তবে অসুস্থতার কারণে তিনি এফ.এ পরীক্ষার পাঠ শেষ করতে পারেননি।
ড. আহমদ শরীফ লিখেছেন, ‘১৮৯৩ সনে দ্বিতীয় বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে জেলার অর্ধাংশে প্রথম মুসলিম ইংরেজী শিক্ষিতের অসামান্য গৌরব অর্জন করেন। সম্ভবত স্কুলে মৌলবী শিক্ষকের অভাবেই আবদুল করিমকে সংস্কৃত পড়তে হয়। চট্টগ্রাম কলেজে দু’বছর এফ–এ পড়ার পর পরীক্ষার পূর্বে সান্নিপাত (টাইফয়েড) রোগাক্রান্ত হন, ফলে পরীক্ষা দেওয়া হল না, উচ্চ শিক্ষারও ইতি ঘটে এখানেই।’
শিক্ষকতা করতে গিয়ে তিনি সাহিত্য–সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বাঙালি মুসলমানদের স্বকীয়তা ও স্বজাত্যবোধের অভাব উপলব্ধি করেন। এই অভাববোধই তাঁকে সাহিত্য সাধনায় উদ্বুদ্ধ করে। চাকরি জীবনে অঢেল খাটুনির পর তিনি পূঁথি সংগ্রহ ও সাহিত্য সাধনায় জীবনের বড় অংশ কাটিয়ে দিয়েছেন। প্রায় দেড়শ প্রাচীন ও বিস্মৃত কবিকে তিনি সূধী সমাজে পরিচিত করার মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যের ভান্ডারকে ব্যাপকভাবে সমৃদ্ধ করেন। সমসাময়িক পত্র–পত্রিকায় তাঁর প্রচুর প্রবন্ধ ছাপা হতো। মুসলমানদের বাঙালিত্ববোধ জেগে উঠার পেছনে তাঁর রচিত ও প্রকাশিত প্রবন্ধের প্রভাব অপরিসীম।
জীবনের নানা বাঁকে সাহিত্যবিশারদ শিক্ষকতা, চট্টগ্রাম জজ আদালত ও স্কুল ইন্সপেক্টরের অফিসে কেরানি পদে চাকরি করেন। নিষ্ঠা ও কর্তব্যপরায়ণতার স্বীকৃতি হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমিক পরীক্ষাসমূহের বাংলার পরীক্ষক হিসেবেও নিয়োজিত ছিলেন তিনি।
ড. আহমদ শরীফ আবদুল করিমের কর্মজীবনের ফিরিস্তি দেন এভাবে: ‘১. চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল স্কুলে শিক্ষক–কয়েক মাস ১৮৯৫ সন। ২. সীতাকুন্ড মধ্য ইংরেজী স্কুলে প্রধান শিক্ষক–এক বছর–১৮৯৫–৯৬ সন। ৩. জজ আদালতে এ্যাপ্রেন্টিস [শহরে ও পটিয়ায়]-১৮৯৬–৯৭ সন। ৪. কমিশনার অফিসে ক্লার্ক–১৮৯৮ [জানুয়ারি থেকে] সন। ৫. আনোয়ারা মধ্য ইংরেজী স্কুলের প্রধান শিক্ষক–১৮৯৯–১৯০৫ সন। ৬. বিভাগীয় স্কুল ইন্সপেক্টর অফিসে ক্লার্ক–১৯০৬–৩৪ সন। সার্টিফিকেট অনুসারে ৫৬ বছর বয়সে [অতিরিক্ত এক বছর চাকরি করে] এবং বাস্তবে ৬৫ বছর বয়সে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। তখন তিনি মাসিক বেতন পেতেন ১২০ টাকা, অবসর ভাতা পেতেন ৬০ টাকা এবং ১৯৩৯ সন থেকে সরকার প্রদত্ত সাহিত্যিক বৃত্তি পেতেন ৬০ টাকা। আমৃত্যু মাসিক আয় ছিল ১২০ টাকা।’
নিয়মিত চাকরি থেকে অবসরের পর স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় আবদুল করিমকে প্রথমে প্রবেশিকার ও পরে বি এ–র বাঙলার পরীক্ষক নিয়োগ করেন। ১৯৪৭ সন পর্যন্ত তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বি–এ পরীক্ষার বাঙলা ভাষাসাহিত্যের পরীক্ষক ছিলেন। ১৯৫১ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরও বাঙলা অনার্সের একটি পত্রের প্রশ্নকর্তা ও পরীক্ষক নিযুক্ত হয়েছিলেন তিনি। অবসর গ্রহণের পর সাহিত্যবিশারদ গ্রামের বাড়িতেই বসবাস করতেন। পরবর্তী সময়ে তিনি পটিয়া উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় ও দক্ষিণ ভূর্ষি মধ্য ইংরেজি বিদ্যালয়ের কার্যনির্বাহী পর্ষদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। সূচক্রদণ্ডী ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট ছিলেন প্রায় ১০ বছর।
১৯৪৭ সন পর্যন্ত সাহিত্যবিশারদ ও তাঁর গবেষণাকর্মের বিশেষ মূল্যায়ন ছিল বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে। তিনি কয়েক বছর পরিষদের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য, একবার সহ–সভাপতি (১৩২৬ সালে, সে বছর সভাপতি ছিলেন রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী) ছিলেন। এর আগে তাঁকে পরিষদের বিশিষ্ট সদস্য (ঋবষষড়)ি করে সম্মানিত করা হয় (১৯০৩)। চট্টল ধর্মমণ্ডলী তাঁর সাহিত্যকৃতির স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে ১৯০৯ সালে ‘সাহিত্য বিশারদ’ এবং নদীয়ার সাহিত্য সভা ১৯২০ সালে ‘সাহিত্য সাগর’ উপাধি দিয়ে সম্মানিত করে।
সাহিত্যবিশারদ খাঁটি বাঙালি জাতীয়তাবোধ–সম্পন্ন মানুষ ছিলেন। এ অঞ্চলে তিনিই প্রথম দেখিয়ে দিয়েছেন যে ‘বাংলা আমাদের দেশ, বাংলা আমাদের ভাষা এবং আমরা বাঙালি মুসলমানদের বংশধর।’ তাঁর ভাষায়, ‘আমার এক বিশ্বাস আছে যে, আমার দেশের মৃত্যু নাই, আমার দেশের আত্মা যে জনগণ তারও মৃত্যু নাই, তেমনই অমর আমার এই বাঙ্গালা ভাষা।’
আবদুল করিম ছিলেন অত্যন্ত সাদাসিদে, অমায়িক, অতিথিদের প্রতি যত্নশীল, শিশুদের প্রতি স্নেহশীল। কষ্টার্জিত অর্থের একাংশ গ্রামের অসহায় দারিদ্র–পীড়িত লোকদের মাঝে বিলিয়ে দিয়ে এবং অসহায় রোগীদের নিজ হাতে ওষুধপত্র এনে দিয়ে তিনি আনন্দ পেতেন।‘ যেমন: আনোয়ারা মধ্য ইংরেজি স্কুলের প্রধান শিক্ষক থাকাকালে দুইজন স্থানীয় দরিদ্র পরিবারের সন্তান আজিজুর রহমান ও নিশি ঘোষ সাহিত্যবিশারদের খুবই প্রিয়ভাজন ছিল। তিনি চট্টগ্রাম শহরে ইন্সপেক্টর অফিসে কেরানি হওয়ার পরেও তাঁদের বিদ্যালয়ের ব্যয় স্বেচ্ছায় বহন করেন এবং আজিজুর রহমানকে এন্ট্রাস পাস করিয়ে তাঁর নিজের অফিসে কেরানি পদে নিয়োগের ব্যবস্থা করেন। নিশি ঘোষও তাঁর অর্থেই বি–এ পাস করে সীতাকুণ্ড উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। বৃদ্ধ বয়সেও গাঁয়ের দু’একজন গরিব ঘরের সন্তানকে পড়ালেখার জন্য অর্থ সাহায্য দেন সাহিত্যবিশারদ।
আবদুল করিম সাধারণভাবে শান্ত প্রকৃতির ছিলেন। কিন্তু কখনও কখনও তাঁর এমন অভিমান, রাগ বা জেদ ছিল তা রীতিমতো চমকে উঠার মতো!
১৯৫৩ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর বেলা সাড়ে ১০টা থেকে পৌনে এগারটায় হূদক্রিয়া বন্ধ হয়ে এই সাধক পুরুষ পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। তাঁর মৃত্যু সংবাদে চারদিকে শোকের ছায়া নেমে আসে। ঢাকা ও চট্টগ্রামের সব পত্র–পত্রিকায় তাঁর মৃত্যুর খবর ও শোকবাণী গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হয়।
ড. আহমদ শরীফ জানাচ্ছেন, “তাঁর মৃত্যুসংবাদ বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে বর্ণিত ও পরিবেশিত হয়েছিল ঢাকার সেকালের সব ইংরেজি–বাঙলা–উর্দু দৈনিকে এবং সাপ্তাহিকে। কোলকাতার কাগজেও তাঁর মৃত্যু সংবাদ পরিবেশিত হয়েছিল। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ আয়োজিত শোকসভায় অধ্যাপক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, অধ্যাপক জনার্দন চক্রবর্তী প্রমুখ বিখ্যাত বিদ্বানেরা তাঁর গুণের ও অবদানের কথা বক্তৃতায় শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। ঢাকায় পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদও শোক সভা করে। ঢাকায়–চট্টগ্রামে এবং অন্যত্রও অনেক শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়। চট্টগ্রামে, পটিয়ার স্থানীয় বিদ্যালয়গুলোও তাঁর মৃত্যু–সংবাদে ছুটি হয়ে যায়।
এ লেখা শেষ করবো তাঁর মৃত্যু সম্পর্কে ড. মুহম্মদ এনামূল হকের একটি বক্তব্য দিয়ে ‘মাস্টার আবদুল করিম মারা গেছেন, কেরানী আবদুল করিম দেহত্যাগ করেছেন, কিন্তু সাহিত্যবিশারদ মরেননি। তিনি মরতে পারেন না, কারণ…চিত্ত, বিত্ত, জীবন এবং যৌবন এ সমস্তই চঞ্চল, কিন্তু কীর্তিমান ব্যক্তি চিরজীবী। কীর্তিমান সাহিত্যবিশারদ আজও জীবিত।’
লেখক : সম্পাদক, ইতিহাসের খসড়া, ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণাকর্মী