এইভাবে ভিজে ভিজে কীর্তিনাশা কতদূর যাবে
এই দেশে, বন্যার কি শেষ আছে? বৃষ্টি ও প্রেমের সারাপিঠে এলানো চুলের ঢেউ ভিজে ছপছপ
শীতার্ত বর্ষার ফলা বিধে ফেলে সমস্ত শরীর;
আজ রাতে লক্ষ–লক্ষ কামার্ত কুমীর উঠে এসে
দুই পাড়ে পরস্পর খাবলে খাবে আশ্লেষে চুম্বনে,
আজ রাতে লক্ষ–লক্ষ উদ্দাম মাছেরা ঝাঁকে–ঝাঁকে তড়পায় সারা গাঙ জান্তব ক্ষুধার হাহাকারে;
এইভাবে পুড়ে–পুড়ে কীর্তিনাশা কতদূর যাবে,
এই দেশে, খরার কি শেষ আছে? মারী ও মড়ার
সারাগায়ে লেপ্টানো শাড়ির ঢেউ শতচ্ছিন্ন দীন
সূর্যের লোলুপ চোখে জ্বলে ওঠে উদ্ভিন্ন নিষ্ঠুর;
এইভাবে দুঃখে দৈন্যে কীর্তিনাশা কতদূর যাবে;
এই দেহ কাল হবে কেউ তাকে ঠিক ছিঁড়ে খাবে
এদেশের বহু নদী দেখার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। আমার নিজ শহর চট্টগ্রামে আছে কর্ণফুলি । শান্ত, সুশ্রী এই নদী পৃথিবীর সব লাবণ্য বুকে নিয়ে পাহাড় পেরিয়ে নেমে এসেছে। যমুনা, মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র, ইছামতি কিংবা মধুমতি নদীর কথা মনে পড়ে। চলনে, বলনে, চেহারায় তারা প্রত্যেকেই আলাদা। মেঘনা আর যমুনার বিশালত্বের সৌন্দর্য কেড়ে নিয়েছিল আমার মুখের ভাষা। তাদের উপস্থিতি এত প্রবল যে সামনে দাঁড়ালে আর কোনো চিন্তা খেলে না মনে। মনে পড়ে বাগেরহাটের মধুমতি নদীর কথা। নতুন আঁকতে শেখা বাচ্চারা যেমন মোম–রঙ দিয়ে আঁকাবাঁকা রেখা টেনে দৃশ্যচিত্রে নদীর উপস্থিতি বোঝায়, তেমনই মনে হয়েছিল মধুমতিকে। পাহাড়ের দেশ থেকে এসে সমতলের এই নদীকে মনে হয়েছিল, কোনো শিশু বুঝি খেলতে খেলতে এঁকে রেখেছে। দুধারে ঘন কাশবন, বাদাড়, জঙ্গল এর আগে এরকম জীবন্তভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখিনি। কর্ণফুলির মতো না হলেও আমি এসব নদীকে নিজের করে নিয়েছিলাম। কিন্তু কীর্তিনাশা বা পদ্মাকে দেখেছি শুধু একজন ভ্রমণকারীর চোখে– অত্যন্ত কাছাকাছি থেকে উপলব্ধির ভেতর দিয়ে সেভাবে দেখা হয়ে ওঠেনি। মোহাম্মদ রফিকের কীর্তিনাশা–ই ধীরে ধীরে দেখতে শুরু করি আমি। সে–দেখায় কোনো আনন্দ নেই, নেই কোনো পুলক বা রোমাঞ্চ। মৃত্যু–জরা, দারিদ্র্য আর শত অপমানের জলকণা নিয়ে যেন প্রবাহিত হচ্ছে সে নদী। গরলে ভর্তি জলরাশি যেন পৃথিবীর সব কাল, সব দেশ, শহর, গ্রাম আর স্বপ্নকে ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে। কখনও মনে হয়েছে কীর্তিকে নাশ করতেই এই জনপদে উপস্থিত হয়েছে সে। কখনও মদ কিংবা নারীর চেহারায়।
ছোটকাগজ উত্তরমেঘ–এ প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে মোহাম্মদ রফিক বলেছিলেন, প্রকরণগত দিক থেকে কীর্তিনাশা–র দুর্বলতা তাকে বিদ্ধ করে। নিজস্ব ভাষা ও বোধে নির্মিত কপিলা–কেই বরং তিনি অনেক বেশি নিজের বলে মনে করেন। কবির এই ব্যক্তিগত পছন্দ–অপছন্দ জানা সত্ত্বেও কীর্তিনাশা–র সর্বগ্রাসী স্রোত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারিনি। বৈশাখী পূর্ণিমা ও ধুলোর সংসারে এই মাটি–র পর কীর্তিনাশা যেন বাংলা ভাষার সবক’টি বর্ণমালা জুড়েই তার প্রচণ্ড উপস্থিতি সশব্দেই জানিয়ে দিল। মূলত মোহাম্মদ রফিকের কীর্তিকথার শুরু কীর্তিনাশা থেকে। জীবনানন্দ যে– চোখ দিয়ে বাংলাকে দেখেছেন, সেই চিরায়ত রোমান্টিক ছবিতে প্রথম চিড় ধরাল কীর্তিনাশা।
চারিদিকে শান্ত বাতি– ভিজে গন্ধ মৃদু কলরব;
খেয়ানৌকোগুলো এসে লেগেছে চরের খুব কাছে;
পৃথিবীর এই সব গল্প বেঁচে রবে চিরকাল; –এশিরিয়া ধুলো আজ– বেবিলন ছাই হয়ে আছে। (রূপসী বাংলা, জীবনানন্দ)
এই ছবি বাংলাদেশের গ্রাম–গ্রামান্তরের আবহমান ছবি নয়। গভীর হতাশার সঙ্গেই এটা উপলব্ধি করেছেন রফিক। শান্ত বাড়ি ভিজে গন্ধ–মুদু কলরব চাপা পড়েছে অনিঃশেষ দারিদ্রের নীচে। জীবনানন্দ যেন বাংলার এক বিশুদ্ধ রূপকল্প তৈরির চেষ্টা করেছিলেন। যেখানে সব কিছুই পরিপূর্ণ, গভীর আর নিটোল। এই ছবি একভাবে ভাবতে গেলে পরম। মনের মধ্যে স্বর্গের প্রশান্তি তৈরি করলেও আমাদের বাংলাদেশের চেয়ে তার অবস্থান বহুদূরে। রফিক তাই ধানসিঁড়ির পাশে কীর্তিনাশাকে উপস্থিত করেন। বাংলাদেশের পথে–প্রান্তরে ধানসিঁড়িকে খুঁজতে খুঁজতে মোহভঙ্গ হওয়া যুদ্ধোত্তর প্রজন্মের প্রতিনিধি হিসেবে পাঠকের সামনে এসে দাঁড়ান তিনি। বলেন, ধানসিঁড়ি নয়, কীর্তিনাশাই এদেশের বাস্তবতা।
এইভাবে ভিজে ভিজে কীর্তিনাশা কতদূর যাবে
এই দেশে, বন্যার কি শেষ আছে? বৃষ্টি ও প্রেমের সারাপিঠে এলানো চুলের ঢেউ ভিজে ছপছপ
শীতার্ত বর্ষার ফলা বিধে ফেলে সমস্ত শরীর ;
রোমান্টিকতার পর্দা কী করে যেন ছিঁড়ে গেল। স্বাধীনতার পর সমাজতন্ত্র, আজম খানের পপ গান, বোদলেয়ার আর হিপ্পিদের মতো লম্বা চুল তরুণদের কোথায় যেন এনে ছেড়ে দিল। অস্থির এই সময়ের দাবি তাৎক্ষণিকভাবে মেটাতে গিয়ে সকলেই যেন টগবগ করে ফুটছিল। সে সমাজতন্ত্রই হোক কি কবিতা হোক, শহিদ হওয়ার রাস্তাই বেছে নিলেন এ প্রজন্মের বেশির ভাগ সদস্য। জাসদ কিংবা নকশাল হয়ে মারা পড়ল কেউ। কেউ জীবন দিল কবি হওয়ার বাসনায় অমিতাচারকে সঙ্গী করে। এসব কিছুর মধ্যে দাঁড়িয়ে কীর্তিনাশার প্রবল প্রচণ্ড গর্জন ছাড়া আর কী বা শুনতে পেতেন রফিক? সে–কারণে কীর্তিনাশা একই সঙ্গে গ্রাম–গ্রামান্তর আর শহরের মানুষের আশা–আকাঙ্ক্ষা, ক্ষোভ, বঞ্চনা, অতৃপ্তি আর ক্ষ্যাপামি নিয়ে প্রবাহিত হয়।
এই মেঘে বজ্র নেই, কোনো হিংসা বা বিদ্বেষ
বেচারা নিতান্ত সোজা মেষের শাবক হাবাগোবা,
জড়সড় পায়ে–পায়ে একান্ত অবুঝ ইচ্ছাধীন ;
নেই দস্তু কর্মক্লান্ত মধ্যবিত্ত হাঁটার ধরনে,
একদিন এই মেঘে বৃষ্টি ছিল, তার গন্ধ, স্মৃতি,
ছায়া হ’য়ে পড়ে আছে ছোপ–ছোপ অকর্ষিত পোড়া (‘ঋ’, কীর্তিনাশা)
আশাহীন এই মেঘ যেন এদেশের একদা বিপ্লবের স্বপ্ন দেখা মধ্যবিত্তেরই মনের প্রতিচ্ছবি। মুক্তিযুদ্ধের মতো এত বড় ঐতিহাসিক ঘটনার পরও পাল্টায়নি কোনো কিছু। তাই এই মেঘে স্বপ্ন নেই, নেই কোনো বৃষ্টি, গন্ধ, স্মৃতি।
জসীম উদ্দীন কিংবা আল মাহমুদের মতো কৌম সমাজের যৌথ সুর ধরা পড়েনি মোহাম্মদ রফিকের কীর্তিনাশায়। সনৎকুমার সাহা খুব স্পষ্টভাবে রফিকের প্রবণতাকে চিহ্নিত করেন :
আসলে তাঁর কবিতা নিয়ে একটা প্রত্যাশার জায়গা এর ভেতরে তৈরি হয়ে গেছে। কবিতাকে মেলান তিনি প্রত্যক্ষ জীবনের চলমানতার সঙ্গে, তার নিরাময়হীন দুঃখ–যন্ত্রণার সঙ্গে, নিষ্ঠুর–নির্বিচার আঘাতে বিহ্বলতা ও বিক্ষোভের সঙ্গে, কামনা ও কামনা–রিক্ততার সঙ্গে, আশা ও আশাভঙ্গের সঙ্গে। প্রকৃতি গড়ে তোলে অনুভবের শরীরী প্রতিমা; মানব–মানবীর জীবন–তৃষ্ণা ও অসহায় ভাগ্যলীলা তার বিপুল বিস্তারে মেশে। একাকার হয়। রূপে রূপে প্রতিরূপে একে অন্যের স্পন্দন তোলে। প্রতিধ্বনি জাগায়। তবে কবিতা তাঁর এসবের চাক্ষুষ বিবরণমাত্র নয়। আসলে দৃশ্যমান বাস্তবতা জায়গা করে দেয় তার অন্তর্লীন সত্তাকে। ঠিক যেমন, তেমন হয়তো নয়, রফিক তাকে যেভাবে তার জাগ্রত চেতনায় প্রতিফলিত হতে দেখেন, তেমন।
এত অল্প কথায় মোহাম্মদ রফিককে আর কেউ বোঝাতে পেরেছেন কি না জানি না। উদ্ধৃতিটুকু নোনাঝাউ কাব্যগ্রন্থের আলোচনা থেকে নেওয়া হলেও কবির সমগ্র সৃজনপথকে চিনিয়ে দেবে পাঠককে। বস্তুত নিরাময়হীন দুঃখ–যন্ত্রণা, কামনা ও কামনারিক্ততা, আশা ও আশাভঙ্গের অনুভূতি দখল করে আছে রফিকের কাব্যজগৎ। কীর্তিনাশা–য় এমন হাহাকার থেকে–থেকেই শোনা যাবে :
মারা গেছে কবে? কাল! সে যে–কোনোদিন হ’তে পারে;
পচন ধরেছে মাংসে চোখ দু’টি খাবলে নিয়ে গেছে
শকুন, প্রলুব্ধ চিল, হা–খোলা আতুর ভীত খাদ,
ভেলার ওপর শোয়া খসে পড়ে জলে টুপটাপ
প্রতিটি ঢেউয়ের ঘায়ে বেহুলার স্বপ্নে ধ’স নামে;
তুমি কোনো আশা নও কোনো শেষ নও শধু গাঙ । (‘ক’, কীর্তিনাশা)
আশাহীন এই গাঙ কেবল আমাদের সমাজজীবনে নয়, বরং কবির ব্যক্তিজীবনের আশা ও আশাহীনতার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। সবকিছুই ভেঙে পড়ছে এই প্রবাহের সামনে। ব্যক্তিসম্পর্ক থেকে স্বপ্ন, স্মৃতি ও ভবিষ্যৎ। পদ্মানদীর মাঝি–র মতো ময়নার দ্বীপে স্বেচ্ছাবন্দিজীবন খুঁজে ফেরেন কবি। প্রেম ও প্রেমহীনতার মাঝ থেকে উঠে আসা কপিলার দেখাও মেলে। এই কপিলা তো কীর্তিনাশারই আরেক রূপ। দাম্পত্য জীবনের স্থির সুনিশ্চিত শান্তির মাঝে ঝড়ো বাতাসের মতো সে উপস্থিত হয়।
নীলান্তে বিদ্যুৎ মেঘ নদীতে মাছের ধূর্ত চোখ,
তর জন্য মনডা কেমুন ভারী উথাল–পাথাল,
নাও ভাসাইয়া দূর দ্যাশে যাও, ভুইলো আমারে;
ষাট দশকের কবিদের যৌনজীবনের দিকে না তাকালে তাদের কাব্যপ্রতিভা পুরোপুরি বোঝা যাবে না। এমন কথা অকপটেই কবি মোহাম্মদ রফিকের মুখ থেকে বহুবার শুনেছি। যৌনজীবনের এই অস্থিরতা ও অমিতাচার তাই কীর্তিনাশা–র কবিতায়ও দেখা মেলে। কাম, হতাশা আর পাপবোধ মাঝে মাঝে যেন শ্বাসরুদ্ধকর হয়ে ওঠে। কুচকুচে বাদুড়ের হিংস্র চেরা দাঁতের ভয়ে কাঁপতে থাকা থরথর ফলন্ত ডালিমের ছবি– এই অনুভূতিসঞ্জাত। অথবা চোলাইয়ের সোঁদা গন্ধে দীর্ঘ বেণী নড়ে ওঠার মতো চিত্রকলাও আমরা দেখি। অভ্যস্ত যৌনজীবন ছেড়ে বেরিয়ে আসার এই কাহিনি ষাটের সব কবিরাই কম বেশি বলেছেন। তবে রফিকের এই বলার মাঝে যে–যন্ত্রণা ছিল তা আর কারও মধ্যে দেখেছি– এটা মনে করতে পারি না।
অক্ষরবৃত্তে মিলহীন আঠারো মাত্রায় লেখা হয়েছে কীর্তিনাশা–র বেশিরভাগ কবিতা। দীর্ঘ বাক্য তৈরির এই ঝোঁক আগাগোড়া রক্ষার চেষ্টা করেছেন তিনি। ত্রিশের দশকের রোমান্টিকতা থেকে বেরিয়ে এসে ক্লাসিক্যাল মেজাজ তৈরির চেষ্টা লক্ষণীয়। ঘষে–মেজে তোলা নিটোল দৃশ্যচিত্রের গায়ে ইচ্ছেমতো হাতুড়ি চালিয়েছেন। সুন্দরের পাশে স্থান দিয়েছেন পচা ও গলিতকে। গ্রানাইটের মতো কঠিন শব্দকে ডুবে যাবার ভয় উপেক্ষা করে রেখেছেন পদ্মপাতার ওপর।
আদতে এটাই হলো রফিকের বিচিত্র নান্দনিক জগৎ। যেখানে জলের টানে ভেসে চলেছে গভীর তন্দ্রা, কচুরিপানা, গলিত লাশ, মাতাল, বেশ্যা আর শেষ রাতের চাঁদ।